মহান ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের শিক্ষা থেকে

বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা, পথপ্রদর্শক ও দার্শনিক ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের ১২৯তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ১২ আগস্ট দলের শিবপুর সেন্টারে মহান এঙ্গেলসের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন এসইউসিআই(সি)-র সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ।

এ বছর ৫ আগস্ট ছিল বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের অন্যতম পথপ্রদর্শক ও মহান নেতা ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের ১২৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। এই উপলক্ষে তাঁর ‘সমাজতন্ত্রঃ কাল্পনিক ও বৈজ্ঞানিক’ রচনা থেকে একটি অংশ প্রকাশ করা হল।

… পণ্য উৎপাদনের প্রসার এবং বিশেষ করে পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতি প্রবর্তনের সাথে সাথে পণ্য উৎপাদনের নিয়মগুলি যা এতদিন সুপ্ত ছিল, তা আরও খোলাখুলি আরও বেশি শক্তি নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠল। পুরনো বন্ধনগুলো আলগা হয়ে গেল, বিচ্ছিন্নতার পুরনো সীমা ভেঙে পড়ল, উৎপাদকরা আরও বেশি বেশি করে স্বাধীন স্বতন্ত্র পণ্য উৎপাদকে রূপান্তরিত হল। এ সত্য পরিষ্কার হয়ে গেল যে, সমাজের সমগ্র উৎপাদনে এতদিন রাজত্ব করেছে পরিকল্পনাহীনতা, আকস্মিকতা ও নৈরাজ্য এবং এই নৈরাজ্য ক্রমেই আরও ব্যাপক ও চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। কিন্তু যে প্রধান উপায়ের সাহায্যে পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতি সমাজীকৃত উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই নৈরাজ্যকে তীব্র করে তোলে, তা নৈরাজ্যের ঠিক বিপরীত। এই উপায়টি হল, উৎপাদনশীল প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একটা সামাজিক ভিত্তির উপর উৎপাদনের কাজ পরিচালনার উপযুক্ত এবং ক্রমান্বয়ে আরও মজবুত সংগঠন দাঁড় করানো।

এর ফলে পুরনো শান্তিপূর্ণ ও সুস্থির অবস্থার অবসান ঘটল। উৎপাদনের এই সংগঠন যেখানেই ও শিল্পের যে শাখাতেই প্রবর্তিত হল, সেখানেই উৎপাদনের অন্য কোনও পদ্ধতিকে সে বরদাস্ত করল না।

শ্রমক্ষেত্র একটি রণক্ষেত্রে পরিণত হল। বিরাট বিরাট ভৌগোলিক আবিষ্কার এবং তার পরে পরেই সেই সমস্ত দেশে উপনিবেশ স্থাপনের ফলে বাজার বহুগুণ বৃদ্ধি পেল এবং হস্তশিল্পের কারখানায় রূপান্তর ত্বরান্বিত করল। একটা বিশেষ অঞ্চলের বিভিন্ন উৎপাদকদের মধ্যেই কেবল যুদ্ধ সীমাবদ্ধ থাকল না, স্থানীয় স্তরের লড়াই থেকে সৃষ্টি হল জাতীয় স্তরের সংঘর্ষ– সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর বাণিজ্য-যুদ্ধ।

শেষ পর্যন্ত, আধুনিক শিল্প এবং বিশ্ব বাজারের উন্মোচনে এই সংগ্রাম হয়ে উঠল বিশ্বজনীন এবং একই সঙ্গে এতটাই বিষাক্ত যা ইতিপূর্বে শোনা যায়নি। এক একজন পুঁজিপতি তথা একটা গোটা শিল্প ও একটা দেশেরও অস্তিত্ব থাকা না-থাকার বিষয়টা এখন নির্ধারিত হতে থাকল উৎপাদনের স্বাভাবিক বা কৃত্রিম পরিস্থিতির সুবিধার দ্বারা। এই লড়াইয়ে যে হেরে গেল, নির্দয়ভাবে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হল। এটা হয়ে দাঁড়াল ব্যক্তির অস্তিত্বরক্ষার সেই ডারউইনীয় সংগ্রাম; শুধু তার ক্ষেত্রটা স্থানান্তরিত হল প্রকৃতি থেকে সমাজে এবং তার সঙ্গে যুক্ত হল চূড়ান্ত রকমের হিংসা। অস্তিত্বের যে শর্তগুলি প্রাণীজগতের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক, সেগুলিই যেন হয়ে দাঁড়াল মানবজাতির বিকাশের শেষ কথা। সমাজীকৃত উৎপাদনের সাথে পুঁজিবাদী দখলদারির বিরোধ এখন এক একটা কারখানায় উৎপাদনের সংগঠন ও সাধারণভাবে সমাজ অভ্যন্তরে উৎপাদনের নৈরাজ্যের মধ্যে বিরোধের রূপে প্রকাশ পেল।

পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতি একেবারে উদ্ভব থেকেই অন্তর্নিহিত এই দুই ধরনের বিরোধ সঙ্গে নিয়েই এগোচ্ছে। ওই ‘দুষ্ট চক্র’ থেকে তা কখনওই বেরিয়ে আসতে পারেনি। ফ্যুরিয়ে অনেক দিন আগেই এই সত্য উদঘাটন করেছেন। অবশ্য, ফ্যুরিয়ে তাঁর সময়ে যেটা দেখে যেতে পারেননি তা হল, এই চক্র ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে; গ্রহপুঞ্জের গতির মতোই এই চক্রের গতিও ক্রমেই আরও সর্পিল হয়ে কেন্দ্রের দিকে এগুচ্ছে এবং একটা সময় কেন্দে্রর সঙ্গে সংঘর্ষে তার বিনাশ অনিবার্য। সামাজিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে নৈরাজ্যের অমোঘ শক্তি বিপুল অংশের মানুষকে আরও বেশি বেশি করে পুরোপুরি সর্বহারায় পরিণত করছে এবং এই ব্যাপক সর্বহারা জনগণই শেষপর্যন্ত উৎপাদনের ক্ষেত্রে নৈরাজ্যের অবসান ঘটাবে। সামাজিক উৎপাদনে নৈরাজ্যের অমোঘ শক্তিতেই আধুনিক শিল্পে যন্ত্রের সীমাহীন উন্নয়ন পরিণত হচ্ছে এক আবশ্যিক নিয়মে, যে নিয়ম প্রত্যেক শিল্পপতিকে বাধ্য করছে তার তার যন্ত্রকে ক্রমাগত আরও উন্নত করতে। অন্যথায় ধবংস অনিবার্য।

কিন্তু, যন্তে্রর উন্নয়ন মানুষের শ্রমকে অনাবশ্যক করে তুলছে। যন্তে্রর প্রবর্তন এবং তার সংখ্যাবৃদ্ধির অর্থ যদি হয় মুষ্টিমেয় মেশিন-শ্রমিকের দ্বারা লক্ষ লক্ষ কায়িক শ্রমিকের কর্মচ্যুতি, তা হলে যন্তে্রর উন্নতির অর্থ হচ্ছে, ক্রমান্বয়ে যন্ত্রে কাজ করা শ্রমিকদেরও অপসারণ। পরিণামে এর অর্থ দাঁড়ায় পুঁজির গড়পড়তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত একদল সহজপ্রাপ্য বাড়তি মজুরি-শ্রমিক সৃষ্টি করা– ১৮৪৫ সালে যাকে আমি বলেছিলাম শিল্পের জন্য একটা পরিপূর্ণ মজুত বাহিনী গড়ে তোলা, শিল্পে কাজের চাপ বাড়লে এই বাহিনীকে যেমন কাজে লাগানো যাবে, তেমনি শিল্পে অনিবার্য ধস নেমে এলে রাস্তায় ছুঁড়েও ফেলে দেওয়া যাবে। এরা পুঁজির বিরুদ্ধে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে নিয়োজিত শ্রমিকশ্রেণির কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া এক নিরন্তর গুরুভার, পুঁজির স্বার্থে শ্রমিকদের মজুরির হার কমিয়ে রাখতে পারার মতো এক নিয়ন্ত্রক। এইভাবে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, মার্ক্সের ভাষায়, সেখানে যন্ত্রই হয়ে দাঁড়ায় শ্রমিকশ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামে পুঁজির হাতে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার, শ্রমের যন্ত্র প্রতিনিয়ত শ্রমিকের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় তার জীবিকা নির্বাহের উপায়। যেটা শ্রমিকই তৈরি করেছে, সেটাই হয়ে দাঁড়ায় শ্রমিককে অধীনস্থ করার হাতিয়ার। এর ফলে যা ঘটে, সেটা হল শ্রমের হাতিয়ারের সীমিত ব্যবহারের পথ ধরে শুরু থেকেই একইসাথে শ্রম শক্তির চূড়ান্ত বেপরোয়া অপচয় ঘটতে থাকে। যে স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে শ্রমিকদের কাজ করতে হয় তার ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায় লুণ্ঠন। শ্রমের সময়কে সংক্ষিপ্ত করার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার যে যন্ত্র, তা পরিণত হয় শ্রমিক ও তার পরিবারের প্রতিটি মুহূর্তকে মালিকের হাতে তুলে দিয়ে তার পুঁজির মূল্য বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে অব্যর্থ উপায়ে। এই ভাবে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে যেটা ঘটে, তা হল, কিছু মানুষের বাড়তি কাজের বোঝা বাকিদের কর্মহীনতার প্রাথমিক শর্ত হয়ে দাঁড়ায়। আধুনিক শিল্প যা নতুন নতুন ক্রেতার খোঁজে গোটা বিশ্বে ছুটে বেড়ায়, তা দেশের অভ্যন্তরে বেশির ভাগ মানুষকে অর্ধভুক্ত অভুক্ত অবস্থার শেষ ধাপে ঠেলে দিয়ে তাদের ক্রয়ক্ষমতাকে একেবারে নিঃশেষ করে দেয় এবং এ ভাবে তার নিজের দেশীয় বাজারকে ধবংস করে।

