Breaking News

মাথা না নোয়ালে বাঁচতে দেব না, ভেনেজুয়েলাকে মার্কিন হুঙ্কার

ভেনেজুয়েলায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাদুরোর বদলে জুয়ান গুয়াইডো নিজেকে সে দেশের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সেখানকার বেশিরভাগ মানুষ তাঁর নামটুকুও জানত না৷ চরম দক্ষিণপন্থী একটি গ্রুপের সদস্য ৩৫ বছর বয়সী এই মানুষটি কয়েক মাস আগে পর্যন্ত নিজের দলের এক মাঝারি মাপের নেতা ছাড়া আর কিছু ছিলেন না৷ কিন্তু আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পম্পেও–র একটি ফোনের পরেই ২২ জানুয়ারি গুয়াইডো নিজেই নিজেকে একেবারে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হিসাবে ঘোষণা করে বসেন৷ গত দু’দশক ধরে যে দেশটি মার্কিন একাধিপত্যের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তথাকথিত গণতন্ত্র ফেরানোর নামে তাকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করতে মার্কিন কর্তারা তাদের ‘শাসক বদল কারখানায়’ ট্রেনিং দিয়ে গড়েপিটে তুলেছে এই জুয়ান গুয়াইডোকে৷

ভেনেজুয়েলায় ইয়াঙ্কিরা কেন?  — মারাদোনা

কেন ইয়াঙ্কিরা (মার্কিন) ভেনেজুয়েলায় নাক গলাচ্ছে? মেক্সিকোর ডোরাডোস ক্লাবের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসাবে তাঁর দলের জয়কে ভেনেজুয়েলার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাদুরোর উদ্দেশ্যে নিবেদন করে এই মন্তব্যই করলেন বিশ্বখ্যাত ফুটবলার দিয়েগো মারাদোনা৷

১ এপ্রিল ম্যাচ জেতার পর সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, পৃথিবীর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা সাজা ওই ইয়াঙ্কিরা কারা? ওদের হাতে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বোমা আছে বলেই কি ওরা আমাদের চেয়ে বড় হয়ে গেছে? কখনওই তা হবে না৷ মার্কিন নির্দেশে চলা গুয়াইডো নামক ওই পুতুলটাকে ওরা ভেনেজুয়েলার ঘাড়ে চাপাতে পারবে না৷

প্রসঙ্গত, এই মন্তব্যের জেরে মার্কিন সরকারের নির্দেশে মেক্সিকো সরকার মারাদোনার মতো খেলোয়াড়কে তাঁর পদ থেকে সরানোর জন্য ফুটবল ফেডারেশনের উপর চাপ দিচ্ছে৷

 

১৯৯৮ সালে হুগো স্যাভেজ ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপুল তেল সম্পদে সমৃদ্ধ এই দেশটির দিকে থাবা বাড়ায়৷ উদ্দেশ্য, সেখানকার বামপন্থী সরকারকে উৎখাত করে নিজেদের অনুগত সরকার বসানো৷ মার্কিন মদতে বহু বার প্রেসিডেন্ট স্যাভেজকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে৷ বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাদুরোর উপরেও ইতিমধ্যেই তিনবার আক্রমণ চালানো হয়েছে৷

২০০৫–এর অক্টোবর মাসে, প্রেসিডেন্ট স্যাভেজের জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে, সেই সময় ভেনেজুয়েলার দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীর পাঁচ ছাত্রনেতাকে মার্কিন মদতপুষ্ট সেন্টার ফর অ্যাপ্লায়েড নন–ভায়োলেন্ট অ্যাকশন অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিস বা সিএএনভিএএস (ক্যানভ্যাস) নামক একটি সংস্থা সার্বিয়ার বেলগ্রেডে নিয়ে যায়৷ উদ্দেশ্য– ভেনেজুয়েলায় বিশৃঙ্খলা তৈরির ট্রেনিং দেওয়া৷ এই ক্যানভ্যাসকে পয়সা জোগায় ‘ন্যাশনাল এনডাওমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি’, যার পিছনে রয়েছে মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগ সিআইএ৷ দেশে দেশে শাসক বদলের মার্কিনী ষড়যন্ত্রের প্রধান যন্ত্রী তারাই৷ ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউট এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইন্সটিটিউট–এর মতো আরও কয়েকটি সংস্থাও ক্যানভ্যাসকে অর্থ সাহায্য করে৷ ‘শ্যাডো সিআইএ’ নামে পরিচিত গোয়েন্দা সংস্থা ‘স্ট্র্যাটফোর’ থেকে ফাঁস হওয়া ই–মেল থেকে জানা গেছে, ১৯৯৯–২০০০ সালে যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মিলোসেভিচের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ফেনিয়ে তোলার জন্যও সিআইএ ক্যানভ্যাসকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিল৷ ক্যানভ্যাসের ট্রেনিং কর্মসূচি দেখভাল করার দায়িত্ব পালন করে স্ট্র্যাটফোর৷ ফাঁস হওয়া ই–মেল সূত্রে স্পষ্ট হয়েছে, কীভাবে তারা ষড়যন্ত্র রূপায়িত করার প্রশিক্ষণ দেয়৷ তারা ই–মেলে লিখেছে, ভেনেজুয়েলার পাঁচটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সাথে ছাত্রবিক্ষোভ শুরু হবে, তখন বোঝা যাবে ট্রেনিং শেষ হয়ে ‘আসল কাজ’ শুরু হয়েছে৷

