মহান ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসকে কেন আজও স্মরণ করব–প্রভাস ঘোষ

মহান এঙ্গেলসের মৃত্যুদিবস (৫ আগস্ট) উপলক্ষে ১২ আগস্ট দলের কেন্দ্রীয় দফতরে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।

২০২০ সালের ২৮ নভেম্বর বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ সমগ্র দেশের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে ইংরেজিতে একটি আলোচনা করেন যা অনলাইনে সম্প্রচারিত হয়। ৫ আগস্ট মহান এঙ্গেলসের ১২৬তম মৃত্যুদিবস উপলক্ষে সেই ইংরেজি আলোচনাটির বঙ্গানুবাদ ধারাবাহিকভাবে আমরা প্রকাশ করছি। অনুবাদে কোনও ভুলত্রুটি থাকলে তার দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমাদের। এবার প্রথম পর্ব।    – সম্পাদক, গণদাবী

 

বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক মহান পথিকৃৎ ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের ২০০তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে আমরা এই সভার আয়োজন করেছি। আমরা যদি বলি মার্কসবাদ বা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ তা হলে তা সঠিক। কিন্তু যদি শুধু ‘মার্কস’ বলি, মনে হবে কিছু যেন বাদ থেকে যাচ্ছে। ঠিক তেমনই, যদি আপনি কেবল ‘এঙ্গেলস’-এর নাম উল্লেখ করেন, কিছু একটা অনুপস্থিত থেকে যায়। কিন্তু যদি বলেন ‘মার্কস-এঙ্গেলস’, তা হলে কথাটা যেন সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। মনে হয়, যেন একজন মানুষের নাম। যদিও তাঁরা শারীরিকভাবে দু’জন মানুষ ছিলেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে চিন্তা-ভাবনায়, আদর্শগত উপলব্ধিতে, ধারণায়, বাস্তব-প্রয়োগের কর্মকাণ্ডে এবং আবেগময় সম্পর্কে একজন মানুষের মতোই ছিলেন। যদি আমি তাঁদের যোগ্য ছাত্র কমরেড লেনিনের উদ্ধৃতি উল্লেখ করি, আমরা তা ঠিক মতো বুঝতে পারব। লেনিন বলেছেন, ‘‘অতীতে পুরাগাথা বন্ধুত্বের দৃষ্টান্তের অনেক মর্মস্পর্শী কাহিনি শুনিয়েছে। ইউরোপীয় সর্বহারারা এ কথা বলতেই পারে যে, দু’জন মহাজ্ঞানী এবং সংগ্রামী মানুষ তাঁদের বিজ্ঞানকে গড়ে তুলেছেন, যাঁদের সম্পর্ক মানব-বন্ধুত্বের সমস্ত প্রচলিত মর্মস্পর্শী পুরা-কাহিনীকেও ছাড়িয়ে যায়। এঙ্গেলস সর্বদাই নিজেকে মার্কসের পিছনেই রেখেছেন”। (সূত্রঃ ঐ)

তিনি লিখেছেন, ‘‘মার্কসের সাথে আমি সব সময়ই দ্বিতীয় বেহালা-বাদক হিসাবে ছিলাম। যখন তাঁরা উভয়েই সর্বহারা শ্রেণির মুক্তির জন্য পথ খুঁজতে এবং সেই অনুযায়ী তাদের শিক্ষিত ও সংগঠিত করে তুলতে তীব্র সংগ্রামে নিয়োজিত, তখন এটি ছিল তাঁদের কমরেডশিপের সর্বোত্তম আবেগময় প্রকাশ। আবেগময় সম্পর্কের এই অতুলনীয় উদাহরণ আমাদের কাছে শিক্ষণীয়।” (১৮৯৫ সালে এঙ্গেলসের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই লিখিত)।

আমরা বিশ্বাস করি, সর্বহারা শ্রেণির এই দুই মহান নেতার ঐতিহাসিক অবদানের জন্য সমগ্র মানবজাতি তাঁদের কাছে ঋণী হয়ে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আমাদের এই দাবি কি বাহুল্যপূর্ণ? যে মানুষটি ১৮২০ সালে জন্মেছিলেন এবং যাঁর মৃত্যু ১৮৯৫ সালে, তাঁকে আজও কেন আমরা স্মরণ করছি? কী ভাবে তিনি আমাদের আজকের জীবনের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে আছেন?

