মিছিল কলকাতার রাজপথ কিছু কম দেখেনি৷ কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলের মিছিলে প্রথম পা মেলানো মধ্যবয়সী এক মানুষের উপলব্ধি হতে পারে ‘আমার নতুন জন্ম হল’ ঠিক এই অনুভূতিই জানিয়ে গেলেন কলকাতার এক সরকারি স্কুল ছাত্রের বাবা তাপসবাবু৷ ৩০ জানুয়ারি মহামিছিলের একটা লিফলেট স্কুলের গেটে পেয়ে বাবাকে দিয়েছিল ছেলে৷ এক মুহূর্ত আর বিলম্ব নয়, সরকার এখনই প্রথম শ্রেণি থেকে পাশ–ফেল চালুর ঘোষণা করুক, রাজ্যে নিষিদ্ধ হোক মদ, সরকার কাজ দিক কোটি কোটি বেকারকে, নিশ্চিত করুক নারীর নিরাপত্তা, কৃষকের ফসলের ন্যায্য দামের ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে– এমনই কয়েকটি জ্বলন্ত দাবি ছিল সেই লিফলেটে৷ অস্বীকার করতে পারেননি প্রায় কেউই৷ তাই তাপসবাবুর মতো ছুটে এসেছিলেন বহু মানুষ, যাঁরা আগে কোনও দিন মিছিলে হাঁটার কথা ভাবেনওনি৷ এমন মিছিল কলকাতা ক’টা দেখেছে?
৩০ জানুয়ারির মহামিছিল যখন চলেছে হেদুয়া থেকে এসপ্ল্যানেড, রাস্তার দু’ধারে কাতারে কাতারে মানুষ দাঁড়িয়ে দেখেছেন৷ মিছিলের মাথা যখন বৌবাজার মোড় পেরিয়ে গেছে শেষাংশ তখনও হেদুয়া থেকে বার হতে পারেনি৷ স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘক্ষণ আটকে থেকেছে অনেকগুলি ব্যস্ত রাস্তা৷ উঠেছে স্লোগান– রক্ত চাইলে রক্ত দেব, কিন্তু কোটি কোটি গরিব খেটেখাওয়া ঘরের সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে আর ছিনিমিনি খেলতে দেব না৷ ট্যাবলোর মাইক থেকে ভেসে আসছে আবেদন– মিছিলে আপনাদের চলাচলের কিছু অসুবিধা হচ্ছে নিশ্চয়ই, কিন্তু এই রাজ্যের ছাত্রদের শিক্ষার রাজপথ রুদ্ধ করে থাকা সরকারি নীতির বিরুদ্ধে এই মিছিল না করলে কি চলত?
পথচলতি মানুষই একে অপরকে বুঝিয়েছেন, না– চলত না৷ এই মিছিলের প্রয়োজন আজ সর্বাগ্রে৷ ভোট শিকারিদের মিছিল এ নয়৷ এ মিছিল অগণিত গরিব মধ্যবিত্ত মানুষের জ্বলন্ত সমস্যা সমাধানের দাবিতে৷ হেদুয়া পার্কে জমায়েতের ঘোষিত সময় ছিল বেলা ১টা৷ সাড়ে বারোটার আগে থেকেই মঞ্চের সামনের রাস্তায় শুধু কালো কালো মাথার ভিড়৷ ১টার পর বিবেকানন্দ রোড থেকে বিডন স্ট্রিটের মোড় পর্যন্ত তিল ধারণের স্থান নেই৷ তখনও আসছে একের পর এক গাড়ি ভর্তি মানুষ৷ কে নেই সেই জনসমুদ্রে? দার্জিলিং–জলপাইগুড়ি চা শ্রমিক থেকে শুরু করে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপাঞ্চলের মৎস্যজীবী, রাজ্যের প্রতিটি জেলার চাষি–মজুর, চাকরিজীবীরা৷ মদ বিরোধী আন্দোলনের লড়াকু মহিলারা এসেছেন সুদূর দক্ষিণ দিনাজপুর থেকে, এসেছেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার যুবকরা৷ আছেন মহিলারা, তাঁদের হাতে ধরা আছে সন্তানের হাতটি৷ ডাক্তার, অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, স্কুল শিক্ষক, ছাত্র– সর্বস্তরের মানুষের বিশাল জমায়েতের সামনে শুরু হল সভা৷ গণসংগঠনের নেতৃবৃন্দের বক্তব্যের পর এস ইউ সি আই (সি)–র রাজ্য সম্পাদক কমরেড চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য জানালেন আহ্বান– একদিকে যেমন পাশ–ফেল ফিরিয়ে আনতে সরকারকে বাধ্য আমরা করবই, তেমনই জেলায় জেলায় মদের ভাটি গড়ে উঠতে দেখলেই গণপ্রতিরোধে তা গুঁড়িয়ে দিন আপনারা৷ সভায় গৃহীত হল সার্বভৌম রাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্তের প্রতিবাদে একটি প্রস্তাব৷
