২০২০ সালের ২৮ নভেম্বর বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ সারা দেশের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে ইংরেজিতে একটি আলোচনা করেন যা অনলাইনে সম্প্রচারিত হয়। ৫ আগস্ট মহান এঙ্গেলসের ১২৬তম মৃত্যুদিবস উপলক্ষে সেই ইংরেজি আলোচনাটির বঙ্গানুবাদ ধারাবাহিকভাবে আমরা প্রকাশ করছি। অনুবাদে কোনও ভুলত্রুটি থাকলে তার দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমাদের। এবার সপ্তম ও শেষ পর্ব। – সম্পাদক, গণদাবী
(৭)
পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি
‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’-র প্রথম সংস্করণের (১৮৮৪) ভূমিকায় এঙ্গেলস এই মূল্যবান বইটি মার্কসের উত্তরাধিকারের পরিপূরক হিসাবে উপস্থাপিত করলেন। এই বইয়ে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে মানব সভ্যতার ইতিহাসের পর্যায়ক্রমিক স্তরের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা রয়েছে। আমি শুধু তার থেকে কিছু অংশ উল্লেখ করব।
‘‘মর্গান তাঁর নিজের ধরনে আমেরিকায় একই বস্তুবাদী ধারণার পুনরাবিষ্কার করেন যা মার্কস ৪০ বছর আগেই আবিষ্কার করেছিলেন এবং বর্বরতা ও সভ্যতার তুলনামূলক বিচারে ওই ধারণা থেকে তিনি প্রধান প্রধান বিষয়ে মার্কসের মতো একই সিদ্ধান্তে পৌঁছান।”
‘‘বস্তুবাদী ধারণা অনুযায়ী শেষ বিচারে ইতিহাসের নির্ধারক উপাদান হচ্ছে প্রত্যক্ষ জীবনের উৎপাদন এবং পুনরুৎপাদন। কিন্তু এই ব্যাপারটির প্রকৃতি দ্বিবিধ। একদিকে জীবনযাত্রার উপকরণ– খাদ্য, পরিধেয় ও আশ্রয় এবং সেইজন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির উৎপাদন; অপর দিকে মানবজাতির জৈবিক উৎপাদন, বংশবৃদ্ধি।”
এখন আমি কিছু অংশ পড়ব যেখানে এঙ্গেলস আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেখিয়েছেন রাষ্ট্র সব সময় ছিল না। এর একটা শুরু এবং শেষ আছে। মানবসভ্যতার একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে যখন মানবসমাজ শ্রেণিবিভক্ত হয়েছিল, তখন এর উদ্ভব ঘটেছিল। যখন রাষ্ট্রের চিরস্থায়ী ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে এঙ্গেলস এই বইটি লেখেন, তখন তা শুধু সম্পূর্ণ নতুন কিছু ছিল তাই নয়, ছিল বিপ্লবাত্মক। তিনি বলেছিলেন–
‘‘যেহেতু রাষ্ট্রের আবির্ভাব শ্রেণি-বিরোধকে সংযত করার প্রয়োজন থেকে এবং যেহেতু একই সঙ্গে তার উদ্ভব হয় শ্রেণি-বিরোধের মধ্যেই, সেজন্য রাষ্ট্র হল সাধারণত সবচেয়ে শক্তিশালী ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রভুত্বকারী শ্রেণির রাষ্ট্র, এই শ্রেণি রাষ্ট্রের মাধ্যমে রাজনীতির ক্ষেত্রেও আধিপত্যকারী শ্রেণি হয়ে ওঠে এবং এ ভাবে নিপীড়িত শ্রেণির দমন-শোষণে নতুন হাতিয়ার লাভ করে। এইভাবে প্রাচীন রাষ্ট্র সর্বোপরি ছিল ক্রীতদাসদের দমনের জন্য দাস-মালিকদের রাষ্ট্র, যেমন সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল ভূমিদাস কৃষক ও ক্রীতদাসদের বশে রাখার জন্য অভিজাতদের সংস্থা এবং আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্র হচ্ছে পুঁজি কর্তৃক মজুরি-শ্রম শোষণের হাতিয়ার।”
‘‘অতএব চিরকাল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল না। এমন সব সমাজ ছিল যারা রাষ্ট্র ছাড়াই চলত, যাদের রাষ্ট্র অথবা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কোনও ধারণাই ছিল না। অর্থনৈতিক বিকাশের একটা বিশেষ স্তরে যখন অনিবার্যভাবে সমাজে শ্রেণি-বিভাগ এল, তখন এই বিভাগের জন্যই রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল। এখন আমরা দ্রুত গতিতে উৎপাদনের বিকাশের এমন একটি স্তরে পৌঁছাচ্ছি, যখন এইসব বিভিন্ন শ্রেণির অস্তিত্ব আর শুধু যে অবশ্যপ্রয়োজনীয় থাকবে না তাই নয়, বরং তা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে উঠবে। আগেকার স্তরে যেমন অনিবার্যভাবে তাদের উদ্ভব হয়েছিল, তেমনি অনিবার্যভাবে তাদের পতন হবে। তাদের সাথে সাথে রাষ্ট্রেরও অনিবার্যভাবে পতন হবে। উৎপাদকদের স্বাধীন ও সমান যোগদানের ভিত্তিতে যে সমাজ উৎপাদন সংগঠিত করবে, সে সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রকে পাঠিয়ে দেবে তার যোগ্য স্থানেঃ পুরাতত্তে্বর যাদুঘরে, চরকা ও ব্রোঞ্জের কুড়ুলের পাশে।”