বর্তমান পরিস্থিতি

আমরা জানি, বর্তমানে আমরা চরম দুর্দশা ও ভয়াবহ সঙ্কটের সম্মুখীন। আমি শুধু ভারতবর্ষের কথাই বলছি না, সারা দুনিয়ার কথাই বলছি। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক– সমস্ত দিকেই সমগ্র মানবজাতির অবস্থা দ্রুত অধঃপতিত হচ্ছে। জনগণের সামনে কোনও আশার আলো নেই। কোনও মরূদ্যান তো দূরের কথা, ভ্রান্তির একটা মরীচিকা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।

বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের মহান নেতা ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের স্মরণ দিবস উপলক্ষে ১২ আগস্ট দলের শিবপুর সেন্টারে মহান নেতার প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ।

আমরা দেখছি, গত কয়েক দশক ধরে এক অন্তহীন মন্দা ক্রমাগত গভীর হচ্ছে। বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা সঙ্কট থেকে উদ্ধার পেতে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন, সমাধানের কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। বিশ্বের মোট সম্পদের তিন-চতুর্থাংশ সমগ্র জনগণের মাত্র এক শতাংশের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। তারা কারা? তারা হ’ল বৃহৎ কর্পোরেট, একচেটিয়া পুঁজিপতি; অন্য কথায় সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদীরা। অন্যদিকে অবশিষ্ট ৯৯ শতাংশ জনগণ মাত্র এক-চতুর্থাংশ সম্পদের মালিক। ওই ৯৯ শতাংশ মানুষকে যদি আরও ভাগ করি, তার ১০ থেকে ১৫ শতাংশকে বাদ দিলে অবশিষ্ট ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ কার্যত ভিখারি বা আধা-ভিখারির মতো বেঁচে আছে। বর্তমান প্রজন্মের কোটি কোটি যুবক বেকার, অর্ধ-বেকার আর ছাঁটাই কর্মী। প্রতিদিন প্রতি ঘন্টায় লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় মারা যাচ্ছে, চিকিৎসার সুযোগটুকু থেকেও তারা বঞ্চিত। তাদের অনেকে আত্মহত্যা করছে। লক্ষ লক্ষ শিশু রাস্তায় জন্ম নিচ্ছে– অনেকে জানেও না কে তাদের বাবা-মা। তারা খাদ্য সংগ্রহ করছে ডাস্টবিন থেকে, আর বড়লোকদের খাবারের উচ্ছিষ্ট থেকে।

রাজনৈতিক চিত্রটা কী রকম? গণতন্ত্রের নামে সর্বত্র ফ্যাসিবাদী স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চলছে। জনগণের রাজনৈতিক শিক্ষাবিহীন সংসদীয় গণতন্ত্র নিছকই এক সীমাহীন ভণ্ডামি। নির্বাচনের নামে শুধু পুঁজিপতিদের পছন্দের লোক বেছে নেওয়া। একচেটিয়া গোষ্ঠী ও কর্পোরেট সংস্থাগুলির নির্বাচনী নকল মহড়ার মধ্য দিয়ে তাদের ভৃত্যদের বেছে নিয়ে সরকারি ক্ষমতায় বসায়। নির্বাচনের রায় নির্ধারিত হয় তাদের টাকার জোরে, জনমতের জোরে নয়। শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি নিজেদের পছন্দের পার্টিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য টাকার জোর, আমলাতন্ত্র, প্রচারমাধ্যম এবং পেশিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে ‘‘অবাধ ও নিরপেক্ষ” নির্বাচনের প্রহসন চালায়। সাধারণ মানুষও মনে করে, নির্বাচনের দ্বারা তাদের জীবনের কোনও পরিবর্তন হবে না, শুধু সরকারের পরিবর্তন ঘটবে মাত্র। তারা জানে, ভণ্ড, প্রতারক, ঠগবাজ বুর্জোয়া নেতাদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরিই তারা শুধু শুনবে।

