প্রিয় কমরেড
আপনারা যথেষ্ট অবগত আছেন যে, শুধু আমাদের দেশের জনগণই নয়, সারা বিশ্বের জনগণ এখনও কোভিড–১৯ জনিত অতিমারির বিরামহীন করাল গ্রাসে কবলিত এবং এই ভয়াল রোগ ইতিমধ্যেই লক্ষ লক্ষ প্রাণহানি ঘটিয়েছে৷ অন্য দিকে অভূতপূর্ব বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার আরও তীব্রতা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ ছাঁটাই ও বেকারত্বের আক্রমণে ক্ষুধার্ত ও মৃত্যুমুখী৷ এই দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে মহান নভেম্বর বিপ্লবের ১০৩তম বার্ষিকীর আবেদন আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে৷
এক কথায় সমগ্র মানবজাতি আজ এক অভূতপূর্ব সংকটের সম্মুখীন৷ এটা সুস্পষ্ট যে, যদি সাম্রাজ্যবাদী–পুঁজিবাদী শাসকবর্গ তাদের অর্থনৈতিক মুনাফার স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দ্রুততার সাথে ব্যবস্থা নিত এবং ক্রমবর্ধমান সামরিক খাতে ব্যয়বৃদ্ধি সংকোচন করে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বাড়াত, তা হলে এই মারণ ভাইরাসের এত ব্যাপক ভাবে ছড়ানো এবং এত বিপুল সংখ্যক প্রাণহানি এড়ানো যেত৷
এটাও জানা, অর্থনৈতিক মন্দা এবং তজ্জনিত সংকটগুলি সাম্রাজ্যবাদী–পুঁজিবাদী অর্থনীতিরই অনিবার্য পরিণতি৷ কারণ পুঁজিপতি শ্রেণি, একচেটিয়া পুঁজিপতিরা এবং বহুজাতিক সংস্থাগুলি সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের স্বার্থে তাদের শোষণযন্ত্রে কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষকে নিষ্পেষিত করে সর্বাধিক শোষণ চালায়৷ বহু যুগ আগেই মহান মার্কস–এঙ্গেলস বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ করে পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই বিধ্বংসী পরিণতির অনিবার্যতা সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দিয়ে বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ হতে, বিপ্লব সংঘটিত করতে এবং পুঁজিবাদ উচ্ছেদ করে কমিউনিজমের প্রথম পর্যায় অর্থাৎ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছিলেন৷
মহান লেনিন ও স্ট্যালিন নভেম্বর বিপ্লব সংঘটিত করে এই ঐতিহাসিক লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করেছিলেন এবং মানব ইতিহাসে প্রথম এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা ছিল সর্বপ্রকার শোষণ ও অত্যাচার মুক্ত৷ মার্কসবাদ–লেনিনবাদের সুনির্দিষ্ট প্রয়োগের ভিত্তিতে এই সমাজতান্ত্রিক সমাজ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে এতই উন্নত হয়েছিল যে, তা সকলের জন্য কর্মসংস্থান করতে পেরেছিল৷ দেশ থেকে বেকারত্ব, ক্ষুধা, ভিক্ষাবৃত্তি ও পতিতাবৃত্তি অবলুপ্ত করেছিল, জাতি–জনজাতি–ধর্মগত সংঘর্ষ এবং নারী–পুরুষের অসাম্যের অবসান ঘটিয়েছিল৷ সস্তায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করার বন্দোবস্ত করেছিল এবং শ্রমজীবী জনগণের জন্য স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের পূর্ণ সুযোগ দিয়েছিল৷ প্রত্যেকের জন্য বিনা ব্যয়ে শিক্ষা ও চিকিৎসার বন্দোবস্ত করেছিল৷ এই সমাজতান্ত্রিক দেশই বিশ্বে অস্ত্র উৎপাদন, উপনিবেশ দখল ও যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব দিয়েছিল৷ উপনিবেশ ও আধা উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিসংগ্রামকে এই সমাজতান্ত্রিক দেশ সাহায্য করেছিল৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভয়াবহ ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পরাস্ত করে মানবসভ্যতাকে রক্ষায় এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রই বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল৷
