রাজ্যে অর্ধেকই প্রায় মহিলা ভোটার। তাঁদের দিকে তাকিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে সরকারে এলে বিজেপি মহিলাদের সরকারি বাসে বিনা ভাড়ায় যাতায়াতের সুযোগ দেবে, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেবে, সরকারি চাকরিতে ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণ করবে, কেজি থেকে পিজি সমস্ত মেয়ের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা দেবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যেভাবে নারীবিদ্বেষী মন্তব্য বছরভর পরিবেশন করেছেন, এখন কি ভোটের মুখে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইছেন? দেশের নাগরিক হিসাবেই মহিলাদের শিক্ষা, রোজগার, স্বাস্থ্যের সুযোগ ইত্যাদির অধিকারী হওয়ার কথা ছিল। এ জন্য আলাদা প্রতিশ্রুতি দিতে হচ্ছে কেন? নারীর প্রকৃত সক্ষমতার জন্য গত সাত বছরে কী করেছে বিজেপি? মহিলাদের সক্ষমতার জন্য অপরিহার্য শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নিরাপত্তা এবং কাজ করার উপযুক্ত পরিবেশ– সেগুলির ব্যবস্থাই করতে পারলেন না তাঁরা। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের রিপোর্ট অন্তত সে কথাই বলছে। ১৯৯৯-২০০০ সালের তুলনায় ভারতে কর্মরত মহিলাদের হার বর্তমানে ১৪ শতাংশ কমেছে। একটি সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, ভারতে নিয়মিত রোজগেরে ব্যক্তিদের মধ্যে মহিলাকর্মী অতি সামান্য। আবার লকডাউনে যত কর্মী কাজ হারিয়েছেন তার প্রায় অর্ধেকই মহিলা। ‘বেটি বঁচাও, বেটি পড়াও’ বলে খুব গলা ফাটিয়ে বিজেপি চালু করেছিল ‘সুকন্যা সমৃদ্ধি যোজনা’। এই প্রকল্পে এখন সুদ কমিয়েই চলেছে। মহিলাদের সক্ষমতা তৈরিতে বিজেপি নেতারা কতখানি উদগ্রীব এই উদাহরণেই তা স্পষ্ট।
মহিলাদের অগ্রগতি নিয়ে যারা প্রচারে সরব, সেই বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে মহিলাদের অবস্থা কেমন? ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর তথ্য বলছে, দেশে প্রতি ১৬ মিনিটে একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, প্রতি মিনিটে একজন নারী নির্যাতনের শিকার হন। তা নিয়ে বিজেপি নেতারা কিন্তু নীরব। নারী পাচার, নারী নির্যাতনে বিশ্বের মধ্যে ভারত রেকর্ড গড়েছে বিজেপি শাসনেই।
প্রধানমন্ত্রী ‘বেটি বাঁচাও’-এর স্লোগান তুলেছিলেন। বেটিরা কেমন আছে বিজেপি জমানায়? উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ডে মহিলাদের অবস্থা ভয়ঙ্কর। ধর্ষণের সংখ্যায় উত্তরপ্রদেশের স্থান দেশের প্রথম সারিতে। শিশুকন্যা নির্যাতনেও তাই। বিজেপি শাসনে উত্তরপ্রদেশের উন্নাও, হাথরসে মহিলাদের উপর ভয়ঙ্কর নির্যাতনের সাক্ষী গোটা দেশ। দাঙ্গাবিধ্বস্ত মুজজফরনগরে বহু মহিলা বর্বর অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। এরপর রয়েছে মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ। প্রতি লক্ষ জনসংখ্যায় মহিলাদের উপর নির্যাতন, ধর্ষণে এগিয়ে রয়েছে আসাম। সব ক’টিই বিজেপি শাসিত রাজ্য। এ রাজ্যে এমন ‘সোনার শাসন’ আনার কথাই কি বলছে বিজেপি?
মহিলাদের প্রতি বিজেপির দৃষ্টিভঙ্গি চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল। না হলে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ অনায়াসে বলতে পারতেন না, ‘মেয়েদের স্বাধীনতা দেওয়াই উচিত নয়, মেয়েদের পুরুষের নিয়ন্ত্রণে না রাখলে তারা ধ্বংসাত্মক শক্তিতে পরিণত হয়’ (ইন্ডিয়ান এ’প্রেস.কম-১৭.৪.২০১৭)। তাই হাথরসের ভয়াবহ ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পর উত্তরপ্রদেশের বিজেপি বিধায়ক সুরেন্দ্র সিং বলতে পারেন, ‘ধর্ষণ থেকে মেয়েকে রক্ষার দায়িত্ব পরিবারকেই নিতে হবে। সরকার বা আইনের কিছু করার নেই’। বাস্তবে ধর্ষণের জন্য মহিলাদেরই দায়ী করেছেন তিনি (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-৫.৯.২০২০)। যে দলের নেতারা কুরুচিকর, অশ্লীল মন্তব্যে মহিলাদের অসম্মান করে থাকেন অহরহ, তাঁদের মুখে মহিলাদের উন্নয়নের কথা চূড়ান্ত ভণ্ডামি। কেন্দ্রে ও রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-মন্ত্রীদের মুখে অতি নিম্নমানের অভব্যতা-কদর্যতার প্রকাশ ঘটছে। পূর্বতন শাসক কংগ্রেস ও সিপিএম নেতারাও এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। মহিলাদের সম্পর্কে তাঁদের মন্তব্য কদর্যতার সীমাহীন দৃষ্টান্ত। সম্প্রতি একটি ঘটনা শালীনতার সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এ রাজ্যের এক বিজেপি সাংসদ বলেছেন, ‘বাংলা নিজের মেয়েকে চাইবে কী করে, মেয়ে তো অন্যের সম্পদ।’ মহিলাদের সম্বন্ধে এই দৃষ্টিভঙ্গিই বিজেপির আসল সংস্কৃতি। এই ‘ছাপ্পান্ন ইঞ্চি’র সংস্কৃতি চূড়ান্ত পুরুষ আধিপত্যবাদী, যেন তালিবানি শাসনের একটা নগ্ন প্রকাশ।
কিছু দিন আগে আফগানিস্তানে তিন মহিলা সাংবাদিককে গুলি করে হত্যা করেছিল চূড়ান্ত অন্ধ মৌলবাদী তালিবানরা– তাঁদের অপরাধ, তাঁরা মহিলা হয়েও পেশাদার কর্মী হয়েছিলেন। একই অপরাধে বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সেখানকার এক মহিলা চিকিৎসককে। ধর্মান্ধ তালিবানিদের দৌলতে আফগানিস্তানে অহরহ ঘটে থাকে এ ধরনের ঘটনা। এখানেও কি ‘হিন্দু তালিবানি’ শাসনের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে না? সমস্ত নাগরিকদের, বিশেষত মহিলাদের ভাবতে হবে এই অন্ধকার, পিছিয়ে থাকা সমাজ কি আমরা চাইব?
ফলে বিজেপি নেতারা যখন প্রতিশ্রুতি দেন– আমরা মহিলাদের উন্নয়ন করব, তখন ঘোরতর সন্দেহ জাগে বইকি।