মানবমুক্তির দর্শন হিসাবে মার্কবাদকে জানতে ও বুঝতে দলের মধ্যে আদর্শগত চর্চার যে ধারাবাহিক প্রক্রিয়া চলছে তার সহায়ক হিসাবে আমরা কার্ল মার্কসের জীবন ও মার্কসবাদ সম্পর্কিত লেনিনের লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছি। এবার চতুর্থ কিস্তি।
(৪)
উদ্বৃত্ত মূল্য
পণ্য উৎপাদনের বিকাশের একটা বিশেষ স্তরে টাকা (মানি) রূপান্তরিত হয় পুঁজিতে। পণ্য চলাচল বা সঞ্চালনের সূত্র ছিলঃ পণ্য-অর্থ-পণ্য, অর্থাৎ একটি পণ্য কেনার জন্যে অন্য পণ্য বিক্রি করা। অন্য দিকে, পুঁজির সাধারণ সূত্র হলঃ অর্থ-পণ্য-অর্থ। অর্থাৎ পণ্য কেনা হচ্ছে বিক্রির জন্য (মুনাফা সহ)। সঞ্চালনে ঢালা টাকার প্রাথমিক মূল্যের ওপর যে বৃদ্ধি ঘটে, মার্কস তাকেই বলেছেন উদ্বৃত্ত মূল্য। পুঁজিবাদী সঞ্চালন ব্যবস্থায় টাকার এই ‘বৃদ্ধির’ ঘটনাটা সকলের জানা। বস্তুত, এই বৃদ্ধিই ঐতিহাসিক ভাবে নির্ধারিত বিশেষ একটি সামাজিক উৎপাদন-সম্পর্ক হিসাবে টাকাকে পুঁজিতে রূপান্তরিত করে। পণ্যের সঞ্চালন থেকে উদ্বৃত্ত মূল্যের সৃষ্টি হতে পারে না, কেন না পণ্য সঞ্চালনে শুধু তুল্যমূল্যেরই বিনিময় ঘটে থাকে। দাম বাড়িয়ে দিলেও উদ্বৃত্ত মূল্যের সৃষ্টি হতে পারে না। কেন না ক্রেতা ও বিক্রেতার একজনের লাভ, অপরের লোকসান পরস্পর সমান হয়ে যায়। যদিও বিষয়টা ব্যক্তিগত নয়, একটা ব্যাপকতর, গড় এবং সামাজিক ঘটনা। উদ্বৃত্ত মূল্য পেতে হলে ‘টাকার মালিককে অবশ্যই বাজারে এমন একটি পণ্য উপস্থিত করতে হবে, যার ব্যবহার-মূল্যটাই মূল্যের উৎস হবার মতো একটা স্বকীয় গুণের অধিকারী’ (৩৪)– তাকে হতে হবে এমন একটি পণ্য, যাকেভোগ করার প্রক্রিয়াটাই হল একই সাথে মূল্যসৃষ্টির প্রক্রিয়া। আর এরকম পণ্য সত্যিই আছে– তা হল মানুষের শ্রমশক্তি। তার ভোগ মানে শ্রম, এবং শ্রম থেকেই মূল্যের সৃষ্টি। টাকার মালিক শ্রমশক্তি কেনে তার মূল্য দিয়ে। অন্যান্য পণ্যের মূল্যের মতোই শ্রমশক্তির মূল্য নির্ধারিত হয় তার উৎপাদনের জন্যে সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমসময় দিয়ে (যা হল সপরিবারে শ্রমিকের ভরণপোষণের খরচ)। শ্রমশক্তি ক্রয়ের পর অর্থের মালিক তা ভোগ করার, অর্থাৎ সারাদিনের জন্যে, ধরা যাক, বারো ঘন্টার জন্যে তাকে খাটাবার অধিকার অর্জন করে। অথচ নিজের ভরণপোষণের খরচ তোলার মতো উৎপাদন শ্রমিক করছে ছয় ঘণ্টার মধ্যেই (‘প্রয়োজনীয়’ শ্রমসময়) এবং বাকি ছয় ঘণ্টায় (‘বাড়তি’ শ্রমসময়) সে তৈরি করছে ‘বাড়তি’ উৎপাদন অথবা উদ্বৃত্ত মূল্য, যার জন্য পুঁজিপতি কোনও দাম দেয় না। অতএব উৎপাদনপ্রক্রিয়ার দিক থেকে দেখলে পুঁজিকে