‘‘রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র বা নজরুল না এলে ভারতবর্ষের নবজাগৃতি সম্ভব হত না, কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে সমাজ মানসিকতা বা মনন, গণতান্ত্রিক চেতনা, যুক্তিবাদী মন কোনও কিছুই এ দেশে গড়ে উঠত না। এঁরা সেগুলি গড়ে তুলেছেন। অথচ মানবতাবাদের চিন্তাধারা আজকে পুরোপুরি শাসকশ্রেণির সুবিধায় পর্যবসিত হয়েছে। এ কথার মানে কি এই যে, রবীন্দ্রনাথ জনগণের সম্পদ নন? অবশ্যই তিনি জনগণের সম্পদ। সম্পদ এই অর্থে, যদি আমরা বুঝতে পারি যে, আজকের় যুগের প্রয়োজনে সামগ্রিকভাবে মানবতাবাদের সীমা এবং সে অর্থে মানবতাবাদী হিসাবে রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদী চিন্তাভাবনার সীমা নির্দেশ করে তার থেকে এগিয়ে গিয়ে সর্বহারা সংস্কৃতির জন্ম আমাদের দিতে হবে। এ-ও আমাদের বুঝতে হবে যে, বুর্জোয়া মানবতাবাদের যেটা বিপ্লবাত্মক ধারা তার ধারাবাহিকতাতেই সর্বহারা সংস্কৃতির় জন্ম হবে। তবুও রবীন্দ্র-সংস্কৃতি সর্বহারা বিপ্লববাদের জমি তৈরি করেছে, এ কথাকে অস্বীকার করা যাবে না। তার কারণ এই যে, সামগ্রিকভাবে বুর্জোয়া মানবতাবাদ সর্বহারা মানবতাবাদের জমি তৈরি করে। সেই জমি মানবতাবাদের প্রবক্তা রবীন্দ্রনাথ তৈরি করেছেন এবং সে অর্থে রবীন্দ্রনাথ জনসাধারণের অশেষ শ্রদ্ধার পাত্র এবং অশেষ পূজনীয় ব্যক্তি। তাঁর দান ভারতবর্ষের শ্রমিক বিপ্লবও অস্বীকার করতে পারবে না– যদি না শ্রমিক বিপ্লবীরা এভাবে ভাবেন যে, তাদের বিপ্লবের তত্ত্বটা আকাশ থেকে পড়েছে। কোনও সর্বহারা বিপ্লবী, কোনও সাম্যবাদী, কোনও শ্রমিক বিপ্লবী– যতদূর আমি জানি, লেনিন থেকে আরম্ভ করে মাও সে তুঙ পর্যন্ত– যাঁরা যে দেশে যখন বিপ্লব করেছেন, তখন তাঁদের কেউই এই ভাবে ভাবেননি। তাঁরা সব সময়ই ভেবেছেন অতীতের সমস্ত চিন্তানায়করা তাঁদের যুগের বা চিন্তা-ভাবনার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সেই আন্দোলনের দ্বারা সমাজটাকে যতদূর এগিয়ে দিয়েছেন, সেইটিই তার পরবর্তী সমাজব্যবস্থা গঠন করার জমি তৈরি করেছে। এই অর্থে সমস্ত যুগের অগ্রসর বিপ্লববাদ হচ্ছে অতীতের সমস্ত মনীষী এবং সমস্ত প্রগতিশীল আন্দোলনগুলিরই উত্তরসূরি।”
নবজাগরণ, রবীন্দ্রনাথ ও বর্তমান সাংস্কৃতিক আন্দোলন শিবদাস ঘোষ রচনাবলি, পঞ্চম খণ্ড