এর দু’বছর পর ২০০৭ সালে শুরু হয় এই ‘আসল কাজ’৷ ওই বছরেই ভেনেজুয়েলার সরকার রাষ্ট্রবিরোধী অভ্যুত্থানে মদত দেওয়ার কারণে মার্কিন পুঁজির মদতপুষ্ট বেসরকারি টেলিভিশন স্টেশন আরসিটিভি–র লাইসেন্স নবীকরণ করতে অস্বীকার করে৷ একই বছরে প্রেসিডেন্ট স্যাভেজ প্রশাসনিক একটি বিষয়ে গণভোটের আয়োজন করেন৷ এই দুটি বিষয়কে ঘিরে বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকেই মার্কিন মদতে তৈরি হয় ‘জেনারেশন ২০০৭’ নামের একটি সংগঠন, যার কাজ হল ভেনেজুয়েলায় নানা ভাবে বিশৃঙ্খলা তৈরি করা৷ ২০০৭ সালে ভেনেজুয়েলায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়ান ব্রাউনফিল্ড আমেরিকার স্বরাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো ই–মেলে ‘জেনারেশন ২০০৭’–এর প্রভূত প্রশংসা করেন৷ উইলকিলিকস তা ফাঁস করে দেয়৷ এদের মদত দেয় ভেনেজুয়েলার স্যাভেজবিরোধী কয়েকজন ধনকুবের এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট কয়েকটি সংস্থা৷ ‘জেনারেশন ২০০৭’ ব্যাপক সক্রিয় হয়ে ওঠে ২০০৯ সালে৷ ২০১০ সালে ভেনেজুয়েলায় ভয়ঙ্কর জলাভাব দেখা দিয়েছিল৷ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলি৷ সংকট আরও বাড়িয়ে তুলেছিল বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক মন্দা এবং খনিজ তেলের কমতে থাকা দর৷ ফাঁস হওয়া ই–মেল সূত্রে জানা গেছে, ওই বছরের নভেম্বর মাসে গুয়াইডো সহ আরও কয়েকজন ছাত্র মেক্সিকোর মেক্সিকানা হোটেলে পাঁচদিনের এক গোপন প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিলেন৷ প্রশিক্ষণ দিয়েছিল ‘ওটপোর’ নামের মার্কিন মদতপুষ্ট শাসক–বদলে অভিজ্ঞ একটি সংস্থা৷ গুয়াইডো ও তার সঙ্গীদের শেখানো হয় কীভাবে এই সুযোগে প্রেসিডেন্ট হুগো স্যাভেজকে হঠানোর ষড়যন্ত্র পাকিয়ে তেলা যায়৷ সেবারেও অর্থসাহায্য এসেছিল বেশ কয়েকটি মার্কিন সংস্থা থেকে৷ ষড়যন্ত্রীদের দলে ছিল তেলশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ভেনেজুয়েলার তিন ধনকুবেরও– প্রেসিডেন্ট স্যাভেজের জনকল্যাণমুখী নীতি যাদের স্বার্থে ঘা দিয়েছিল৷

এই পরিকল্পনার পথ ধরে তৈরি হয় ষড়যন্ত্রের আরও কিছু নকশা, যা পরে ভেনেজুয়েলা সরকারের হাতে আসে৷ সেইসব নথি ভেনেজুয়েলা সরকার ২০১৪ সালের মে মাসে প্রকাশ করে দেয়৷ জানা যায় প্রেসিডেন্ট মাদুরো–হত্যা ষড়যন্ত্রের বহু খুঁটিনাটি বিষয়৷ বেরিয়ে আসে ষড়যন্ত্রের নেতার নাম৷ আরেকটি ফাঁস হওয়া ই–মেলে সেই নেতাকে দাবি করতে শোনা যায় যে, এই ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের উপর আশীর্বাদের হাত রয়েছে কলম্বিয়ার মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেভিন হোয়াইটেকারের৷