প্রাচীন খ্রিস্টধর্মের ইতিহাস প্রসঙ্গে
১৮৯৪ সালে এঙ্গেলস ‘প্রাচীন খ্রিস্টধর্মের ইতিহাস প্রসঙ্গে’ নামে তাঁর বিখ্যাত বইটি লিখেছিলেন। এই বইয়ে তিনি ধর্ম ও সাম্যবাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা ও উদ্দেশ্য এবং এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করেছেন।
‘‘ … সূচনায় খ্রিস্টধর্ম ছিল নিপীড়িত মানুষের একটি আন্দোলনঃ রোমের শাসকদের অধীনস্থ বা তাদের কারণে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়া সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত দাস ও গরিব মানুষের ধর্ম হিসাবে প্রথম এর উদ্ভব হয়েছিল। খ্রিস্টধর্ম ও শ্রমিকদের সাম্যবাদ উভয়ই দাসত্ববন্ধন ও দুর্দশা থেকে ভবিষ্যতমুক্তির কথা প্রচার করে। খ্রিস্টধর্ম এই মুক্তির সন্ধান দেয় জীবনের শেষে মৃত্যুর পরে– স্বর্গে গিয়ে। আর সমাজতন্ত্র সমাজ পরিবর্তনের দ্বারা এই মাটিতেই তা স্থাপন করতে চায়। উভয়কেই নির্যাতন করা হয়, প্রলোভন দেখানো হয়, উভয়ের অনুগতদের ঘৃণার চোখে দেখা হয় এবং উভয়কেই বহিষ্কারক আইনের লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়, প্রথমটিকে মানবজাতির শত্রু হিসাবে, পরেরটিকে রাষ্ট্রের শত্রু হিসাবে, ধর্ম, পরিবার, সমাজ-শৃঙ্খলার শত্রু হিসাবে।” (মার্কস-এঙ্গেলস অন রিলিজিয়ন, ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ পাবলিশিং হাউস, মস্কো, ১৯৫৭)
কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তেহার
এখন ১৮৪৮ সালে মার্কস ও এঙ্গেলসের যৌথভাবে লেখা ঐতিহাসিক পুস্তিকা ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তেহার’ থেকে আমি কিছু অংশ আপনাদের সামনে রাখব এটা দেখাতে যে আজও তা কতটা প্রাসঙ্গিক।
‘‘মানুষের যেসব বৃত্তিকে লোকে এতদিন সম্মান করে এসেছে, সশ্রদ্ধ বিস্ময়ের চোখে দেখেছে, বুর্জোয়া শ্রেণি তাদের মাহাত্ম্য ঘুচিয়ে দিয়েছে। চিকিৎসাবিদ, আইনবিশারদ, পুরোহিত, কবি, বিজ্ঞানী – সকলকেই এরা পরিণত করেছে তাদের মজুরি-ভোগী শ্রমজীবী রূপে।
পরিবারের ওপর থেকে সংবেদনশীল আবরণটি ছিঁড়ে ফেলে বুর্জোয়ারা পারিবারিক সম্পর্ককে পরিণত করেছে নিছক আর্থিক সম্পর্কে।”
‘‘নিজেদের তৈরি করা পণ্যের জন্য নিরন্তর প্রসারিত হতে থাকা বাজারের তাগিদ বুর্জোয়া শ্রেণিকে সারা পৃথিবীময় দৌড় করিয়ে বেড়ায়। সর্বত্র তাদের বাসা বাঁধতে হয়, সর্বত্র গেড়ে বসতে হয়, যোগসূত্র স্থাপন করতে হয় সর্বত্র।”
‘‘বিশ্ববাজারকে কাজে লাগাতে গিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণি প্রতিটি দেশের উৎপাদন ও ভোগকে একটা বিশ্বজনীন চরিত্র দিয়েছে।”
‘‘আজকের দিনে বুর্জোয়াদের মুখোমুখি যেসব শ্রেণি দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে শুধু সর্বহারা শ্রেণিই হল প্রকৃত বিপ্লবী শ্রেণি। সর্বহারা শ্রেণি যার বিশেষ ও অপরিহার্য সৃষ্টি, সেই আধুনিক শিল্পের সামনে পড়ে অন্য শ্রেণিগুলিতে ক্ষয় ধরে এবং শেষপর্যন্ত সেগুলি অদৃশ্য হয়ে যায়।”
‘‘অতীতে সমস্ত ঐতিহাসিক আন্দোলন ছিল সংখ্যালঘিষ্ঠদের আন্দোলন, কিংবা তাদের স্বার্থে আন্দোলন। সর্বহারা শ্রেণির আন্দোলন হল বিরাট সংখ্যাধিক্যের স্বার্থে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের আত্মসচেতন স্বাধীন আন্দোলন।”