দু’ভাগে ভাগ করে দেখতে হবেঃ স্থায়ী পুঁজি, যা ব্যয় হচ্ছে উৎপাদনের উপকরণসমূহের পেছনে (মেশিনপত্র, শ্রমের যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ইত্যাদি)–পুঁজির এই অংশের মূল্যের কোনও বদল না হয়ে তা সম্পূর্ণরূপে (একসঙ্গে অথবা ভাগে ভাগে) উৎপন্ন সামগ্রীর মধ্যে এসে জমা হয়। অন্য অংশটি হল পরিবর্তনশীল পুঁজি, যা ব্যয় হয় শ্রমশক্তির জন্য। শেষোক্ত পুঁজির মূল্য অপরিবর্তিত থাকে না, শ্রমপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তা বেড়ে ওঠে এবং সৃষ্টি করে উদ্বৃত্ত মূল্য। সুতরাং, পুঁজি কর্তৃক শ্রমশক্তি শোষণের মাত্রা প্রকাশ করতে হলে উদ্বৃত্ত মূল্যের সঙ্গে পুরো পুঁজির তুলনা না করে তুলনা করতে হবে কেবল পরিবর্তনশীল পুঁজির। এ হিসেবে, পূর্বোক্ত উদাহরণে এই অনুপাত, মার্কস যার নাম দিয়েছেন উদ্বৃত্ত মূল্যের হার, হবে ৬ ৬, অর্থাৎ শতকরা ১০০ ভাগ।
পুঁজি সৃষ্টির ঐতিহাসিক পূর্বশর্ত হল, প্রথমত, সাধারণভাবে পণ্য-উৎপাদনের অপেক্ষাকৃত উচ্চস্তরে কিছু ব্যক্তির় হাতে কিছু পরিমাণ অর্থ সঞ্চিত হওয়া এবং দ্বিতীয়ত, এমন শ্রমিকের অস্তিত্ব যে দুটি অর্থে ‘মুক্ত’: শ্রমশক্তি বিক্রয়ের পথে সব রকমের বাধানিষেধ থেকে মুক্ত এবং জমি ও সাধারণভাবে উৎপাদনের সব রকমের উপকরণ থেকেও মুক্ত। পিছুটানহীন স্বাধীন শ্রমজীবী একজন ‘সর্বহারা’, নিজের শ্রমশক্তি বিক্রয় ছাড়া যার জীবিকা নির্বাহের অন্য কোনও উপায় নেই।
উদ্বৃত্ত মূল্য বাড়িয়ে তোলার দুটি মূল পদ্ধতি আছে ঃ শ্রমদিনের দৈর্ঘ্য বাড়ানো (‘পরম বা অ্যাবসোলিউট উদ্বৃত্ত মূল্য’) এবং প্রয়োজনীয় শ্রমসময় কমানো (‘আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত মূল্য’)। প্রথম পদ্ধতির বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে মার্কস তুলে ধরেছেন একদিকে শ্রমদিনের সময় কমানোর জন্যে শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামকে। পাশাপাশি তুলে ধরেছেন, চতুর্দশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত শ্রমসময় বাড়ানো এবং উনিশ শতকে ফ্যাক্টরি আইন অনুযায়ী শ্রমসময় কমানোর জন্য সরকারি হস্তক্ষেপের এক বিপুল চিত্র। ‘পুঁজি’ বইখানি প্রকাশের পর বিশ্বের সমস্ত সভ্য দেশের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস হাজার হাজার নতুন তথ্য যুগিয়েছে এ চিত্রকে পূর্ণতা দিতে।
আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদনের বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে মার্কস পুঁজিবাদে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির তিনটি মূল ঐতিহাসিক পর্যায় আলোচনা করেছেনঃ ১) সরল সহযোগিতা, ২) শ্রমবিভাগ ও হস্তশিল্প কারখানা (ম্যানুফ্যাকচার), ৩) মেশিনপত্র ও বৃহদাকার শিল্প। পুঁজিবাদী বিকাশের বুনিয়াদী ও বৈশিষ্ট্যসূচক দিকগুলির কত গভীর বিশ্লেষণ মার্কস এখানে করেছেন তা বোঝা যায় রাশিয়ার ‘কুটিরশিল্প’ বলে যা পরিচিত তার অনুসন্ধান থেকে। এর মধ্য দিয়ে পুঁজিসৃষ্টির প্রথম দুটি পর্যায়ের বহু তথ্য সমৃদ্ধ উদাহরণ পাওয়া যায়। বৃহদাকার যন্ত্রশিল্পের যে বৈপ্লবিক প্রভাবের কথা মার্কস ১৮৬৭ সালে লিখেছিলেন, তা পরবর্তী অর্ধ-শতাব্দীর মধ্যে একাধিক ‘নতুন’ দেশে (রাশিয়া, জাপান ইত্যাদি) সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
মার্কসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং নতুন অবদানটি হল কী ভাবে পুঁজি সঞ্চয়ের প্রক্রিয়াটি, অর্থাৎ উদ্বৃত্ত মূল্যের একটি অংশ পুঁজিপতির ব্যক্তিগত প্রয়োজনে খেয়ালখুশি মতো ব্যবহৃত না হয়ে কী ভাবে নতুন উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হয় তার বিশ্লেষণ উপস্থিত করা। পুঁজিতে রূপান্তরিত উদ্বৃত্ত মূল্যের পুরোটাই পরিবর্তনশীল পুঁজি সৃষ্টির কাজে ব্যবহৃত হয় বলে ধরে নিয়ে আগেকার সমস্ত চিরায়ত রাজনৈতিক-অর্থনীতিবিদরা (অ্যাডাম স্মিথকে দিয়ে যার শুরু) যে ভুল করেছিলেন, মার্কস তা ধরিয়ে দিয়েছিলেন। বাস্তবে সেটা উৎপাদনের উপকরণ এবং পরিবর্তনশীল পুঁজি, এই দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। (মোট পুঁজির ভেতরে) পরিবর্তনশীল পুঁজির অংশটার তুলনায় স্থায়ী পুঁজির অংশটার দ্রুততর বৃদ্ধি পুঁজিবাদের বিকাশের প্রক্রিয়া এবং সমাজতন্তে্র তার রূপান্তরের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
শ্রমিকের বদলে যন্ত্র নিয়োগের গতিকে ত্বরান্বিত করে এবং সমাজের এক প্রান্তে বিপুল বৈভব এবং অন্য প্রান্তে চরম দারিদ্র সৃষ্টি করে পুঁজির সঞ্চয় বাড়িয়ে তোলে যাকে বলা যায়, ‘শ্রমের মজুত বাহিনী’, শ্রমিকের ‘আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত’ অথবা ‘পুঁজিবাদী অতিরিক্ত জনসংখ্যা’, যা বিভিন্ন রূপ ধারণ করে এবং পুঁজিকে চূড়ান্ত দ্রুত হারে উৎপাদনের প্রসার ঘটাবার সুযোগ করে দেয়। এই ঘটনা এবং সেই সঙ্গে ঋণ পাওয়ার সুবিধা ও উৎপাদনের উপকরণরূপে পুঁজির যে সঞ্চয় তা থেকে অতি-উৎপাদনের সংকটকেবোঝার সূত্র পাওয়া যাবে। এই অতি-উৎপাদনজনিত সংকট পুঁজিবাদী দেশে প্রথমে দেখা দিত পর্যায়ক্রমে গড়ে প্রতি দশ বছর অন্তর, পরবর্তীকালে তা আসে আরও দীর্ঘ ও অনির্দিষ্ট