যুগ যুগ ধরে চলে আসা মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণের অবসান কীভাবে হতে পারে তার বাস্তব ও বৈজ্ঞানিক পথ দেখিয়েছিলেন বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ কার্ল মার্কস৷ তাই কার্ল মার্কস হয়েছিলেন শোষক শাসকের সব থেকে ঘৃণিত শত্রু এবং ত্রাস৷ আবার তিনিই ছিলেন বিশ্বের মুক্তিপিপাসু কোটি কোটি শোষিত–নিপীড়িত শ্রমজীবী জনগণের শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক, মুক্তিকামী মানুষের পথের দিশারী৷৫ মে সেই মহান কার্ল মার্কসের দ্বিশত জন্মবর্ষের পূর্তিতে আমরা যুগস্রষ্টা এই দার্শনিক ও মহান বিপ্লবীর প্রতি হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে গভীর শ্রদ্ধা জানাই৷ আমাদের মনে রাখতে হবে মার্কস সর্বাগ্রে একজন বিপ্লবী৷ মার্কসবাদ হচ্ছে বিপ্লবের দর্শন৷
তখন ইডরোপে এক যুগসন্ধিক্ষণ৷ রেনেশাঁ আর গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিঘাতে রাজতন্ত্র ভেঙে পড়ছে৷ জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে চলছে ভাঙাগড়া৷ শিল্পবিপ্লবের পথ বেয়ে গড়ে উঠেছে পুঁজিবাদ, বদলে যাচ্ছে সমাজের শ্রেণিবিন্যাস৷ একদিকে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের হাতে বিপুল অর্থের পাহাড়, অপর দিকে যাদের শ্রম আর ঘাম রক্তের বিনিময়ে সমাজের সকল সম্পদের সৃষ্টি, সভ্যতার স্রষ্টা সেই শ্রমিকরাই তলিয়ে যাচ্ছে ক্ষুধা আর দারিদ্রের অতল গহ্বরে৷ জন্ম নিচ্ছে এক নতুন শ্রেণি– তারা সর্বহারা, শ্রমশক্তি বিক্রি করা ছাড়া যাদের বাঁচার আর কোনও উপায় নেই৷ জার্মানিতে, এমনই এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র মার্কস দেখেছেন, রাজতন্ত্রের সীমাহীন অত্যাচার, জার্মানির পুঁজিপতিদের দ্বারা আঙুর চাষিদের নিষ্ঠুর শোষণ, কয়লা খনির শ্রমিকদের জীবনযন্ত্রণা৷ তখনতাঁর মনে প্রশ্ন–– পড়ব কেন, জ্ঞান অর্জন করব কেন? এই প্রশ্ন তাঁর চিন্তাজগতকে নাড়িয়ে দিল৷ তিনি বুঝলেন, জ্ঞান চর্চার লক্ষ্য একটাই এবং তা হল শোষণ অত্যাচার থেকে মানবমুক্তির জন্য দুঃসহ দারিদ্রের উৎস সন্ধান করা, মুক্তির পথ অন্বেষণ ও নির্মাণ করা৷
মার্কস বললেন, ধর্মীয় মহাপুরুষদের সাম্যের কল্পনায় ছিল স্বর্গলাভের পর দারিদ্র ও ক্ষুধা থেকে মুক্তির উপায়৷ মার্কস দেখালেন, তা বাস্তবের মাটিতেই সম্ভব যদি সমাজ পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক নিয়ম বুঝে সঠিক পথে চেষ্টা করা যায়৷ বৈজ্ঞানিক পথে সমাজতন্ত্র তথা সামাজিক মালিকানায় উৎপাদন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যাবে যদি, যারা শোষণের কারণেই ব্যক্তিসম্পত্তি হারিয়েছে, সেই সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে বিপ্লবের দ্বারা পুঁজিপতি শ্রেণিকে তাদের রাষ্ট্রযন্ত্রসহ ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে সর্বহারা শ্রেণির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়৷
১৮৪৪ সালে মার্কসবাদ গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় তাঁর সঙ্গে মহান এঙ্গেলসের পরিচয়, যা থেকে গড়ে ডঠেছিল আদর্শগত ঐক্য, পরস্পরের গুণের প্রতি শ্রদ্ধাকে ভিত্তি করে দুজনের এক অনন্যসাধারণ বন্ধুত্ব, যা মার্কসকে তাঁর জীবনসংগ্রামের প্রতি পদে নানাভাবে সাহায্য করেছিল৷ এই চিন্তা ও কর্মের ঐক্যের ভিত্তিতে পুঁজির শোষণে জর্জরিত, বিভ্রান্তির আবর্তে দিশাহীন শ্রমিক শ্রেণিকে মার্কস–এঙ্গেলস পথ দেখানোর কাজে আত্মনিয়োগ করলেন৷ ১৮৪৮ সালে তাঁরা মিলিতভাবে লিখলেন শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে সমাজ পরিবর্তনের ঐতিহাসিক ঘোষণা– ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’৷ বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণির উদ্দেশে ডাক দিলেন –‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’৷ জ্ঞানের বিকাশের ধারাবাহিকতায় সমাজে গড়ে ওঠা ধারণাগুলি দ্বন্দ্বমূলক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিচার করে সারাংশটুকু নিয়ে এবং পুরনো ধারণার সঙ্গে ছেদ ঘটিয়ে, সংযোজিত করে জন্ম নিল অমোঘ হাতিয়ার ‘মার্কসবাদ’৷ শ্রমিক শ্রেণির শোষণমুক্তির সংগ্রাম নতুন দিশা এবং গতি পেল৷