আমরা সম্প্রতি তথাকথিত বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন-প্রহসন দেখলাম। কী ঘটল সেখানে? এটা একটা লোকাল ক্লাবের নির্বাচনকেও লজ্জা দেবে। ‘সির্ফ কুর্সি কি লড়াই’! এটা ছিল নিছক গদি দখলের লড়াই। এই তো ঘটল সেখানে! এটাই সর্বত্র ঘটছে – কোথাও প্রকাশ্যে, কোথাও বা গোপনে। রাজনৈতিক নেতারা জানে, জনগণ ক্ষুধার্ত, তারা ভিক্ষা করছে। শুধু কতগুলি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে, সামান্য কিছু টাকা ছড়িয়ে নেতারা তাদের ভোট কিনে নিতে পারে। জনগণও মনে করে, ওই টাকা আর স্থানীয় যুবকদের মদ-মাংসের ভোজ ছাড়া এই নির্বাচনে তারা কিছুই পাবে না। এই সবই চলছে। আর প্রশাসনিক ক্ষমতার জোরে পুঁজির স্বার্থে আমলাতন্ত্র সমস্ত কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে। বিচারপতিদের পদোন্নতি, বদলি এবং বিচারের রায় পর্যন্ত ঠিক হয় শাসক শ্রেণি ও মন্ত্রীত্বের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের ইচ্ছায়। এগুলি আজকাল খোলাখুলি আলোচনার বিষয়। প্রচার-মাধ্যমকে কারা নিয়ন্ত্রণ করছে? পুঁজির শক্তি। ব্যক্তিস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, প্রতিবাদের স্বাধীনতা– এসব আজ নিতান্তই ফাঁকা কথা। প্রতিবাদের কন্ঠকে নির্মমভাবে স্তব্ধ করা হচ্ছে এবং চূড়ান্ত ও হিংস্রভাবে পর্যুদস্ত করা হচ্ছে।

মানব সমাজে মূল্যবোধ প্রায় ধ্বংস হতে বসেছে

প্রায় সমগ্র মানবজাতিই আজ মূল্যবোধহীন। অতীতে একটা সময়ে সমাজে ধর্মীয় মূল্যবোধ কাজ করত। পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক কারণেই যখন ধর্মীয় মূল্যবোধগুলি নিঃশেষিত হয়ে যায়, তখন এসেছে মানবতাবাদী মূল্যবোধ– যা পাশ্চাত্যে এসেছে নবজাগরণের সময়ে ও তার অনুসারী গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর্যায়ে এবং আমাদের দেশ সহ উপনিবেশগুলিতে এসেছে স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগে। আজ যখন বুর্জোয়া মানবতাবাদী আদর্শ প্রায় নিঃশেষিত এবং কমিউনিস্ট মূল্যবোধও সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি, তখন সমাজে কোনও মূল্যবোধই অবশিষ্ট নেই। বাস্তবে একজন মানুষ কোনও মূল্যবোধ, নৈতিকতা বা নীতিবোধ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। সামাজিক পরিবেশ থেকে সে এসব অর্জন করে। যদি সমাজে মূল্যবোধ থাকে, যদি সামাজিক চেতনা থাকে তাহলে একজন তার শৈশবকাল থেকে ধীরে ধীরে তা অর্জন করে। কিন্তু পুঁজিবাদী শাসকরা এসব পুরোপুরি ধবংস করে দিয়েছে। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি মনুষ্যত্বহীন মানব। শারীরিকভাবে তারা মানুষরূপী, কিন্তু মানবিক মূল্যবোধ বর্জিত। কী মর্মান্তিক পরিস্থিতি! ভালবাসা, স্নেহ-প্রীতি, কোমল মনের অনুভূতি– এগুলো সমাজে প্রায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এমনকি রোজগেরে ছেলেরা তাদের বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দেখভালের দায়িত্ব নেয় না– পারিবারিক জীবনেও এটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে। হয় তাঁদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়– যা তাঁদের কাছে জেলখানারই মতো, না হলে তাঁদের ঘর থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। তাঁরা রেলের প্ল্যাটফর্মে বা রাস্তায় ভিক্ষা করছেন। এমনকি সম্পত্তির লোভে বাবা-মাকে খুন পর্যন্ত করা হচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালবাসা ও আবেগের সম্পর্ক নেই। সন্দেহ ও অবিশ্বাস তাদের দাম্পত্য জীবনের সুন্দর সম্পর্ককে ধবংস করে দিচ্ছে। আরও ভয়ঙ্কর বিষয় হল, নারীধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং খুন আজ দৈনন্দিন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এ সমস্ত ঘটনা মানব-ইতিহাসে কখনও দেখা যায়নি। জন্তু জানোয়ারের জগতেও এরকম ধর্ষণ, গণধর্ষণ দেখতে পাওয়া যায় না। এমনকি নব্বই বছরের বৃদ্ধা বা তিন বছরের শিশুও এর হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এই ধর্ষকরা এই পুঁজিবাদী সভ্যতার সৃষ্টি। এটাকে কি আদৌ সভ্যতা বলা যায়?