ব্যবধানে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজি সঞ্চয়ের বিষয়টিকে পুঁজির আদি সঞ্চয়ের থেকে আমাদের আলাদা করা উচিত। পুঁজি সঞ্চয়ের উৎস হল, উৎপাদনের উপকরণ থেকে জোর করে শ্রমজীবীদের বিচ্ছেদ ঘটানো, জমি থেকে চাষিকে বিতাড়ন, গ্রামসমাজের জমি আত্মসাৎ করা, উপনিবেশ স্থাপন ও গোটা জাতিকে ঋণগ্রস্ত করা, শুল্কের বেড়ায় সংরক্ষণ ইত্যাদি। ‘প্রারম্ভিক সঞ্চয়’ থেকে সমাজের এক প্রান্তে সৃষ্টি হয় ‘মুক্ত’ সর্বহারা এবং অন্য প্রান্তে অর্থের মালিক–পুঁজিপতি।
‘পুঁজিবাদী সঞ্চয়ের ঐতিহাসিক প্রবণতা’ সম্পর্কে মার্কসের সুপ্রসিদ্ধ বিশ্লেষণটি হল, ‘প্রত্যক্ষ উৎপাদকদের উচ্ছেদ সম্পন্ন হয় নৃশংসতম বর্বরতায়, তীব্র রোষে হীন জঘন্যতম প্রবৃত্তির তাড়নায় চলে এই উচ্ছেদ। নিজের উপার্জনে সৃষ্ট ব্যক্তিসম্পত্তি (কৃষক ও হস্তশিল্পীদের) আলাদা আলাদা স্বাধীন শ্রমজীবীদের সঙ্গে তাদের শ্রমের হাতিয়ার ও উপকরণসমূহের বলা যায়, অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে যা গড়ে উঠেছিল, তার স্থান গ্রহণ করে পুঁজিবাদী ব্যক্তিগত সম্পত্তি, যা অন্যদের নামেই-স্বাধীন শ্রমশক্তি শোষণের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকে … এখন যাদের উচ্ছেদ করতে হবে তারা স্বাধীনবৃত্তিধারী শ্রমজীবীনয়, আজ এসেছে বহু শ্রমিককে শোষণ করছে এমন পুঁজিবাদীদেরই উচ্ছেদ করার পালা। এই উচ্ছেদ সম্পন্ন হবে পুঁজিবাদী উৎপাদনেরই অন্তর্নিহিত নিয়মগুলির ক্রিয়ায়, পুঁজির কেন্দ্রীভবনের মাধ্যমে। অনেক পুঁজিপতিকে খতম করে একজন পুঁজিপতি। মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি কর্তৃক বহু পুঁজিপতিকে উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে এই কেন্দ্রীভবন আরও বেশি বেশি হতে থাকে। এর ফলে বিকশিত হতে থাকে শ্রমপ্রক্রিয়ার সমবায়মূলক রূপ, সচেতনভাবে প্রযুক্তি-বিজ্ঞানের প্রয়োগ, ভূমির পরিকল্পিত সদ্ব্যবহার, শ্রমের উপকরণগুলির এমন রূপান্তর যাতে তা শুধু যৌথ-শ্রমপদ্ধতিতেই ব্যবহার করা সম্ভব। একইসাথে উৎপাদনের উপকরণগুলি যত বেশি সমষ্টিকৃত সামাজিক শ্রমের উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে, তত তা অধিক ফলদায়ী হয়ে ওঠে। বিশ্ববাজারের জালে সমস্ত জাতিকে জড়িয়ে ফেলা হয়, আর সেই সঙ্গে গড়ে ওঠে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আন্তর্জাতিক চরিত্র। এই রূপান্তর প্রক্রিয়ার সবকিছু সুফল যারা দখল করে, একেচটিয়া ভাবে ভোগ করে, পুঁজির সেই সব রাঘব বোয়ালরা সংখ্যায় ক্রমাগত কমতে থাকে, সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে জনগণের দুর্দশা, নিপীড়ন, দাসত্ব, অধঃপতন ও শোষণের ব্যাপকতা। কিন্তু তার সঙ্গেই বাড়তে থাকে শ্রমিক শ্রেণির বিদ্রোহ। যে শ্রেণি ক্রমাগত বেড়ে চলে, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার প্রক্রিয়ার কল্যাণেই তারা শিক্ষিত ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত হয়ে ওঠে। পুঁজির একচেটিয়া মালিকানা যা পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার অধীনেই গড়ে ওঠে এবং বিকশিত হয়, তা শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার পায়ের শৃঙ্খলে পরিণত হয়। উৎপাদনের উপকরণের কেন্দ্রীভবন এবং শ্রমের সামাজিকীকরণ এমন একটা মাত্রায় গিয়ে পৌঁছয় যখন তার সঙ্গে আর পুঁজিবাদী সমাজের আধারটা খাপ খায় না। আধারটা ফেটে যায়। পুঁজিবাদী ব্যক্তিগত সম্পত্তির মৃত্যুঘণ্টা বাজে। অবশেষে উচ্ছেদ করা হয় উচ্ছেদকারীদের’ (পুঁজি’, খণ্ড ১) (৩৫)।
সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অভিনব হল মোট সামাজিক পুঁজির পুনরুৎপাদন বিষয়ে পুঁজি’র দ্বিতীয় খণ্ডে প্রদত্ত মার্কসের বিশ্লেষণ। এ ক্ষেত্রেও মার্কস একক ঘটনা ধরে বিচার না করে বিস্তৃত ঘটনা ধরে বিচার করেছেন। সমাজের অর্থনীতির একটা ভগ্নাংশকে ধরে নয়, সমগ্রভাবে পুরো অর্থনীতির ভিত্তিতে বিচার করেছেন। চিরায়ত অর্থনীতিবিদদের পূর্বোক্ত ভ্রান্তি সংশোধন করে মার্কস সমগ্র সামাজিক উৎপাদনকে ভাগ করেছেন দুটি বৃহৎ ভাগেঃ ১) উৎপাদনের উপকরণসমূহের উৎপাদন ২) ভোগ্য বস্তুর উৎপাদন, এবং পূর্ব পরিমাণে পুনরুৎপাদন ও সঞ্চয়– এই দুটি ক্ষেত্রে সমস্ত সামাজিক পুঁজির মোট সঞ্চালন বিষয়ে সংখ্যাগত দৃষ্টান্ত তুলে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। মূল্যের নিয়মকে ভিত্তি করে কীভাবে মুনাফার গড় হার সৃষ্টি হয়– সেই সমস্যার সমাধান দেখানো হয়েছে ‘পুঁজি’ বইটির তৃতীয় খণ্ডে। অর্থনৈতিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মার্কস যে বৃহৎ অগ্রগতি ঘটিয়েছেন সেটা হল এই যে, প্রচলিত রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র অথবা সাম্প্রতিক প্রান্তিক উপযোগিতার তত্ত্ব’ (থিওরি অফ মার্জিনাল ইউটিলিটি) (৩৬) যেভাবে বিচ্ছিন্ন ঘটনা অথবা প্রতিযোগিতার বাহ্যিক অগভীর দিকগুলিতেই মূলত সীমাবদ্ধ থাকে, মার্কস সে রকম কোনও দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ না করে বিশ্লেষণ করেছেন ব্যাপক অর্থনৈতিক ঘটনাবলি বিচারের ভিত্তিতে সামাজিক অর্থনীতিকে সামগ্রিকভাবে বিচার করার দৃষ্টিকোণ থেকে। অর্থনৈতিক বিজ্ঞানের বিশাল