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেই ষড়যন্ত্রের অঙ্গ হিসাবেই দেশ জুড়ে তাণ্ডব শুরু হয়৷ পশ্চিমি সংবাদমাধ্যম এই তাণ্ডবকে প্রেসিডেন্ট মাদুরোর ‘স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন’ বলে ব্যাপক প্রচার দিলেও, আসলে এর পিছনে যে গুয়াইডোর ‘পপুলার উইল’ সংগঠনটিই আছে, তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়ে গেছে৷ এই তাণ্ডবে মৃত্যু হয় ৪৩ জনের৷ কিন্তু প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে হঠানোর ষড়যন্ত্র সফল হয় না৷ এর তিন বছর পরে আবার সক্রিয় হয় তারা৷ মাদুরো–সমর্থকদের হত্যা করে, জনগণের সম্পত্তি নষ্ট করে আবারও তাণ্ডব চালায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সুতোর টানে নাচতে থাকা কাঠপুতুল গুয়াইডোরা৷ মৃত্যু হয় ১২৬ জনের, যাদের বেশিরভাগই প্রেসিডেন্ট স্যাভেজের নীতির অনুগামী৷ অনেককে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে গুয়াইডোর দলবল৷

২০১৪–র এই সংঘর্ষে গুয়াইডো যে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন, তা প্রমাণিত হয়েছে৷ তিনি নিজেই একটি ভিডিও টুইট করেন যেখানে তাঁকে হেলমেট ও গ্যাস–মুখোশ পরে থাকা অবস্থায় একটি হাইওয়েতে পুলিশের সাথে সংঘর্ষরত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে৷ সেই অমানবিক তাণ্ডবে মোটরসাইকেল আরোহীদের হত্যা বা আহত করতে এরা রাস্তায় স্টিলের তার ফেলে রাখত৷ ভেনেজুয়েলার গণতন্ত্র নেই বলে চিৎকার করা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাতের পুতুল গুয়াইডোর দলবলের সাধারণ মানুষের প্রাণের প্রতি দরদের এই হল নমুনা৷

প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে হঠানোর ষড়যন্ত্র সফল করতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দেশের রাজনীতিতে একেবারেই অপরিচিত এই গুয়াইডোকে বেছে নিল কেন? এ ব্যাপারে আলোকপাত করেছেন ভেনেজুয়েলারই এক বিশ্লেষক৷ তিনি দেখিয়েছেন, আদর্শের বালাই না থাকায় গুয়াইডোকে যেমন খুশি তেমন রূপেই সাজিয়ে দিতে পারা যায়৷ সামাম্রাজ্যবাদীরা৷ তাই তাকেই বেছে নিয়েছে তারা৷

প্রেসিডেন্ট হিসাবে মাদুরোর দ্বিতীয়বার শপথ নেওয়ার সময় যাতে ভেনেজুয়েলায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা তৈরি করার ট্রেনিং নিতে ২০১৮–র ডিসেম্বরে গুয়াইডো ওয়াশিংটনে যান৷ মাদুরোর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের ঠিক আগের রাতে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স এবং কানাডার বিদেশ মন্ত্রী গুয়াইডোকে ফোন করে তাঁর প্রতি নিজেদের সমর্থনের কথা জানিয়ে দেন৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও জানিয়ে দেন, গুয়াইডো নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলে তিনি সমর্থন করবেন৷ মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেট মাইক পম্পেও গুয়াইডোর সাথে দেখা করেন৷

আসলে ভেনেজুয়েলার রাজনৈতিক মহলে গুয়াইডো যতই অপরিচিত হোক, ঠিক এইরকম একজন নীতি– আদর্শহীন মানুষের প্রয়োজন ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের, যার চরিত্রে জঙ্গিভাব এবং সুবিধাবাদের মিশেল রয়েছে৷ যে কারণে ট্রাম্প প্রশাসনের এক সদস্য গুয়াইডো সম্পর্কে বলেছেন, ‘ভেনেজুয়েলায় আমাদের মতলব হাসিল করার জন্য ঠিক এরকম একজন লোকেরই দরকার ছিল’৷ খনিজ তেলের লক্ষ্যে ভেনেজুয়েলায় হানাদারি চালানোর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সুরে সুর মিলিয়ে, গুয়াইডোও দেশের সংকট কাটানোর অজুহাতে ‘(আমেরিকার) মানবিক হস্তক্ষেপে’র আহ্বান জানিয়েছেন৷ এভাবেই পোষা তোতাপাখির মতো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শেখানো বুলি আউড়ে ভেনেজুয়েলায় মার্কিন আগ্রাসনের রাস্তা পরিষ্কার করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন গুয়াইডোরা এবং এই লক্ষ্যেই তাদের সামনে আনছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৩৫ সংখ্যা)