‘‘বুর্জোয়া সমাজে পুঁজি হল স্বাধীন এবং তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আছে, কিন্তু জীবন্ত মানুষ হল অন্যের ওপর নির্ভরশীল এবং তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য নেই।”
‘‘আপনাদের ধারণাগুলি আপনাদের পুঁজিবাদী উৎপাদন ও পুঁজিবাদী মালিকানার শর্তগুলি থেকে উদ্ভূত, ঠিক যেমন আপনাদের আইনশাস্ত্র হল শুধুমাত্র আপনাদের শ্রেণি-ইচ্ছা যাকে সকলের জন্য আইন হিসাবে রূপ দেওয়া হয়েছে। এই ইচ্ছার মূল চরিত্র ও অভিমুখ নির্ধারিত হয় আপনাদের শ্রেণি-অস্তিত্বের অর্থনৈতিক শর্তগুলির দ্বারা।”
‘‘মেহনতি মানুষের কোনও দেশ নেই। তাদের যা নেই তা আমরা কেড়ে নিতে পারি না। সর্বহারা শ্রেণিকে যেহেতু সর্বাগ্রে রাজনৈতিক আধিপত্য অর্জন করতে হবে, জাতির নেতৃত্বকারী শ্রেণির পদে উঠতে হবে, নিজেকেই জাতি গঠন করতে হবে, তাই সেদিক থেকে সর্বহারা শ্রেণি নিজেই জাতীয়, যদিও কথাটার বুর্জোয়া অর্থে নয়।”
বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশ, বাণিজ্যের স্বাধীনতা, জগৎজোড়া বাজার, উৎপাদন-পদ্ধতি এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জীবনযাত্রার ধরনের অভিন্নতা– এই সবের জন্যই দেশে দেশে পার্থক্য ও মানুষে-মানুষে বিরোধ দিনের পর দিন ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে। সর্বহারা শ্রেণির মুক্তির অন্যতম প্রধান শর্ত হল মিলিত প্রচেষ্টা, অন্তত অগ্রণী সভ্য দেশগুলির মিলিত প্রচেষ্টা।
মানুষের ওপর মানুষের শোষণ আনুপাতিক হারে যত বন্ধ করা যাবে, এক দেশের ওপর অন্য দেশের শোষণ তত বন্ধ করা যাবে। একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে শ্রেণিগুলির মধ্যেকার বিরোধ আনুপাতিক হারে যত কমবে, এক রাষ্ট্রের অন্য রাষ্ট্রের ওপর শত্রুতার তেমনই অবসান হবে।”
‘‘বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে লড়াইয়ের ভিতর অবস্থার চাপে যদি সর্বহারা শ্রেণি নিজেকে শ্রেণি হিসাবে সংগঠিত করতে বাধ্য হয়, বিপ্লবের মাধ্যমে তারা যদি নিজেদের শাসক শ্রেণিতে পরিণত করে ও শাসক শ্রেণি হিসাবে উৎপাদনের পুরাতন ব্যবস্থাকে যদি ঝেঁটিয়ে বিদায় করে, তা হলে সেই পুরানো অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণিবিরোধের অস্তিত্বের শর্তগুলি তথা সব রকম শ্রেণির অস্তিত্বই ঝেঁটিয়ে বিদায় করবে এবং তাতে করে শ্রেণি হিসাবে তার নিজের আধিপত্যেরও অবসান ঘটবে।”
‘‘শ্রেণি ও শ্রেণিবিরোধ সংবলিত পুরানো বুর্জোয়া সমাজের জায়গায় আমরা পাব এক সমিতি, যেখানে সকলের স্বাধীন উন্নয়নের শর্ত হবে প্রত্যেকের স্বাধীন উন্নয়ন।”
‘‘কমিউনিস্টরা মতামত ও লক্ষ্য গোপন রাখতে ঘৃণা বোধ করে। তারা খোলাখুলি ঘোষণা করে যে, চলতি সামাজিক পরিস্থিতিকে সবলে উচ্ছেদ করার দ্বারাই কেবলমাত্র তাদের লক্ষ্য সাধিত হতে পারে। কমিউনিস্ট বিপ্লবের আতঙ্কে শাসক শ্রেণি কাঁপতে থাকুক। শৃঙ্খল ছাড়া প্রলেতারিয়েতের হারাবার কিছু নেই। জয় করবার জন্য আছে সারা দুনিয়া।”
শ্রমিক শ্রেণির সমকালীন আন্দোলনগুলির দিক নির্দেশ করেছিলেন মার্কস ও এঙ্গেলস
মার্কস এবং এঙ্গেলস তাঁদের সমকালীন শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনগুলির পথনির্দেশ দিয়েছিলেন। অনেক সময় নেবে বলে এই বিষয়টি আমি আলোচনায় আনিনি। সেই সময় ইউরোপে সামন্ততন্তে্রর বিরুদ্ধে বহু আন্দোলন ও সংগ্রাম চলছিল। বেশিরভাগ লড়াইগুলিতেই বুর্জোয়া এবং পেটিবুর্জোয়ারা নেতৃত্ব দিত। কিন্তু শ্রমিক এবং কৃষকরাও এই সংগ্রামগুলিতে অংশগ্রহণ করেছিল। শ্রমিক-কৃষকরা যাতে সেগুলিতে স্বাধীন ভূমিকা পালন করে, সে বিষয়ে তাদের পথ দেখাবার চেষ্টা করেছিলেন মার্কস ও এঙ্গেলস। ওই সংগ্রামগুলিতে মার্কস ও এঙ্গেলস সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁরা এক দেশ থেকে অন্য দেশে বিতাড়িত হয়েছিলেন এবং শেষপর্যন্ত ইংল্যান্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করেছিলেন। পিয়েরি জোসেফ প্রুধোঁ এবং লুই অগস্ট ব্লাঙ্কির মতো পেটিবুর্জোয়া নৈরাজ্যবাদীদের নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়ায় মার্কস ও এঙ্গেলস প্যারি কমিউনে নেতৃত্ব দিতে পারেননি। ১৮৬৪ সালে লন্ডনে গঠিত হয়েছিল প্রথম আন্তর্জাতিক। এতে বাকুনিন এবং লাসালে বিভেদপন্থা নিয়ে কাজ করতেন এবং ১৮৭৬ সালে তা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। ১৮৮৯ সালে যখন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক গঠিত হয়, সমাপ্তি অধিবেশনে এঙ্গেলসকে বক্তব্য রাখতে অনুরোধ করা হয়েছিল। বিপুল উদ্দীপনায় তাঁকে স্বাগত জানানো হয়েছিল। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘‘এই অভিনন্দন আমার জন্য নয়। এই অভিনন্দন, এখানে যাঁর ছবি রয়েছে তাঁর, অর্থাৎ মার্কসের জন্য।”
আট ঘন্টার কর্মদিবস-এর দাবিতে এঙ্গেলসের উদ্যোগেই ১৮৮৯ সালে ১মে দিনটি ‘শ্রমিক দিবস’ হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৮৯০ সালে প্রথম ‘মে দিবস’ পালন উপলক্ষে লন্ডনের বিশাল সমাবেশে অংশগ্রহণ করেছিলেন এঙ্গেলস এবং গভীর বেদনা নিয়ে সেখানে বলেছিলেন, ‘‘আজ যদি মার্কস আমার পাশে থেকে স্বচক্ষে এ দৃশ্য দেখতে পেতেন!” মহান মার্কসের অবর্তমানে কী গভীর বেদনাই না তিনি বহন করতেন!
মার্কসবাদী তত্ত্ব আপ্তবাক্য নয়, বরং তা একটি বিকাশশীল বিজ্ঞান
এবার আমি প্রশ্ন করি, এই ধরনের সভা এবং আমার এই আলোচনার উদ্দেশ্য কী? এটা কি নিছক একটা আনুষ্ঠানিকতা? নাকি এ আমাদের পণ্ডিতমন্যতার পরিতৃপ্তির জন্য? নিশ্চয়ই তা নয়। আমাদের দুই মহান শিক্ষকের একজনকে আমরা স্মরণ করছি তাঁর কাছ থেকে জানতে এবং শিখতে। মার্কসবাদের শিক্ষা যাকে পর্যায়ক্রমে মহান লেনিন, স্ট্যালিন, মাও সে তুঙ এবং পরবর্তীকালে কমরেড শিবদাস ঘোষ বিজ্ঞান হিসাবে আরও বিকশিত করেছেন, আমাদের কর্তব্য হল, তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। লেনিন যেমন বলেছেন,
‘‘মার্কসবাদী তত্ত্বকে আমরা সমাপ্তি ঘটে যাওয়া কোনও অলঙ্ঘনীয় বিষয় বলে মনে করি না, বরং আমরা নিশ্চিতভাবে বুঝি যে এটি বিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছে, জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চাইলে সমাজতন্ত্রীদের যেটিকে সমস্ত দিক থেকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।” (সিলেক্টেড ওয়ার্কস, ভল্যুম ১১)
আজ আমরা এমন একটি সময়ে এঙ্গেলসের স্মরণ দিবস উদযাপন করছি, যেখানে একদিকে সারা বিশ্বজুড়ে একটার পর একটা আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। সাধারণ মানুষের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ বিক্ষিপ্ত সংগ্রামের আকারে ফেটে পড়ছে। কিন্তু সেগুলিকে সঠিক পথে পরিচালনা করার মতো কোনও নেতৃত্ব নেই, কোনও আদর্শ নেই, কোনও সংস্কৃতি নেই, কোনও সংগঠন নেই। একটার পর একটা আন্দোলনের ঢেউ উঠছে, স্তিমিত হয়ে পড়ছে; আবার উঠছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে।
এ ক্ষেত্রেও আমি একটা অন্য বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এক সময় লেনিন বলেছিলেন,
‘‘এ ছাড়াও, বেশ কিছু রাষ্ট্র … পশ্চিমের পুরানো রাষ্ট্রগুলি, তাদের বিজয়ের কারণে … তাদের দেশের নিপীড়িত শ্রেণিগুলিকে অল্প-স্বল্প সুযোগ সুবিধা দিতে পেরেছে, যে কারণে সেই দেশগুলোতে বিপ্লবী আন্দোলনগুলো মন্থর করে দিতে পারছে এবং সাময়িক ‘সামাজিক শান্তি’ বজায় রাখতে পারছে … অন্যদিকে … প্রাচ্য দেশগুলি নিশ্চিতভাবে বিপ্লবী আন্দোলনের মধ্যে আসছে, নিশ্চিতভাবে তাদের বিশ্ববিপ্লবী আন্দোলনের সাধারণ সংগ্রামের ঘূর্ণাবর্তে টেনে আনা হচ্ছে।”
কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের মধ্যে, এ দেশ ও অন্য দেশের মধ্যে এমন পার্থক্য দেখতে পাচ্ছি না। এমনকি সবচেয়ে অগ্রসর দেশগুলোতে, আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোর মতো সাম্রাজ্যবাদী দেশে, এমনকি আধুনিক রাশিয়া এবং চিন– যারা প্রতিবিপ্লবের পর সাম্রাজ্যবাদী দেশে পরিণত হয়েছে, সর্বত্রই প্রবল সঙ্কট ও অসন্তোষ ফেটে পড়ছে।স্বাভাবিকভাবেই সমস্ত অগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া দেশেই বাস্তব পরিস্থিতি বিপ্লবের জন্য তৈরি, কিন্তু দুঃখজনকভাবে বিপ্লবের প্রস্তুতি অনুপস্থিত।
সকল দেশের শ্রেষ্ঠ মানুষেরা সমাজতন্ত্রকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন
মার্কস ও এঙ্গেলসের শিক্ষাকে হাতিয়ার করে লেনিনই সর্বপ্রথম রাশিয়ার মাটিতে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লব সফল করেছিলেন। লেনিন এবং তারপর স্ট্যালিনের নেতৃত্বে রাশিয়া একটা নতুন সভ্যতা গড়ে তুলেছিল, যাকে শুধু বিশ্বের সমগ্র শ্রমিক শ্রেণিই নয়, বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। রমাঁ রল্যাঁ, বার্নাড শ, আইনস্টাইনের মতো মহান মানুষ এবং আমাদের দেশের রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, সুব্রমণ্য ভারতী, নজরুল, প্রেমচন্দ, সুভাষচন্দ্র বোস, ভগৎ সিং এবং আরও অনেকেই সমাজতন্ত্রকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এটা ছিল একটা নতুন সভ্যতা, একটা নতুন সমাজ– যেখানে কোনও ছাঁটাই ছিল না, অর্থনৈতিক সংকট ছিল না, বেকারত্ব ছিল না। প্রত্যেকের জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত ছিল। মানুষের উপর মানুষের শোষণ ছিল না। ছিল নারী ও পুরুষের সমানাধিকার। শিক্ষা ও চিকিৎসা পাওয়া যেত সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা ছিল না। ভিক্ষাবৃত্তি ছিল না, পতিতাবৃত্তি ছিল না। জাতি, বর্ণ, ধর্ম, জনজাতিগত কোনও সংঘর্ষ এখানে ছিল না। এসব সম্পূর্ণ অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ একে ‘তীর্থস্থান’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ১৯৪১ সালে কবি অমিয় চক্রবর্তীকে তিনি এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘আমি আশা করি, এই বিপ্লব সফল হবে।” ৮০তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ সভ্যতার ভয়াবহ সংকট দেখে গভীর অনুশোচনা প্রকাশ করেছিলেন। কোন সভাতার সংকট? এই পুঁজিবাদী সভ্যতার সংকট!
মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-স্ট্যালিন-মাও সে তুঙ-শিবদাস ঘোষ– সকল চিন্তানায়কই সমাজতন্তে্রর সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। এটা খুবই দুঃখের যে, সমাজতন্ত্র, যা মানুষের সামনে একটা নতুন আশা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল, তা আজ আর নেই– প্রতিবিপ্লবের আঘাতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কেন এমন ঘটল?
আমি এ বিষয়ে কমরেড শিবদাস ঘোষের বক্তব্য উল্লেখ করতে চাই। যখন বিশ্বাসঘাতক ত্রুশ্চেভ স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা শুরু করলেন, সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দুনিয়া তাকে সাদরে স্বাগত জানাল। ঠিক এই সময়ে কমরেড শিবদাস ঘোষ সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘‘স্ট্যালিনকে খাটো করার অর্থ লেনিনবাদকেই খাটো করা এবং এর দ্বারা সংশোধনবাদ ও প্রতিবিপ্লবের দরজা খুলে দেওয়া হবে।” শেষ পর্যন্ত আমাদের সামনে সেই দুঃখজনক ঘটনাই সংঘটিত হল।
প্রতিবিপ্লব ঘটিয়ে রাশিয়া কী পেল?
