রাজস্থানের বিজেপি সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামী বাল গঙ্গাধর তিলককে ‘সন্ত্রাসবাদের জনক’ দাগা দিয়ে ক্লাস এইটের পাঠ্যবইয়ে অর্ন্তভুক্ত করেছে!
বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশে স্কুলে হাজিরার সময় ‘উপস্থিত’, ‘প্রেজেন্ট প্লিজ’ এর পরিবর্তে ‘জয়হিন্দ’ বলার ফতোয়া জারি হয়েছে৷ সম্প্রতি এনসিইআরটি নতুন পাঠ্যবই চালু করেছে, যাতে ইতিহাসের নানা বিকৃতি ঘটানো হয়েছে এবং দেশপ্রেমের নামে হিন্দুত্ববাদের জয়গান গাওয়া হয়েছে৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির জয়কে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে দ্বাদশ শ্রেণির এই বইতে৷ বইয়ের ‘কমিউনালিজম, সেকুলারিজম, ডেমোক্রেসি’ চ্যাপ্টারে পড়ানো হচ্ছে, ১৯৮৬ সালের পর থেকে বিজেপি কীভাবে আদর্শগতভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উপর জোর দিয়েছে তার বিশ্লেষণ৷ বইয়ের পাতায় পাতায় বিজেপি ও আরএসএসের হিন্দুত্ববাদ নিয়ে প্রচার রয়েছে৷
‘২০০২ গুজরাট দাঙ্গা’ চ্যাপ্টারে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে, গুজরাটের বিজেপি সরকারের দাঙ্গা মোকাবিলায় অপ্রীতিকর বিষয় অর্থাৎ মুসলিম নিধন যাতে সামনে চলে না আসে তা বোঝানোর জন্য৷ স্কুলে প্রার্থনার সময় সরস্বতী বন্দনা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বহু স্থানে৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে জাতীয় পতাকা কত ফুট উচ্চতার হবে, তাও ঠিক করে দিয়েছিল বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষামন্ত্রক৷
সরকারের এই হিন্দুত্ববাদ প্রচারের মধ্য দিয়ে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন বুদ্ধিজীবীরা৷ তাঁরা পাঠ্যবইয়ে ইতিহাসের বিকৃতি এবং হিন্দুত্ববাদের অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদ করে বলেছেন, উচ্চশিক্ষায় বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাভাবনা গড়ে ওঠার পথে বাধা সৃষ্টি করবে এই সিলেবাস৷ এই দুইয়ের মধ্যে অশুভ যোগসূত্র রয়েছে৷ শুধু তাই নয়, চরম সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী ধ্যানধারণা প্রচার করে শিক্ষার্থীদের সুকুমার মনে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি ঘৃণা বদ্ধমূল করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে৷ চলছে গৌরবময় ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামকে খাটো করে দেখানোর জঘন্য ষড়যন্ত্র৷
কেন এই অপচেষ্টা? আসলে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিজেপি–আরএসএসের গুরু জনসঙেঘর ভূমিকা অত্যন্ত ঘৃণ্য৷ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর মরণপণ লড়াই, তাদের চোখে স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল না৷ আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলিতে জনসঙেঘর নেতারা ব্রিটিশের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য দেখিয়ে গেছেন৷ এ দেশের জনসাধারণের মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে আবেগ থাকার কারণে নিজেদের ঘৃণ্য ভূমিকা থেকে তাদের দৃষ্টি ঘোরাতেই এই কৌশল৷ এর সাথে সাথে আধুনিক, বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তার প্রসারের পরিবর্তে তাঁরা হিন্দুত্ববাদী ভাবধারার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ বস্তাপচা পুরনো চিন্তাভাবনা মানুষের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে পুরাণ–বেদ–উপনিষদের যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন আজকের ছাত্র–যুবসমাজকে৷ চাইছেন তাদের মধ্যে যাতে যুক্তিবাদ গড়ে না ওঠে, শুধুমাত্র অন্ধবিশ্বাস তাদের চিন্তার ভিত্তিমূল হয়, তাহলে শাসকদের অপকর্ম নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠবে না৷ সেই উদ্দেশ্য পূরণের সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক মানসিকতার প্রসার ঘটিয়ে মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে শোষক–শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে তাদের একজোট হতে বাধা দেওয়ার লক্ষ্যেই স্কুল সিলেবাসে ইতিহাসের বিকৃতি, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অবদানকে খাটো করার চেষ্টা, তার জন্যই দেশপ্রেমের নামে উগ্র হিন্দুত্ববাদের জোয়ার সৃষ্টির চেষ্টা করছে তারা৷
আদর্শগতভাবে দেউলিয়া বিজেপি–আরএসএসের এই রাজনীতি প্রতিহত করতে পারে মানুষের ঐক্যবদ্ধ শক্তি৷ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যারা বিজেপির এই অশুভ প্রচেষ্টাকে আদর্শগতভাবে প্রতিহত করার কথা ভাবছেন, যুক্তি–চিন্তা রহিত এই অন্ধতার পরাজয় চাইছেন, ধর্ম–বর্ণ–জাতিগত বিভাজনের মাধ্যমে সমাজে ধনী–গরিবের বৈষম্য সৃষ্টিকারী বিজেপির মধ্যে অনিবার্য বিপদ দেখছেন, যুক্তি–বুদ্ধি দিয়েই তাঁদের এর মোকাবিলা করতে হবে৷ ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার চর্চার প্রসারের দ্বারাই এর মোকাবিলা যথাযথভাবে করা সম্ভব৷
(৭০ বর্ষ ৪১ সংখ্যা ১জুন, ২০১৮)