কেন আজও আমরা মার্কস এঙ্গেলসকে স্মরণ করব

কেন আজও আমরা মার্কস এঙ্গেলসকে স্মরণ করব? তাঁরা ছিলেন সেই চিন্তাবিদ, যাঁরা বহু আগেই পুঁজিবাদী সভ্যতার এই করুণ পরিণতি দেখতে পেয়েছিলেন, এর কারণ খুঁজে পেয়েছিলেন এবং এই সমস্যার হাত থেকে মুক্তির রাস্তা দেখিয়েছিলেন। নিপীড়িত মানুষের প্রতি অসীম ভালবাসার কারণে মার্কস-এঙ্গেলস খুবই কষ্টসাধ্য এই সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন। এটা এমন একটা সময় ছিল যখন ইউরোপে রেনেসাঁর প্রভাব শেষ হয়ে যায়নি। সেই যুগটায় বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে সংগ্রামে জয়-পরাজয় তখনও নিষ্পত্তি হয়নি। সেই সময় কিছু কিছু কলকারখানাও গড়ে উঠেছিল। শ্রেণি হিসাবে বুর্জোয়ারা আবির্ভূত হয়েছিল তাদের বিপরীত-সত্তা শ্রমিক শ্রেণিকে সঙ্গে নিয়ে। কোথাও কোথাও বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির কিছু প্রতিবাদ আন্দোলনও গড়ে উঠছিল। খুব সংক্ষেপে, এই পটভূমিতেই মার্কস-এঙ্গেলসের আবির্ভাব ও তাঁদের সংগ্রামের সূচনা ঘটেছিল।

এতকাল ধরে চিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে শ্রেণি বিভাজন, ধনী-গরিব ও শোষক-শোষিতের মধ্যে বিভাজন হল শাশ্বত ও চিরন্তন। তাঁরা এভাবে চিন্তা করতেন, কারণ হাজার হাজার বছর ধরে প্রথমে আদিম সমাজ ভেঙে দাসপ্রভু ও দাসে বিভক্ত হয়ে দাসব্যবস্থা, তারপরে সামন্তপ্রভু ও ভূমিদাসে বিভক্ত সামন্ততন্ত্র এবং তারও পরে দুই বিরোধাত্মক শ্রেণি হিসাবে বুর্জোয়া শ্রেণি ও শ্রমিক শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে পুঁজিবাদ এসেছে– যা আজও চলছে। এই শ্রেণিবিভাগ দৃঢ়ভাবে এই বিশ্বাসে উপনীত করেছে যে শ্রেণি বিভাজন চিরন্তন, অপরিবর্তনীয় ও চূড়ান্ত।