আবার সেখানে বেকারত্ব, ছাঁটাই, ভিক্ষাবৃত্তি, পতিতাবৃত্তি ফির়ে এসেছে এবং রাশিয়া একটা স্বৈরতান্ত্রিক দেশে, সাম্রাজ্যবাদী দেশে পরিণত হয়েছে। চিনে এখন কী ঘটছে? চিন পুরোপুরি একটা সাম্রাজ্যবাদী দেশে পরিণত হয়েছে। সারা বিশ্বের মধ্যে চিনা পণ্য সবচেয়ে সস্তা কেন? কারণ, চিনা শ্রমিকরা এখন সবচেয়ে বেশি শোষিত হচ্ছে। জনগণের কোনও গণতান্ত্রিক অধিকারই সেখানে নেই। চিনে কায়েম রয়েছে একটা ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থা।
রাশিয়ায় প্রতিবিপ্লবের পর পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় গোটা বিশ্ব-কমিউনিস্ট আন্দোলন গভীর হতাশায় আচ্ছন্ন হয়েছে। এই আন্দোলন এখন প্রায় সম্পূর্ণ ছত্রভঙ্গ। প্রকৃত মার্কসবাদীরা বার বার পরাজয়ের সম্মুখীন হতে পারে, কিন্তু কখনই তারা হতাশ হয় না। দ্বান্দ্বিক বিজ্ঞান প্রয়োগ করে তারা পরাজয়ের কারণগুলি খুঁজে বের করে, তা থেকে উপযুক্ত শিক্ষা নেয় এবং তারপর বিজয় অর্জনের লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। এটা এক মুহূর্তের জন্য ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, বিভিন্ন ধর্মের পূর্ণ বিজয়ের জন্য শত শত বছরের সংগ্রাম প্রয়োজন হয়েছিল।
সেই সংগ্রামগুলিকেও বার বার পরাজিত হতে হয়েছিল। এই সংগ্রামগুলো ঈশ্বরের নির্দেশ কার্যকর করার দাবি করত। আবার, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের জন্য সময় লেগেছিল ৩৫০ বছর। এ সবই ছিল এক ধরনের শ্রেণি শোষণের বদলে আর এক ধরনের শ্রেণি শোষণ প্রতিষ্ঠা করার লড়াই। কিন্তু রাশিয়া এবং চিনের বিপ্লব ছিল সমস্ত ধরনের শ্রেণি শোষণ– যা ইতিহাসে কয়েক হাজার বছর ধরে আধিপত্য করেছে, তার অবসান ঘটানোর বিপ্লব। ফলে এ ছিল হাজার হাজার বছরের শ্রেণি শোষণের ইতিহাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। মনে রাখবেন, ৭০ বছরের সমাজতন্ত্রকে লড়তে হয়েছিল কয়েক হাজার বছরের পুরনো শ্রেণি শোষণের ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। কী সুমহান ছিল এই সংগ্রাম!
তাছাড়া মার্কস-এঙ্গেলস থেকে শুরু করে বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের সমস্ত নেতা, কেউই কখনও দাবি করেননি যে, সমাজতন্তে্র অর্থাৎ সাম্যবাদী সমাজের প্রথম স্তরে উপনীত হওয়ার পর নতুন এই সমাজ কোনও বিপদের সম্মুখীন হবে না। বরং তারা বারংবার এ কথাই বলেছেন যে, সমাজতন্ত্র হচ্ছে পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে উত্তরণের একটা অন্তর্বর্তীকালীন স্তর। ফলে সব সময়ই প্রতিবিপ্লবের বিপদ এবং পুরনো ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদ থেকে বেশ কিছু গুরুতর বিচ্যুতির ফলে ঠিক সেটাই ঘটেছিল। প্যারি কমিউনের পতনের পর মার্কসের দেওয়া কিছু শিক্ষা আমি তুলে ধরছি। প্যারি কমিউনের সময়ই ১৮৭১-এর ১২ এপ্রিল মার্কস কুগেলম্যানকে লিখেছিলেন, ‘‘…আমি ঘোষণা করছি যে, ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী প্রচেষ্টায় প্রশাসনিক-সামরিক যন্ত্রটা আগের মতো হস্তান্তর করেই শেষ হবে না, তাকে চূর্ণ করতে হবে।” কিন্তু নেতৃবৃন্দ সে নির্দেশ পালন করেননি, যার পরিণামে প্যারি কমিউনের পতন ঘটে। এর পর গভীর যন্ত্রণা নিয়ে মার্কস লিখলেন, ‘‘কমিউন একটা বিষয় বিশেষভাবে প্রমাণ করেছে যে, শ্রমিক শ্রেণি আগে থেকে তৈরি রাষ্ট্রযন্ত্রটি বজায় রাখতে পারে না এবং নিজেদের স্বার্থরক্ষায় তাকে কাজে লাগাতে পারে না।”
লেনিন এই শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। পুরনো বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে ধ্বংস করে তিনি শ্রমিক শ্রেণির নতুন রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন– যা বেশ কয়েক দশক টিকে ছিল এবং দেখিয়ে দিয়েছিল শ্রমিক শ্রেণি কী অসাধ্যসাধন করতে পারে!
বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনে আধুনিক সংশোধনবাদের বিপদ সম্পর্কে কমরেড শিবদাস ঘোষের হুঁশিয়ারি
রাশিয়া ও চিনে প্রতিবিপ্লবের আসন্ন বিপদ লক্ষ করে কমরেড শিবদাস ঘোষ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, যেহেতু রাষ্ট্র এবং অন্য রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি গোটা উপরিকাঠামো নয়, তার অংশমাত্র, তাই রাষ্ট্র, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং অর্থনৈতিক ভিত্তির বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটলেই সাথে সাথে তা উপরিকাঠামোর সামগ্রিক পরিবর্তন ঘটায় না। ফলে এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সাথে একই সঙ্গে জীবনের সর্বদিককে ব্যক্তি-সম্পত্তিবোধজাত মানসিক জটিলতা থেকে মুক্ত করার জন্য পরিকাঠামোয় শ্রেণিসংগ্রাম তীব্র করা অপরিহার্য। তিনি বলেছেন,
‘‘… সমাজতন্ত্র যত সংহত হবে এবং বিজয় অর্জন করবে … শ্রেণিসংগ্রাম তত তীব্র ও গভীর রূপ নেবে এবং উপরিকাঠামোতে অর্থাৎ আদর্শগত-সাংস্কৃতিক জগতে আরও সূক্ষ্ম রূপ ধারণ করবে।” (নির্বাচিত রচনাবলি, প্রথম খণ্ড)
এবং ‘‘… যদি অর্থনীতির প্রচণ্ড বৃদ্ধি ও অগ্রগতির সাথে … সামগ্রিকভাবে সমাজের সাংস্কৃতিক মনন, অর্থাৎ দর্শনগত উপলব্ধি থেকে শুরু করে সমাজের সমষ্টিগত সাংস্কৃতিক মান ও ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি আচরণ এবং অভ্যাস সমানভাবে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সার্বিক বিকাশের প্রয়োজনের সাথে সংগতি রেখে উন্নত না করা যায়, তা হলে এই দুইয়ের মধ্যে যে ব্যবধান গড়ে ওঠে, সে ব্যবধানের ফলে চিন্তাগত ক্ষেত্রে অনুন্নত মানের সৃষ্টি হতে বাধ্য। … সংস্কৃতি এবং জ্ঞানের ক্ষেত্রে অনুন্নত মান থাকলে, তার দ্বারা সমস্ত পার্টিটা, সমস্ত শ্রমিকশ্রেণি বিভ্রান্ত হয়ে বিপথে পরিচালিত হয়ে গিয়ে সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদের ঝান্ডা উড়িয়েই সংস্কারবাদ ও শোধনবাদের রাস্তায় পুরোপুরি পুঁজিবাদকে ফিরিয়ে আনতে পারে।” (নির্বাচিত রচনাবলী, প্রথম খণ্ড)
তিনি আরও বলেছিলেন, সমাজতন্ত্রের আবরণের নিচে কাজ করে চলা বুর্জোয়া ব্যক্তিবাদ ও ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণা, ব্যক্তি-অধিকার এবং বুর্জোয়া স্বাধীনতার ধারণার বিরুদ্ধে এবং পুরাতন সমাজের সংস্কৃতিগত-অভ্যাসগত-ঐতিহ্যগত রেশের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম চালাতে হবে। তা না হলে সব সময়ই উপরিকাঠামোর দিক থেকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ভিত্তিকে ধবংস করার জন্য প্রতিবিপ্লবী আক্রমণ ঘটার বিপদের আশঙ্কা থাকবে। ওই দু’টি পূর্বতন সমাজতান্ত্রিক দেশের ক্ষেত্রে এই ঘটনাই ঘটেছে।
ভবিষ্যতে বিভিন্ন দেশে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবের ক্ষেত্রে নিশ্চিত ভাবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা
মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্ট্যালিন ও মাও সে তুঙ-এর সুযোগ্য ছাত্র মহান মার্কসবাদী নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ প্রতিষ্ঠিত আমাদের দল মার্কসবাদ-লেনিনবাদ কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ঝান্ডা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে রেখেছে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা আমাদের দেশে এবং বিশ্বের দেশে দেশে ছড়িয়ে দিয়ে সমগ্র শ্রমিক শ্রেণি ও শোষিত মানুষকে শিক্ষিত ও সংগঠিত করার দায়িত্ব ইতিহাস আমাদের উপর ন্যস্ত করেছে। এ জন্য আমাদের কমরেডদের আদর্শগত, রাজনীতিগত, নৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সাংগঠনিকভাবে প্রস্তুত হয়ে উঠতে হবে।