বস্তুত সমগ্র পশ্চিমী পুঁজিবাদী সভ্যতা যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত, তখন পূর্ব দিগন্তে উষালগ্ন হিসাবে এই নতুন সমাজতান্ত্রিক সভ্যতার অভ্যুদ্বয় ঘটেছিল, যাকে শুধু বিশ্বের শোষিত জনগণ আশার আলো হিসাবে দেখেছিল তাই নয়, এই নতুন সভ্যতা পশ্চিমী দেশ ও উপনিবেশগুলির মহান মানবতাবাদীদের দ্বারাও অভিনন্দিত হয়েছিল৷
কিন্তু ইতিহাসে খুবই বেদনাদায়ক ঘটনা এই, যে নতুন সভ্যতা কয়েক যুগ ধরে মানবকল্যাণে কাজ করেছে, স্ট্যালিন পরবর্তীকালের নেতৃত্বের কিছু নির্দিষ্ট গুরুতর ভুল ও বিচ্যুতির সুযোগ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা পুঁজিবাদী শত্রুরা বিশ্বসাম্রাজ্যবাদীদের মদত নিয়ে প্রতিবিপ্লব সংঘটিত করে এই সমাজতন্ত্রকে ধ্বংস করে পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে৷
অবশ্য প্যারি কমিউনের পতনের শিক্ষা যেমন মার্কসবাদকে সমৃদ্ধ করে নভেম্বর বিপ্লবকে গাইড করেছে তেমনই রাশিয়ায় প্রতিবিপ্লবের কারণ সম্পর্কে যে–সব মূল্যবান শিক্ষা মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, সেগুলিও আগামী দিনের সর্বহারা শ্রেণির বিপ্লবী আন্দোলনকে গাইড করবে৷
বর্তমানে বিশ্বপরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ ও মর্মান্তিক৷ বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ–পুঁজিবাদ মৃত্যুশয্যায় শায়িত, কিন্তু এখনও মৃত নয়৷ কারণ কোনও সমাজ ব্যবস্থারই আপনা–আপনি মৃত্যু ঘটে না৷ এটা প্রায় পচাগলা শবদেহের মতো জীবনের সর্বক্ষেত্রে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে৷
এ ভাবে আজ পুঁজিবাদ অর্থনৈতিক, আদর্শগত, রাজনৈতিক, নৈতিক– সব দিক দিয়ে মানবজাতিকে সর্বাত্মক ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে৷ পুনরায় আর একটা সমাজ–বিপ্লবের সম্ভাবনায় আতঙ্কিত হয়ে পুঁজিবাদের রক্ষকরা, ভাড়া–করা রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদরা দিবারাত্র পরিশ্রম করে যাচ্ছে যাতে মৃতপ্রায় রোগীকে বাঁচানোর জন্য কোনও দাওয়াই খুঁজে পায়৷ কিন্তু তারা বৃথাই অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছে৷
অন্য দিকে ফ্যাসিস্ট পুঁজিবাদী শাসকবর্গের নির্মম দমন–পীড়ন সত্ত্বেও বিশ্বের নানা প্রান্তে জনগণের প্রতিবাদের উত্তাল ঢেউ বারবার মাথা তুলছে৷ যতই নিষ্ঠুর ও নৃশংস দমন বাড়ছে ততই সকল আক্রমণ অগ্রাহ্য করে গণবিক্ষোভ ফেটে পড়ছে৷ অত্যাচারিত জনগণ আজ নির্ভীক, সাহসী ও সংগ্রামী৷ তারা পরিবর্তন চায়৷ কিন্তু তাদের সামনে বিপ্লবী আদর্শ, উন্নত সংস্কৃতি বা, সংগঠন ও নেতৃত্ব নেই৷ ফলে এই মুহূর্তে সর্বাধিক প্রয়োজন, সকল দেশেই মার্কসবাদ–লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারাকে হাতিয়ার করে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী দল গড়ে তোলা ও শক্তিশালী করা, যাতে নভেম্বর বিপ্লবের ঐতিহাসিক আহ্বানকে কার্যকর করা যায়৷
মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ প্রতিষ্ঠিত এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দলের বিপ্লবী যোদ্ধা হিসাবে আমাদের এই পরিস্থিতিতে ঐতিহাসিক কর্তব্য হল, দেশের অভ্যন্তরে দলের বিস্তার ও সংহতি ঘটানো, উন্নত বৈপ্লবিক আদর্শ ও সর্বহারা সংস্কৃতির ভিত্তিতে শ্রেণি সংগ্রাম ও গণআন্দোলন সংগঠিত করা ও তীব্রতর করা এবং এ সবের দ্বারা অন্যান্য দেশের সর্বহারা শ্রেণিকে অনুপ্রাণিত, শিক্ষিত ও সহায়তা করা৷ আমাদের কাছে মহান নভেম্বর বিপ্লবের ১০৩তম বার্ষিকী এই আহ্বানই জানাচ্ছে৷