এই বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে তোলার চেষ্টায় বারবার মার্কসকে গ্রেপ্তার, এক দেশ থেকে আরেক দেশে বহিষ্কার করা হয়৷ ফলে কপর্দকশূন্য হয়ে, অর্ধাহারে অনাহারে তিনি দিন কাটাতে বাধ্য হন৷ প্রায় বিনা চিকিৎসায় তাঁর সন্তানদের ও স্ত্রী জেনির মৃত্যু হয়৷ কিন্তু এসব কোনও কিছুতেই তিনি তাঁর মহান সংগ্রামের নিষ্ঠা ও একাগ্রতা থেকে চ্যুত হননি, মৃত্যুর দিন পর্যন্ত এক অনন্য সংগ্রাম করে গেছেন৷ যে সংগ্রামের কাহিনী মুক্তিকামী মানুষ যুগ যুগ ধরে স্মরণ করবে৷ অসুস্থতা উপেক্ষা করে মার্কস পুঁজির শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী জনগণের মুক্তিসংগ্রামের আদর্শগত ও তত্ত্বগত ভিত্তি গড়ে দিতে রচনা করেছিলেন মহাগ্রন্থ ‘ক্যাপিটাল’৷ ১৮৬৩ সালে তিনি গড়ে তুলেছিলেন মার্কসবাদ ও সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শ প্রচারের হাতিয়ার ‘প্রথম আন্তর্জাতিক’৷ এর ফলে ঊনবিংশ শতকের শেষ দশক এবং বিংশ শতকের শুরুতেই দেশে দেশে মার্কসবাদী আন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি হল৷ তাঁরই চিন্তাকে হাতিয়ার করে মহান লেনিন ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় নভেম্বর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করলেন৷ সেই পথ ধরে সমাজতন্ত্রকে অসামান্য বিকাশের পথে নিয়ে গেলেন মার্কস–লেনিনের অনুগামী মহান স্তালিন৷ রাশিয়ায় সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের অভূতপূর্ব বিকাশ দেখে মুগ্ধ এবং গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন বিশ্বের অগ্রগণ্য সমস্ত মনীষী৷ মার্কসবাদ সম্বন্ধেও তাঁরা হয়ে উঠেছিলেন শ্রদ্ধাশীল৷ বিংশ শতক জুড়ে তারই পথ অনুসরণ করে চীন সহ আরও বহু দেশে শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল৷
গভীর দুঃখের বিষয়, আজ সাম্রাজ্যবাদ এবং আধুনিক সংশোধনবাদের ষড়যন্ত্রে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র এবং সমাজতান্ত্রিক শিবির অবলুপ্ত৷ কিন্তু তাতে মার্কসবাদ ভুল প্রমাণিত হয়নি৷ মার্কসবাদ একটি বিজ্ঞান বলেই নানা নতুনতর এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রয়োগের দ্বারা তা ক্রমাগত বিকশিত হয়েছে৷ বর্তমান পুঁজিবাদের চরম সংকটের যুগে পুঁজিবাদের বিপ্লবভীতির ফল হিসাবে জন্ম নেওয়া মানবতার ঘৃণ্যতম শত্রু ফ্যাসিবাদের চরিত্র ও রূপ, পুঁজিবাদের বিকাশের পথে ব্যক্তিবাদের উদ্ভব এবং বিকাশের নিয়ম, পুঁজিবাদের মরণোন্মুখ বর্তমান দশায় সৃষ্ট ব্যক্তিবাদ কী নিকৃষ্ট রূপ নিয়েছে, যা মানুষকে সমাজবিমুখ ও আত্মস্বার্থ–সর্বস্ব করে দিচ্ছে, যা কমিডনিস্ট চরিত্র গড়ে ওঠার পথে প্রধান বাধা, সমাজতান্ত্রিক সমাজের অভ্যন্তরেও তা কীভাবে ক্রিয়া করেছে, মার্কসীয় পদ্ধতিতে এসবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে মার্কসবাদী জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন মার্কস–এঙ্গেলস–লেনিন-স্তালিন-মাও সে তুং–এর ছাত্র এ–যুগের অগ্রগণ্য মার্কসবাদী মহান চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ৷ তাঁর শিক্ষা থেকেই আমরা জানি, এ যুগের সর্বোন্নত বৈপ্লবিক আদর্শ হিসাবে মার্কসবাদের প্রাণসত্তা নিহিত রয়েছে তার উন্নত সংস্কৃতি ও নৈতিক মানদণ্ডের মধ্যে৷ উন্নত সাংস্কৃতিক ও নৈতিক মান অর্জন করা ব্যতিরেকে যথার্থ মার্কসবাদী হওয়া যায় না৷ মহান মার্কসের ঐতিহাসিক চিন্তা মার্কসবাদ এভাবেই ক্রমান্বয়ে উন্নত ও সমৃদ্ধ হয়ে বিশ্বকে মানব মুক্তির পথ দেখাচ্ছে৷ আমরা শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত জনসাধারণ সমস্ত বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার থেকে মুক্ত হয়ে মার্কসবাদের এই মহান চিন্তা ও মার্কসের জীবনকে অনুসরণের প্রচেষ্টায় রত থাকতে চাই৷ মহান মার্কস–এর জন্মের দ্বিশত বর্ষ পূর্তিতে আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার–ভারতের ও দুনিয়ার শোষিত শ্রেণির মুক্তি আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে প্রত্যেকে সাধ্যমতো যথাযথ ভূমিকা পালন করব৷
(৭০ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ২৭ এপ্রিল, ২০১৮)