কমরেড শিবদাস ঘোষের এই শিক্ষা আমরা ভুলতে পারি না যে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের প্রাণসত্তা নিহিত আছে এর সংস্কৃতি, উন্নততর সংস্কৃতির মধ্যে। তিনি বলেছেন, ‘শুধু মার্কসবাদের কিছু কথা আউড়ে কোনও কাজ হবে না’। আমরা জানি যে, শুধু মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-স্ট্যালিন-মাও সে তুঙ ও কমরেড শিবদাস ঘোষের রচনাবলি পড়লেই কাজ হবে না। এসব থেকে সহজেই আমরা উদ্ধৃতি দিতে পারি। কিন্তু তাতে কাজ হবে না। যেটা দরকার তা হল আমরা সংস্কৃতিগতভাবে পরিবর্তিত হয়েছি, অর্থাৎ আমাদের অর্থনৈতিক জীবনে, আমাদের সামাজিক জীবনে, বিবাহিত জীবনে, প্রেম, ভালবাসা, স্নেহ-প্রীতি, সন্তানের প্রতি এবং জনগণের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে– জীবনের সর্বক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভাবে পরিবর্তিত হয়েছি। এর অর্থ হল জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা কমিউনিস্টের মতো আচরণ করছি।
এটা ঠিকই যে আমাদের পার্টি বড় হচ্ছে। পরিমাণগত দিক থেকে আমরা বেড়ে চলেছি। কিন্তু শুধু সংখ্যাবৃদ্ধিতে কাজ হবে না যদি না তা গুণগত দিক থেকে যোগ্যতাসম্পন্ন না হয়। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কমরেড শিবদাস ঘোষ আমাদের শিখিয়েছেন, আমাদের প্রতিটি মুহূর্তের চিন্তায়, আচার-আচরণে, আমাদের কাজে, কর্তব্যবোধে এবং আমাদের আবেগে হয় আমরা বুর্জোয়া, আর না হয় সর্বহারা বিপ্লবী। মনে রাখবেন, আমরা পুঁজিবাদের সৃষ্টি। পুঁজিবাদ আমাদের ঘিরে রেখেছে। এই পুঁজিবাদ চূড়ান্ত অধঃপতিত এবং দূষিত। প্রতি মুহূর্তে এই দূষণ আমাদের মধ্যে প্রবেশ করছে, আমাদের দূষিত করছে এবং দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলছে। এ জন্য আমাদের সজাগ থাকতে হবে। আমরা কমরেড শিবদাস ঘোষের একটা উদ্ধৃতি সর্বত্র প্রচার করেছি যেখানে বলা হয়েছে, এমনকি সর্বোচ্চ নেতাও অধঃপতিত হতে পারেন যদি তিনি আত্মসন্তুষ্টিতে ভোগেন এবং সংগ্রাম না করেন।
কমরেডস, আমি অনেক সময় নিয়ে ফেলেছি। বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের স্থপতি মহান মার্কস ও এঙ্গেলসের কাছ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। কী ভাবে তাঁরা সংগ্রাম করেছিলেন? কেন তাঁরা সংগ্রাম করেছিলেন? তাঁরা নাম-যশের জন্য সংগ্রাম করেননি। তাঁরা শ্রমিকশ্রেণি ও শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য এবং সমগ্র মানবসভ্যতার প্রগতির জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। দৃঢ় সংকল্প ও অটল অধ্যবসায় নিয়ে বাস্তবিকপক্ষে উত্তাল প্রতিকূল স্রোতের বিরুদ্ধে তাঁদের সাঁতার কাটতে হয়েছিল। তাঁরা দৃঢ়ভাবে সমস্ত ঝোড়ো আবহাওয়ার মোকাবিলা করেছিলেন। সর্বহারা বিপ্লবের একমাত্র স্বপ্ন নিয়ে তাঁরা প্রতিকূল দুনিয়ার বিরুদ্ধে সাহসের সাথে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁদের সংগ্রামে এক মুহূর্তের জন্যও দোদুল্যমানতা ও সংশয়ের লেশ মাত্র ছিল না। তাঁদের ছাত্র হিসাবে আজ তাঁদের সেই কঠোর সংগ্রামের পথ অনুসরণ করে তাঁদের সেই লক্ষ্য আমাদের পূরণ করতে হবে। সেই উদ্দেশ্যে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা আমাদের বার বার অনুশীলন করতে হবে।
কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা অনুসরণ করে আমাদের উন্নততর সংস্কৃতি অর্জন করতে হবে। পরিপূর্ণ নিষ্ঠা, সাহস ও আবেগের সাথে শ্রেণি ও গণসংগ্রাম গড়ে তুলতে আমাদের আত্মনিয়োগ করতে হবে। যদি আমরা এই কাজ করতে পারি, যদি নিজেদের পরিবর্তন করতে পারি, যদি আমরা সেই পথনির্দেশ অনুযায়ী চলতে পারি, তবে বিপ্লব সফল করতে আমরা সফল হবো। সর্বত্র মানবতা আজ মুক্তির আকাঙক্ষায় কাঁদছে। পরিবর্তনের জন্য কাঁদছে। কে সেই মুক্তি দিতে পারে? একমাত্র শ্রেণি সচেতন বিপ্লবী সর্বহারাই মানবজাতির এই কান্না দূর করতে পারে। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে যেমন বলা আছে, এরাই হল পুঁজিবাদের কবর খননকারী। কিন্তু তাদের হাতিয়ার প্রয়োজন। সেই হাতিয়ার হল মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার আদর্শগত হাতিয়ার। আর তাদের সংস্কৃতি হল সর্বহারা সংস্কৃতি। এ জন্য অবশ্যই একটি প্রকৃত সর্বহারা পার্টি প্রয়োজন। সেই সর্বহারা পার্টির দায়িত্ব, পুঁজিবাদের কবর খনন করা। অন্য কথায়, সর্বহারা শ্রেণিকে আদর্শগত, রাজনৈতিক, নৈতিক এবং সংস্কৃতিগতভাবে প্রস্তুত করা– যাতে তারা তাদের ঐতিহাসিক কর্তব্য পালন করতে পারে। এইভাবে যদি আমরা এগোতে পারি, সেটাই হবে মহান এঙ্গেলসের প্রতি সর্বোত্তম শ্রদ্ধা নিবেদন। আমি এখানেই শেষ করছি।