আরেকটি দৃঢ় ধারণা দার্শনিকদের মধ্যে ছিল। তাঁরা মনে করতেন, প্রকৃতিজগতের পিছনে একটা অতিপ্রাকৃত শক্তি আছে, বিশ্বজগৎ সৃষ্টির আগেই একটা দৈবশক্তি এবং পরম ভাব ছিল– যা আমাদের সমাজজীবন সহ সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। সমস্ত কিছুই পরম সত্তার দ্বারা পূর্বনির্ধারিত হয়ে আছে। সেই অনুযায়ী শ্রেণি বিভাজন ও শোষণও পূর্বনির্ধারিত এবং অপরিবর্তনীয়। শোষিত মানুষও এই ঘটনাকে পরম সত্য বলে মনে করত। এই চিন্তা কি সঠিক ছিল? বিভিন্ন মতবাদের গভীর অধ্যয়ন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, খুঁটিয়ে বিচার-বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে, বিশেষ করে হেগেল ও ফুয়েরবাখের দর্শনকে, অ্যাডাম স্মিথ ও রিকার্ডোর রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র এবং সেন্ট সাইমন, রবার্ট ওয়েন, চার্লস ফুরিয়েরদের ‘কাল্পনিক সমাজতন্ত্র’ সংক্রান্ত ধারণাগুলোকে কষ্টসাধ্য সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে এঙ্গেলসের সঙ্গে মার্কস বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্তে এলেন যে, এই সমস্ত ধারণাগুলি ভ্রান্ত এবং দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করলেন, একমাত্র বস্তুজগৎই সত্য। প্রকৃতি জগতের পিছনে কোনও অতিপ্রাকৃত শক্তির অস্তিত্ব নেই। কোনও দৈবশক্তি বা পরম ভাব বস্তুজগৎকে নিয়ন্ত্রণ বা পূর্বনির্ধারিত পথে পরিচালনা করছে না। বস্তু গতিশীল এবং তা ক্রমাগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় আছে। প্রতি মুহূর্তে কোনও বস্তুসত্তার সৃষ্টি হচ্ছে এবং ক্রমাগত বস্তুসত্তার ধবংসও হচ্ছে। একইভাবে শ্রেণি বিভাজনও চিরন্তন সত্য নয়। প্রাচীন সমাজে বা আদিম সমাজে কোনও শ্রেণি ছিল না। তখন কোনও ব্যক্তিসম্পত্তি ছিল না এবং সেই কারণেই সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানার ধারণাও ছিল না। উৎপাদনের বিকাশের পথ বেয়ে পরবর্তীকালে সমাজে শ্রেণি বিভাজন এসেছে। সমাজব্যবস্থাও পরিবর্তিত হয়েছে। শ্রেণিবিভক্ত দাসব্যবস্থা, সামন্ততন্ত্র ও পুঁজিবাদ– সমস্ত সমাজব্যবস্থাই সমাজ পরিবর্তনের নিয়ম মেনে একটির পর আরেকটি এসেছে। একই নিয়ম মেনে শ্রেণিবিভাজন বিলুপ্ত হবে এবং শ্রেণিহীন সমাজের আবির্ভাব ঘটবে। তাঁরা সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, এই বিশ্বপ্রকৃতিতে বস্তুজগতের সর্বাধুনিক আবিষ্কৃত ক্ষুদ্রতম কণা থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত জানা সর্ববৃহৎ গ্রহ– সমস্ত কিছুই সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী ক্রমাগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় পরিচালিত হচ্ছে। একইভাবে, মানব-ইতিহাসও সুনির্দিষ্ট নিয়মের দ্বারা পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় এগিয়ে চলেছে এবং কতগুলি সর্বজনীন সাধারণ নিয়ম আছে যা প্রকৃতিজগৎ ও মানবসমাজ উভয়কে পরিচালিত করছে। এই বিজ্ঞানসম্মত মানবমুক্তির আদর্শের জন্য এই দুই মহান চিন্তানায়ক ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন– যদিও তাঁদের জীবিতকালে তাঁরা স্বীকৃতি পাননি। এই ঐতিহাসিক অবদানের জন্য মানবজাতি তাঁদের কাছে চিরকাল ঋণী হয়ে থাকবে। আজ ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের ২০০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আমার আলোচনা মূলত এঙ্গেলস কীভাবে মার্কসকে এই ঐতিহাসিক সংগ্রামে সাহায্য করেছেন তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখব।