অগ্রগতিতে এই হল মার্কসের সুনির্দিষ্ট অবদান। মার্কস প্রথমে বিশ্লেষণ করেছেন কী ভাবে উদ্বৃত্ত মূল্যের সৃষ্টি হয়, এবং তারপরে পর্যালোচনা করেছেন তা কী ভাবে মুনাফা, সুদ ও ভূমি-খাজনায় ভাগ হয়ে যায়। মুনাফা হল কারবারে ঢালা মোট পুঁজির তুলনায় বাড়তি মূল্যের অনুপাত। যে পুঁজির ‘আঙ্গিক বহর বড়’ (হাই অর্গানিক কম্পোজিশন) (অর্থাৎ পরিবর্তনশীল পুঁজির তুলনায় স্থায়ী পুঁজির পরিমাণ যেখানে সামাজিক গড়পড়তা অনুপাতের চেয়ে বেশি) তার মুনাফার হার গড়পড়তা হারের চেয়ে কম। যে পুঁজির ‘আঙ্গিক বহর ছোট’ তার মুনাফার হার গড়পড়তা হারের চেয়ে বেশি। পুঁজিপতিদের মধ্যে প্রতিযোগিতা এবং এক শাখা থেকে অন্য শাখায় স্বাধীনভাবে পুঁজির চলাচলের ফলে উভয় ক্ষেত্রেই মুনাফার হার গড় হারের আশেপাশে হয়। কোনও একটি সমাজে সমস্ত পণ্যের মোট মূল্য সমস্ত পণ্যের মোট দামের সমান হয়। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন কারবারে এবং উৎপাদনের ভিন্ন ভিন্ন শাখায় প্রতিযোগিতার দরুন পণ্য তার যথাযথ মূল্যে বিক্রয় হয় না, বিক্রয় হয় উৎপাদনের দাম (অথবা উৎপাদন-দাম) অনুসারে, যা ব্যয়িত পুঁজির সঙ্গে গড় মুনাফার যোগফল।
এইভাবে মার্কস মূল্য ওদামের পার্থক্য এবং মুনাফার সমতার সুবিদিত ও তর্কাতীত ঘটনাটিকে সামগ্রিকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন মূল্যের নিয়মকে ভিত্তি করে। তিনি দেখিয়েছেন, সমস্ত পণ্যের মোট মূল্য তার মোট দামের সঙ্গে সমান। কিন্তু মূল্যের (যা সামাজিক) সঙ্গে দামের (যা বিশেষ) সমীকরণ অবশ্য সরলভাবে ও সোজাসুজি হয় না, হয় অতি জটিল এক পদ্ধতিতে। যে সমাজে আলাদা আলাদা পণ্যোৎপাদকদের মধ্যে কেবলমাত্র বাজারের মারফতই মিলন সম্ভব, সেখানে খুবই স্বাভাবিক যে, সামাজিক নিয়মবদ্ধতার সঙ্গে সামঞ্জস্য সম্ভব গড়পড়তা ভাবে। সেখানে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে কিছু হেরফের থাকলেও তা পরস্পর পরিপূরক হয়ে যায়।
শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির অর্থ পরিবর্তনশীল পুঁজির তুলনায় স্থায়ী পুঁজির দ্রুততর বৃদ্ধি। উদ্বৃত্ত মূল্য যেহেতু সৃষ্টি হয় শুধুমাত্র পরিবর্তনশীল পুঁজি থেকে, তাই এ কথা খুবই পরিষ্কার যে, মুনাফার হার (শুধু পরিবর্তনশীল পুঁজির সঙ্গে নয়, সমগ্র পুঁজির সঙ্গে উদ্বৃত্ত মূল্যের অনুপাত) এই অবস্থায় ক্রমশ কমে যাবার ঝোঁক দেখায়। এই ঝোঁক এবং যে কারণে এই ঝোঁকটা আড়ালে থাকে অথবা তা বাধা পায়, এ নিয়ে মার্কস বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন। পুঁজির তৃতীয় খণ্ডে সুদখোর