মাধ্যমিকে সাড়ে ১২ হাজার খাতায় যোগে ভুল কি দ্রুত ফলপ্রকাশের বাহাদুরি নিতে গিয়ে?

বর্তমান বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল বেরোনোর পর যে স্ক্রুটিনি হয়েছে তাতে মোট ১২,৪৬৮টি খাতায় নম্বর যোগে ভুল বেরিয়েছে এবং সংশোধনের পর ৪ জনের ব়্যাঙ্ক বদলে গেছে ও ৭ জন মেধাতালিকায় নতুন করে উঠে এসেছে। মাধ্যমিকের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার ফলাফলে এতটা বিচ্যুতি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। সাধারণভাবে মনে হতে পারে যে, পরীক্ষকরা মন দিয়ে ও যত্ন নিয়ে খাতা দেখেন না। কিন্তু সত্যিই কি তাই?

অভিজ্ঞ শিক্ষক এবং পরীক্ষকদের অধিকাংশের মতে, মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক দুই পরীক্ষারই খাতা দেখা এবং ফলপ্রকাশ নিয়ে পর্ষদ ও কাউন্সিল যে ভাবে তাড়াহুড়ো করে তাতে এই ধরনের ভুল হওয়া– অত্যন্ত অন্যায় ও দুঃখজনক হলেও, মোটেই আশ্চর্যের নয়। তাঁরা বলছেন, দীর্ঘ কয়েক বছর ধরেই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে হচ্ছে এবং দুই পরীক্ষার খাতা দেখার কাজ একই সঙ্গে চলছে। এ দিকে প্রতি বছর বহু শিক্ষক অবসর নিচ্ছেন, অথচ রাজ্য সরকারের নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায়় নতুন শিক্ষক নিয়োগ কার্যত বন্ধ। ফলে এক-একজন শিক্ষককে এক-একটি পরীক্ষার দেড়শোর কাছাকাছি খাতা দেখতে হচ্ছে। তার ওপরে আবার বহু শিক্ষককে একই সঙ্গে মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকের মতো দুটো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার খাতা একই সঙ্গে দেখতে হচ্ছে। অথচ সময় মাত্র দুই থেকে তিন সপ্তাহ। এমনও দেখা যাচ্ছে, মাধ্যমিক পরীক্ষার খাতার প্রথম দফা যেদিন জমা দিতে হচ্ছে, সেইদিনই বা তার পরের দিনই উচ্চ মাধ্যমিকের খাতা নিয়ে আসার দিন পড়ছে। অতীতে ১০ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা না থাকলে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের খাতা দেখা যেত না। এখন স্থায়ী শিক্ষক এত কম যে, এই নিয়ম মানা সম্ভব হচ্ছে না।

আশ্চর্যের ব্যাপার, একই রাজ্য শিক্ষা দপ্তরের অধীন মধ্যশিক্ষা পর্ষদ এবং উচ্চমাধ্যমিক কাউন্সিল হলেও, দুয়ের মধ্যে কোনও সমন্বয় নেই এবং কেউ কারও অসুবিধা দেখতে নারাজ। ফলে শিক্ষকদের অনেকের পক্ষেই দু’রকমের খাতা দেখার সঙ্গে স্কুলের ক্লাস, ইউনিট টেস্টের প্রশ্ন করা, খাতা দেখা– এত মানসিক চাপ ও শারীরিক ধকল সামলে মূল্যায়নে সম্পূর্ণ নির্ভুলতা বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। স্ক্রুটিনিয়ার ও হেড এগজামিনারদেরও একই অবস্থা। তাঁদেরও স্কুলের সব কাজ সামলে এক একজনকে কয়েক হাজার খাতা, মার্কস ফয়েল প্রভৃতি অল্প কয়েকদিনের মধ্যে স্ক্রুটিনি করে পর্ষদ ও কাউন্সিল দপ্তরে পাঠাতে হয়। এই অবস্থা সামাল দেওয়ার একটাই পথ। তা হচ্ছে, দ্রুত স্বচ্ছ পদ্ধতিতে সমস্ত শূন্য শিক্ষকপদে নতুন শিক্ষক নিয়োগ করা। তাতে এক একজন শিক্ষকের খাতার সংখ্যা কমবে। এরই সঙ্গে পর্ষদ ও কাউন্সিলের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা যাতে একই শিক্ষককে দুটো পরীক্ষার খাতাই একই সঙ্গে না দেখতে হয়। কিন্তু পরীক্ষকদের সমস্যা যতই হোক, সরকারি প্রসাদধন্য হওয়ার সুবাদে পর্ষদ ও কাউন্সিলের উচ্চপদে আসীন কর্তাব্যক্তিরা এ সব অভিযোগে কর্ণপাত করতে নারাজ। একটার পর একটা দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির অভিযোগে জেরবার শিক্ষা দপ্তরের কর্তারা একটু মুখরক্ষা করার মরিয়া তাগিদে কত দ্রুত ফলপ্রকাশ করে তাক লাগিয়ে দেওয়া যায় সেই নেশায় বছরের পর বছর মেতে আছেন। তাতে সদ্য কৈশোরপ্রাপ্ত পরীক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের প্রথম পরীক্ষার ফলাফলে যত ক্ষতিই হোক না কেন, তাতে তাঁদের পরোয়া নেই। ‘খাতা ঠিকমতো দেখা হচ্ছে না’ বলে শিক্ষকদের ঘাড়ে একতরফা দোষ চাপিয়ে দিয়ে তাঁরা নিজেরা হাত ধুয়ে ফেলছেন। এই অবস্থায়, শূন্য শিক্ষকপদে দ্রুত নিয়োগ ও ত্রুটিহীন পরীক্ষা পদ্ধতির দাবিতে শিক্ষকদের সঙ্গে ছাত্র ও অভিভাবকদেরও আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া এই অব্যবস্থা নিরসনের অন্য কোনও পথ নেই।