‘‘সিপিআই, সিপিআই(এম) এবং সিপিআই(এম-এল)-এর মতো দলগুলো আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের স্বীকৃতি নিয়ে ও তার সঙ্গে সাম্যবাদী আন্দোলনের যে বিশ্বজোড়া গৌরব তৈরি হয়েছিল, তাকে পুঁজি করে এ দেশে দাঁড়িয়েছিল। মানুষের মধ্যে মুক্তির আকাঙক্ষা থেকে মাক্সর্বাদ-লেনিনবাদের প্রতি যে স্বাভাবিক দুর্নিবার আকর্ষণের কথা আমি আগেই বলেছি, তার ফলেই এইসব দলগুলোর নেতাদের মুখে মাক্সর্বাদ-লেনিনবাদের কথা শুনে দলে দলে মানুষ তাদের পিছনে জড়ো হয়েছে। আবার দেখবেন, পার্টির আকারটা বড় হয়ে গেলে, তাকে ভিত্তি করে মানুষের মধ্যে একটা মানসিকতা গড়ে ওঠে। পার্টিটার নেতৃত্ব সঠিক হোক, বেঠিক হোক, তার প্রভাবে প্রভাবিত মানুষগুলো শুধু পার্টিটা বড় বলেই নাচতে থাকে। তাদের মানসিক গঠন ও চিন্তা প্রক্রিয়াটা একটা ভিন্ন ধরনের হয়ে যায়। আর কোনও কিছু তারা বিচার করতে চায় না। লড়ে প্রাণ পর্যন্ত দেয়, তবু বিচার-বিশ্লেষণে আসতে চায় না। আবার, যদি কখনও বিচার-বিশ্লেষণে আসেও, তবে সেটাও হয়ে দাঁড়ায় মনগড়া বিচার-বিশ্লেষণ পদ্ধতি। কারণ, যে পার্টিটার রাজনীতির দ্বারা তারা প্রভাবিত, সেই পার্টিটা মাক্সবাদ-লেনিনবাদের নামে যে চিন্তাপ্রক্রিয়া, যে বিচারপদ্ধতি নিয়ে চলে, সেটা মাক্সর্বাদী-লেনিনবাদী চিন্তাপ্রক্রিয়া বা বিচারপদ্ধতিই নয়। ফলে, এসব দলের কর্মীদের এবং এদের রাজনীতির প্রভাবে প্রভাবিত মানুষগুলোর চিন্তা ও বিচারের পদ্ধতি অ-মাক্সর্বাদী হওয়ার জন্য যে সিদ্ধান্তগুলো তারা করে, সেগুলো সমাজ পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক নিয়মের প্রেক্ষাপটে হয়ে দাঁড়ায় মনগড়া। এরাই পরে যখন দেখে কিছুই হল না, তখন হতাশ হয়, আন্দোলন থেকেই সাময়িকভাবে হলেও মুখ ফিরিয়ে নেয়।
তাই যে কথা বলছিলাম, তত্ত্ব সঠিক হওয়া সত্ত্বেও তাকে বাস্তবায়িত করার মতো উপযুক্ত সাংগঠনিক শক্তি পারিপার্শ্বিক নানা কারণে যদি অর্জন করা না যায়, তবে বিপ্লব হবে না। আবার, একটা দল মাক্সর্বাদ-লেনিনবাদের বুলি আউড়ে সুবিধাজনক পরিস্থিতি পেয়ে যদি ভাল শক্তি অর্জন করেও ফেলে, বড় পার্টি হয়ে যায়, বহু লোক তার পিছনে জড়ো হয়ে যায়, তা সত্ত্বেও সেই দলের তত্ত্বটা যদি ভুল হয়, চিন্তাপ্রক্রিয়া ভুল হয়, বিচার-বিশ্লেষণ পদ্ধতি ভুল হয়, তা হলে শুধু তারা শক্তির জোরে বিপ্লব করে দেবে, তা হয় না। বিষয়টা এত সোজা নয়।
সুতরাং, দলের নেতৃত্বের বিচার-বিশ্লেষণ পদ্ধতি, নেতা-কর্মীদের চিন্তাপ্রক্রিয়া এবং ওই দলের প্রভাবে প্রভাবিত মানুষগুলোর চিন্তাপদ্ধতির যে কথা আমি বললাম, মনে রাখবেন, সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কথাও আপনাদের মনে রাখতে হবে। মাক্সর্বাদী-লেনিনবাদী বিজ্ঞান কথাটার মানে হচ্ছে, সঠিক বৈজ্ঞানিক বিচারপদ্ধতি, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাপ্রক্রিয়া। এটা আয়ত্ত করার ব্যাপারটা শুধুমাত্র একজন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির উপর নির্ভর করে না, বরং একজন মানুষের বুদ্ধি কী ভাবে প্যাটার্নড হবে, অর্থাৎ কোন ধাঁচায় গড়ে উঠবে, সেটা নির্ভর করে সেই বিশেষ মানুষটির চিন্তাপ্রক্রিয়ার উপর। যেমন, বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের দৃষ্টান্তই ধরুন। যাঁরা ট্রটস্কি, বুখারিন বা তাঁদের শিবিরের অন্যান্যদের মতাবলম্বী ছিলেন, অথবা, পরবর্তীকালে যাঁরা ক্রুশ্চেভের কট্টর সমর্থক ছিলেন, তাঁরা অতি সহজেই বিশ্বাস করেছেন ও জোর গলায় বলেছেন যে, স্ট্যালিন সোভিয়েট ইউনিয়নের অপরিমেয় ক্ষতি করে গেছেন। এমন কথাও তাঁরা বলেছেন যে, স্ট্যালিনের মতো ‘ধুরন্ধর শয়তান’ আর হয় না। অন্য দিকে, যাঁরা তৃতীয় আন্তর্জাতিকের অনুগামী ছিলেন, লেনিন-স্ট্যালিন-মাও সে-তুঙের নেতৃত্বে যাঁদের দ্বিধাহীন আস্থা ও আনুগত্য ছিল, তাঁদের ট্রটস্কির ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপ সম্পর্কে, অথবা ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে আধুনিক শোধনবাদীরা সমাজতন্ত্রের যে অপরিমেয় ক্ষতি করেছে, সে বিষয়ে বিশ্বাস ছিল সমস্ত তর্কের উর্ধ্বে। অথচ দেখুন, এই দুই শিবিরের লোকেরাই দাবি করেন যে, তাঁরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ এবং সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাস করেন। তা হলে, আপনারা দেখছেন, উভয়পক্ষই নিজেদের সাম্যবাদী বলছেন, সাধারণভাবে উভয়েই সাম্যবাদী আন্দোলনের পরিমণ্ডলের মধ্যে আছেন, তবুও এত গুরুত্বপূর্ণ বা একটা মূল বিষয়ের উপর উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত একেবারে বিপরীত। এ রকম কেন হচ্ছে?