একজন শিল্পপতির সন্তান পরিবর্তিত হয়েছিলেন সর্বহারা শ্রেণির পথপ্রদর্শকে

এখন পর্যন্ত আমি যা আলোচনা করলাম, তা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার শিক্ষায় যতটুকু আমি বুঝেছি, তার ভিত্তিতেই। এখন আমি মূলত এঙ্গেলস ও লেনিন থেকে উদ্ধৃত করে পড়ব। এসব আপনাদের কাছে কিছুটা কঠিন মনে হতে পারে। অনেকের কাছে একঘেয়েমি মনে হতে পারে। কিন্তু আমি নিরুপায়। সময়ের স্বল্পতার জন্য আমি ব্যাখ্যা করে বলতে পারব না। আমাদের সংগ্রামকে পথ দেখাতে এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাগুলি খুবই প্রয়োজনীয় বলে আপনাদের ধৈর্য ধরে শুনতে অনুরোধ করব। এসব বলার পর যদি সময় পাই, আমি আরও কিছু বিষয় আলোচনা করব।

আমাদের মধ্যে অধিকাংশই এটা জেনে বিস্মিত হবেন যে একজন শিল্পপতির সন্তান, যিনি একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান দেখাশোনা করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তিনি পরিবর্তিত হয়ে সর্বহারা শ্রেণির বিপ্লবী সংগ্রাম পরিচালনা করার পথনির্দেশক হয়ে উঠেছিলেন।

এঙ্গেলসের পিতা ছিলেন একজন শিল্পপতি। চোদ্দ বছর বয়সে এঙ্গেলসকে হাইস্কুলে পাঠানো হয়েছিল, যাকে তাদের দেশে ‘জিমনাসিয়াম’ বলা হত। সেখানে পড়াশোনা শেষ করার আগেই তাঁর পিতা তাঁকে স্কুল ছাড়তে বাধ্য করেন এবং লেখাপড়া করার প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও নিকটবর্তী একটি শহরে তাঁকে ব্যবসা পরিচালনা করার শিক্ষা নিতে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু এঙ্গেলসের জ্ঞান অর্জনের আকাঙক্ষা ছিলই। যখন তিনি অল্প বয়সী স্কুলছাত্র, তিনি ল্যাটিন, গ্রিক, জার্মান, ফরাসি প্রভৃতি অনেকগুলি ভাষা শিখে ফেলেন। স্কুলে পড়ার সময়ই ফরাসি ও জার্মান সাহিত্য পড়েন। যখন তাঁকে ব্যবসা পরিচালনা শিখতে পাঠানো হল, সেখানেও তিনি নিজের মতো করে পড়াশুনা চালিয়ে গেলেন। তিনি সক্রেটিস, প্লেটো, স্পিনোজা এবং হেগেলের দর্শন পড়ে ফেললেন। তাঁকে এক বছরের আবশ্যিক সামরিক শিক্ষার জন্য বার্লিনে পাঠানো হয়। বার্লিনে তিনি ফুয়েরবাখের দর্শনের সংস্পর্শে আসেন এবং সেখানে তিনি ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষা আয়ত্ত করেন। সহজেই তিনি ১২টা ভাষায় পড়তে ও লিখতে পারতেন এবং ২০টা ভাষায় কথা বলতে পারতেন। দর্শন, অর্থনীতি, প্রকৃতিবিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য– অর্থাৎ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় তিনি জ্ঞানচর্চা চালিয়ে যেতেন। এমনই ছিল তাঁর জ্ঞানের তৃষ্ণা।(চলবে)

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ৪ সংখ্যা