শুরু হল মিছিল৷ ছাত্র–যুবদের পাশাপাশি অশক্ত শরীরে লাঠিহাতে হাঁটছেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা, বৃদ্ধ চাষি৷ কখনও মা কখনও পাড়া–প্রতিবেশীর কোল ভাগ করে চলেছে দুধের শিশু৷ মা যে চেয়েছেন সন্তানকে নিয়ে এই মিছিলের স্পর্শ গ্রহণ করতে৷ হোক কষ্ট, তবু আসা চাই এই মিছিলে৷ কলকাতার বেলগাছিয়া এলাকা থেকে ছাত্র–ছাত্রীদের নিয়ে এসেছিলেন, মহম্মদ কলিম৷ কেন এসেছেন এই প্রশ্ন শুনে অবাক– বললেন, আমার সন্তানের থেকেও এই ছাত্রছাত্রীরা প্রিয়৷ পাশ–ফেল না থাকায় ওদের ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি, আমি আসব না?
মিছিল যত এগিয়েছে তার আয়তন ততই বেড়েছে৷ মিছিল যখন কলেজ স্ট্রিটে পৌঁছেছে তখন সেখানে অপেক্ষা করছেন হাজার হাজার মানুষ৷ দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বহু মানুষ ট্রেনের দেরিতে সময় মতো আসতে পারেননি, তাঁরা কেউ ঢুকলেন এখানে, আরও অসংখ্য মানুষ ঢুকলেন বৌবাজার মোড়ে৷ কলকাতার বহু মানুষও যোগ দিয়েছেন মাঝপথ থেকে৷ ওয়েলিংটন এলাকার বাসিন্দা এক যুবক এতদিন দূর থেকে দেখেছেন এস ইউ সি আই (সি)–কে৷ ৩০ জানুয়ারির মিছিল যখন তাঁর বাড়ির কাছে, পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে পা মেলালেন মিছিলে৷ মিছিলের দু’দিকে অসংখ্য মানুষ শান্তভাবে দাঁড়িয়ে মিছিল দেখেছেন, রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করেননি৷ মিছিল দেখে কেউ বলেছেন লক্ষ মানুষ হাঁটছেন, কেউ বলেছেন আরও বেশি৷ সোসাল মিডিয়ায় ঘুরছে– লক্ষাধিক মানুষের মিছিল করে এস ইউ সি আই নজির গড়ল৷
এই লক্ষাধিক মানুষের মিছিলে এসেছেন যে সব মানুষ, তাঁদের অনেকের বাড়ি থেকে বার হওয়া আর ফেরার মধ্যে কেটে যাবে দু–তিনটে দিন৷ দিন মজুরির টাকাটাও তাঁদের জুটবে না৷ পরিবারে অভাব, কারও বা জুটবে শাসকদলের আক্রমণ, হুমকি৷ তবু কেন এসেছেন তাঁরা? তাঁরা এসেছেন এক অমোঘ আদর্শের টানে৷ যে আদর্শ এমএলএ–এমপি মন্ত্রীত্বের তোয়াক্কা করে না, মানুষকে স্বপ্ন দেখায়–পথ দেখায় নতুন সমাজের৷
রানি রাসমণি রোডে মিছিল যখন পৌঁছেছে, দিনের আলো ততক্ষণে অস্তমিত প্রায়৷ কিন্তু ক্লান্ত পায়ে হেঁটে চলা মানুষগুলির মুখে জ্বলে উঠেছে এই বিশাল জনসমুদ্রের ঢেউয়ে জেগে থাকা এক উজ্জ্বল আলোর দীপ্তি৷ তাঁরা ফিরে গেলেন, কিন্তু রেখে গেলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আরও দৃঢ়বদ্ধ এক নতুন অঙ্গীকার৷ মহামিছিল হুঁশিয়ারি দিল সরকারকে, দাবি না মানলে জনগণ ছাড়বে না৷