আমাদের দেশেও দেখবেন, সি পি আই, সি পি আই(এম) বা অন্যান্য দলের এমন বহু নেতা কর্মী আছেন, যাঁরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে, আমাদের দল এস ইউ সি আই-এর রাজনীতি যুক্ত বামপন্থী আন্দোলনে ভাঙন ঘটাচ্ছে এবং কংগ্রেসের সুবিধা করে দিচ্ছে। আবার, উল্টোদিকে আমাদের দলে একেবারে সাধারণ স্তরে এমন বহু কর্মী আছেন, যাঁদের অন্য কোনও দলের নেতা কোনও মতেই এস ইউ সি আই দলের সত্যিকারের বিপ্লবী চরিত্র সম্পর্কিত ধারণাকে গুলিয়ে দিতে পারবেন না।
তা হলেই দেখা যাচ্ছে, চিন্তাপ্রক্রিয়া এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তির চিন্তার স্বাধীনতার সীমাটা এই জায়গায়। ব্যক্তির জিনিয়াস বা ট্যালেন্ট (প্রতিভা) যাই বলুন, কোনও কিছুই সীমাহীনভাবে স্বাধীন নয়, যেমন খুশি তিনি চলেনও না, চলতে পারেনও না। প্রত্যেকেই ভাবেন যে, তিনি খুব স্বাধীনভাবে মুক্তমনে চিন্তা করছেন। এ কথা ঠিক যে, মানুষের মনের একটা স্বাধীনতা আছে, কিন্তু সেই স্বাধীনতা সীমাহীন নয়, তা আপেক্ষিক। মনের স্বাধীনতারও একটা সীমা আছে। সেই সীমাটা দুটো জায়গায়। একটা হচ্ছে বাস্তব পরিবেশ, আর একটা হচ্ছে চিন্তাপ্রক্রিয়া।
অর্থাৎ একজন ব্যক্তির ভিতরে যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার অজান্তে বা জানিতভাবে তার চিন্তাপদ্ধতি গড়ে উঠেছে, সেই প্রক্রিয়াটির দ্বারা তার মনের বা চিন্তার স্বাধীনতা সীমায়িত। তাই আমরা একেক জন একেক রকমভাবে মাক্সর্বাদ বুঝছি, লেনিনবাদ বুঝছি এবং তা ব্যক্ত করছি। সমাজে অনেক ব্যক্তি যাঁরা মাক্সর্বাদকে সঠিক বলে মনে করেন, তাঁরাও মাক্সর্বাদকে বলছেন তাঁদের মতন করে। অনেকেই মনে করেন, মাক্সর্বাদের সমস্ত বই তিনি পড়েছেন, তিনি সব জানেন। মাক্সর্বাদ জানার তাঁর কোনও অসুবিধা হয়নি। সুতরাং, তাঁর বোঝায়ও কোনও গণ্ডগোল হয়নি। এ ভাবে যাঁরা ভাবেন, দেখা যাবে, মাক্সর্বাদ নিয়ে তাঁদের মধ্যে পরস্পর আলোচনায় হয়তো কোনও পয়েন্টে কোথাও দু-লাইনের ব্যাখ্যায় তাদের মধ্যে ঐক্য হচ্ছে, কিন্তু, তারপর তিন লাইনে গিয়ে বলে দিচ্ছে, তাদের মধ্যে ঐক্য হবে না। অথচ সবাই মনে করছেন, তাঁরা সব জানেন। তা হলে দেখা যাচ্ছে, কারওর মনে করাটা এখানে আসল নয়, তা দিয়ে সমস্যার মূল জায়গাটা ধরা যাবে না। এখানেই প্রশ্ন আসে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের প্রকৃত উপলব্ধির।” ‘বৈজ্ঞানিক দ্বন্দ্বমূলক বিচারপদ্ধতিই মাক্সর্বাদী বিজ্ঞান’ বই থেকে