কমিউনিস্ট পার্টি একটি বুর্জোয়া বা পেটিবুর্জোয়া পার্টির মতো নিছক কতগুলি ব্যক্তি এবং গ্রুপের সমষ্টি নয়। লেনিন একটি কমিউনিস্ট পার্টিকে জীবন্ত দেহের (লিভিং অর্গানিজম) সাথে তুলনা করেছেন। অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টি একটা ‘মেকানিক্যাল হোল’ না, এটা একটা ‘অরগ্যানিক হোল’ (প্রাণহীন যন্ত্র নয়, একটি জীবন্ত সত্তা) ঠিক যেমন মানবদেহ –এটা একটা ‘মনোলিথিক অরগ্যানিজম’, এর একটা স্নায়ু কেন্দ্র বা মস্তিষ্ক (সেন্টার অফ নার্ভস অর ব্রেন) আছে। জীবন্ত দেহের এটাই হল কেন্দ্রবিন্দু বা পরিচালিকা শক্তি। এই মস্তিষ্কই সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলিকে পরিচালনা করে। আবার, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং ইন্দ্রিয়গুলিও (সেন্স অর্গান) তাদের ক্রিয়াকলাপের দ্বারা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপকে প্রভাবিত করছে। মস্তিষ্কের সাথে ইন্দ্রিয় এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলির এই সম্পর্কটি দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের নীতি অনুযায়ী পরিচালিত। একটি কমিউনিস্ট পার্টির গঠনও এই রকম। একটি সত্যিকারের কমিউনিস্ট পার্টিতে নেতার সাথে ব়্যাঙ্ক অ্যান্ড ফাইলের সম্পর্ক, কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে সেল থেকে শুরু করে পার্টির অন্যান্য বডিগুলির সম্পর্ক হল মস্তিষ্কের সাথে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং ইন্দ্রিয়গুলির সম্পর্কের মতো। আবার নিচু থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত এই সকল পার্টিবডিগুলিও আলাদা আলাদা ভাবে কতগুলো কর্মী বা নেতার সমাবেশ মাত্র নয়। প্রত্যেকেরই নিজস্ব নিজস্ব ক্ষেত্রে ‘সেন্টার অফ অ্যাট্রাকশান’ বা নেতা আছে।
এই সমস্ত পার্টি বডিগুলি এবং সমস্ত কর্মী ও নেতার সম্মিলিত সংগ্রামের মধ্য দিয়েই যে যৌথজ্ঞান গড়ে ওঠে, আমি আগেই বলেছি, সেই যৌথজ্ঞানের ধারণা যেহেতু বিমূর্ত নয়, সেহেতু পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় কমিটিতে যে নেতার মধ্য দিয়ে এই যৌথজ্ঞানের প্রকাশ সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ নেয়–তিনি হচ্ছেন দলের চিন্তানায়ক, নেতা, শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক। এই নেতা বিভিন্ন নেতার মধ্যে চুক্তির দ্বারা, বা তাদের মধ্যে আপসের রূপে বা জোড়াতালি দিয়ে ঠিক হয় না। এই নেতা পার্টির অভ্যন্তরে যৌথ ও সচেতন সংগ্রাম, অর্থাৎ যৌথ নেতৃত্বের বাস্তবীকৃত ও বিশেষীকৃত ধারণা গড়ে তোলার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়। মনে রাখতে হবে, কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে ‘লিডারশিপ’-এর এই ‘ফেনোমেনন’, ‘প্যারালাল (সমান্তরাল) লিডারস’-এর ফেনোমেনন নয়, এটা ‘লিডার অব দি লিডারস’-এর (নেতাদের মধ্যে নেতার) ফেনোমেনন। লেনিনের জীবদ্দশায় সিপিএসইউ-তে লেনিন ছিলেন সকল নেতাদের নেতা। তিনিই ছিলেন দলের চিন্তানায়ক, নেতা, শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক। লেনিন যখন অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী, স্ট্যালিন পার্টির সাধারণ সম্পাদক, তখনও লেনিন ছিলেন দলের নেতা ও শিক্ষক। এটা স্ট্যালিনও মনে-প্রাণে স্বীকার করতেন। চিনের পার্টিতেও মাও সে-তুঙই দলের চিন্তানায়ক বা নেতা। একেই বলা হয় যৌথ নেতৃত্বের যথার্থ রূপ, অর্থাৎ যৌথ নেতৃত্বের বিশেষীকৃত রূপ।
‘কেন ভারতবর্ষের মাটিতে এসইউসিআই(সি) একমাত্র সাম্যবাদী দল’ বই থেকে
লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ১৮ এপ্রিল ২০২৫ এ প্রকাশিত