‘পুঁজির পুঞ্জিভবনের ব্যাপ্তি ও শক্তির সাথে আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত জনসমষ্টির, বা শিল্পের মজুত বাহিনীর ভারসাম্য যে নিয়মের দ্বারা সর্বদা রক্ষিত হয়, সেই নিয়ম শ্রমিককে পুঁজির সঙ্গে বেঁধে রাখে প্রমিথিউসকে যত শক্ত করে ভালকানের কীলক দিয়ে পাহাড়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল, তার চেয়েও অনেক বেশি শক্ত করে। এই অবস্থায় পুঁজি সঞ্চয়ের পাশাপাশি দুঃখদুর্দশারও সঞ্চয় ঘটে। সে কারণে, এক মেরুতে যখন সম্পদ জমা হয়, তখন একই সময়ে বিপরীত মেরুতে, অর্থাৎ যে শ্রেণি স্বীয় উৎপন্নকে উৎপাদন করছে পুঁজির আকারে, তাদের জীবনে জমা হতে থাকে দুঃখ-দুর্দশা, শ্রম-যন্ত্রণা, দাসত্ব, অজ্ঞতা, পাশবিকতা, নৈতিক অধঃপতন’’ (মার্ক্সের ক্যাপিটাল)। পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতি থেকে উৎপাদিত দ্রব্যের অন্য কোনও রকম বণ্টন আশা করা, আর বিদ্যুৎবাহী তার (ইলেকট্রোডস) যতক্ষণ ব্যাটারির সঙ্গে যুক্ত আছে, ততক্ষণ সে অ্যাসিড মেশানো জলকে বিশ্লিষ্ট করবে না, তার ধনাত্মক প্রান্ত থেকে অক্সিজেন, ঋণাত্মক প্রান্ত থেকে হাইড্রোজেন ছাড়বে না– এমনটা আশা করা একই কথা।

আমরা দেখেছি, সামাজিক উৎপাদনের নৈরাজ্যের কারণে আধুনিক শিল্পযন্ত্রের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নশীলতা এক আবশ্যিক নিয়মে পরিণত হয়েছে এবং এই নিয়ম এক একজন শিল্পপতিকে বাধ্য করছে তার যন্ত্রপাতি সর্বদা আরও উন্নত করতে, তার উৎপাদন ক্ষমতা ক্রমাগত আরও বাড়িয়ে যেতে। উৎপাদন ক্ষেত্রের সম্প্রসারণের সম্ভাবনাটাও তার কাছে অনুরূপ একটি বাধ্যতামূলক নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। আধুনিক শিল্পের বিশাল সম্প্রসারণ শক্তির কাছে গ্যাসের সম্প্রসারণ শক্তিকে মনে হয় নিছক ছেলে খেলা। গুণগত ও পরিমাণগত উভয়ক্ষেত্রে এই সম্প্রসারণ একটা প্রয়োজন হিসাবেই আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। যা কোনও বাধাকেই পরোয়া করে না। এই বাধা আসে উপভোগ থেকে, বিক্রি থেকে আধুনিক শিল্পজাত দ্রব্যের বাজার থেকে। কিন্তু ব্যাপ্তি ও গভীরতার দিক থেকে বাজারের সম্প্রসারণ ক্ষমতা মূলত নিয়ন্ত্রিত হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু নিয়মের দ্বারা– যার তেজ অনেক কম সক্রিয়তা নিয়ে কাজ করে।

উৎপাদন বৃদ্ধির গতির সঙ্গে বাজারের সম্প্রসারণ তাল রাখতে পারে না। সংঘাত অনিবার্য হল ওঠে এবং যতদিন না পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতিকে ভেঙে চূর্ণ করে দেওয়া হলে তত দিন যেহেতু এর মধ্য থেকে কোনও প্রকৃত সমাধান বেরিয়ে আসতে পারে না, তাই সংঘাত পর্যায়ক্রমে মাথাচাড়া দিতে থাকে। পুঁজিবাদী উৎপাদন জন্ম দেয় আরও এক ‘দুষ্ট চক্রের’।