পুঁজি, বাণিজ্যিক পুঁজি ও অর্থ হিসাবে পুঁজি বিষয়ে অসাধারণ চিত্তাকর্ষক যেসব অধ্যায় আছে তার বিবরণ দেওয়ার জন্য না থেমে এবার সবচেয়ে প্রধান বিষয়– ভূমি-খাজনার তত্তে্ব চলে আসা যাক। যেহেতু ভূমিক্ষেত্রের পরিমাণ সীমিত এবং পুঁজিবাদী দেশে তা পুরোপুরি আলাদা আলাদা মালিকের অধিকারে থাকে, সে জন্য কৃষিপণ্যের দাম তার উৎপাদন-খরচ দিয়ে স্থির হয় এবং তা হয় সর্বনিকৃষ্ট মানের জমিতে উৎপাদনের খরচের ভিত্তিতে, গড়পড়তা সাধারণ মানের জমিতে উৎপাদনের খরচের ভিত্তিতে নয়। একই ভাবে উৎপন্ন সামগ্রী বাজারজাত করতে সবচেয়ে খারাপ যে ব্যবস্থা উৎপাদন খরচের সাথে যুক্ত হয় সেটাই, গড়পড়তা সাধারণ যে সরবরাহ ব্যবস্থা তার খরচের ভিত্তিতে কৃষিতে উৎপাদিত সামগ্রীর দাম নির্ধারণ হয় না। এই ভাবে নির্ধারিত ফসলের দামের সঙ্গে উন্নততর জমিতে (কিংবা উন্নততর অবস্থায়) উৎপাদনের দামের তফাতই গড়ে দেয় খাজনার পার্থক্য (ডিফারেন্সিয়াল রেন্ট)। এই বিষয়টা বিশদভাবে বিশ্লেষণ করে মার্কস দেখিয়েছেন, ভূমিখণ্ডের উর্বরতার পার্থক্য ও তাতে যে পরিমাণ পুঁজি ঢালা হয়েছে তার পার্থক্যের উপর নির্ভর করে ভূমির খাজনার পার্থক্য তৈরি হয়। মার্কস এই বিষয়টির সবিস্তার বিশ্লেষণ উপস্থিত করে এ বিষয়ে রিকার্ডোর ভ্রান্তি– উৎপাদককে ক্রমান্বয়ে ভাল জমি থেকে একেবারে খারাপ জমিতে সরে যেতে হলেই একমাত্র ভূমি-খাজনার পার্থক্য ঘটে– তার নিরসন করলেন (‘উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব’ দ্রষ্টব্য, তাতে রডবের্টুসকে যে সমালোচনা করা হয়েছে তা বিশেষ করে লক্ষণীয়)। যদিও এর বিপরীত ধরনের পরিবর্তনও ঘটে, এক ধরনের জমি রূপান্তরিত হয় অন্য ধরনের জমিতে (কৃষি যন্ত্রপাতির অগ্রগতি, শহরের বিস্তার ইত্যাদি কারণে)। মার্কস আরও দেখালেন ‘ভূমির ক্রমহ্রাসমান উর্বরতার’ কুখ্যাত ‘নিয়মটি’ চরম ভুল, এর মাধ্যমে পুঁজিবাদের ত্রুটি, সীমাবদ্ধতা, দ্বন্দ্বের দায় চাপানো হয়েছে প্রকৃতির ঘাড়ে। অধিকন্তু, শিল্পের এবং সাধারণভাবে জাতীয় অর্থনীতির সমস্ত শাখায় মুনাফার সমতাসাধনের কথা বললে ধরে নিতে হয় প্রতিযোগিতার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে এবং এক শাখা থেকে অন্য শাখায় পুঁজির অবাধ চলাচল ঘটছে। অথচ জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা একচেটিয়া অধিকার গড়ে তোলে এবং তাতে এই অবাধ চলাচল ব্যাহত হয়। কৃষি উৎপাদনের বৈশিষ্ট্য হল তার পুঁজির আঙ্গিক বহর ছোট, সুতরাং ব্যক্তিগত মুনাফার হার উচ্চতর। কিন্তু এই একচেটিয়া অধিকারের ফলে কৃষিদ্রব্য মুনাফার হারের সমতাসাধনের পরিপূর্ণ স্বাধীন প্রক্রিয়াটির অন্তর্ভুক্ত হয় না। জমির মালিক একচেটিয়া-অধিকারী হিসেবে গড়পড়তার চেয়ে বেশি দাম ধরার সুযোগ পায় আর এই একচেটিয়া দাম থেকেই জন্ম নেয় শর্তহীন খাজনা (অ্যাবসোলিউট রেন্ট)। পুঁজিবাদের আওতায় পার্থক্যযুক্ত খাজনার অবসান ঘটানো সম্ভব নয়। কিন্তু শর্তহীন খাজনার অবসান সম্ভব– যেমন, জমির জাতীয়করণ হলে, রাষ্টে্র্রর সম্পত্তিতে তার রূপান্তর ঘটলে। এইরকম রূপান্তরের অর্থ হবে ব্যক্তিগত সম্পত্তি-মালিকের একচেটিয়া অধিকার বিলোপ এবং কৃষির ক্ষেত্রে অধিকতর সুসঙ্গত ও পূর্ণতর স্বাধীন প্রতিযোগিতার প্রবর্তন। সেই জন্যেই মার্কস বলেছেন, ইতিহাসে র্যাডিকাল বুর্জোয়ারা জমি জাতীয়করণের এই প্রগতিশীল বুর্জোয়া দাবিটিকে একাধিক বার উত্থাপন করেছে, কিন্তু অধিকাংশ বুর্জোয়াই তাতে ভয় পায়, কেন না তাতে ‘বেশ জোরে ধাক্কা লাগে’ আর এক ধরনের একচেটিয়া অধিকারে, যা আমাদের কালে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ও ‘স্পর্শকাতর’ আর এক ধরনের একচেটিয়া অধিকার– সাধারণভাবে উৎপাদনের উপকরণগুলির ওপর একচেটিয়া অধিকার। (১৮৬২ সালের ২ আগস্ট এঙ্গেলসের কাছে লেখা একটি পত্রে মার্কস পুঁজির ওপর মুনাফার গড় হার এবং শর্তনিরপেক্ষ ভূমি-খাজনা সম্পর্কে তাঁর তত্ত্বকে আশ্চর্য জনবোধ্য, সংক্ষিপ্ত ও পরিষ্কার করে পেশ করেছিলেন (পত্রাবলি, খণ্ড ৩ দ্রষ্টব্য, ১৮৬২ সালের ৯ আগস্টের পত্রটিও তুলনীয়, ঐ)।
ভূমি-খাজনার ইতিহাসের ক্ষেত্রেও মার্কসের বিশ্লেষণ উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ। মার্কস দেখিয়েছেন, কী করে শ্রম-খাজনা (চাষি যখন জমিদারের জমিতে নিজের মেহনতে বাড়তি উৎপন্ন সৃষ্টি করছে) রূপান্তরিত হচ্ছে ফসল বা সামগ্রী হিসেবে প্রদত্ত খাজনায় (চাষি যখন তার নিজের জমিতে বাড়তি উৎপন্ন তৈরি করছে এবং জমিদারকে দিচ্ছে ‘অর্থনীতিবহির্ভূত বাধ্যতার’ জন্যে), তারপর মুদ্রা-খাজনায় (পণ্য-উৎপাদনের বিকাশের ফলে মুদ্রায় পরিণত ফসলি খাজনা যেমন, সেকেলে রাশিয়ার ‘অব্রক’– স্বাধীন চাষি বা জমি ব্যবহারকারীরা কর্তৃপক্ষ বা সরকারকে যে খাজনা দেনঃ গণদাবী) এবং পরিশেষে পুঁজিবাদী খাজনায়, যখন চাষির বদলে আসছে কৃষি-ব্যবসায়ী যে চাষ করায় মজুরি-শ্রমের সাহায্যে। ‘পুঁজিবাদী ভূমি-খাজনার উদ্ভবের’ এই বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে কৃষিতে পুঁজিবাদের বিবর্তন সম্পর্কে মার্কসের কয়েকটি সুগভীর (এবং রাশিয়ার মতো পশ্চাদ্বর্তী দেশগুলির পক্ষে অতি গুরুত্বপুর্ণ) ধারণা উল্লেখযোগ্য। ‘ফসলি খাজনা যখন মুদ্রা-খাজনায় রূপান্তরিত হয়, তখন তার আবশ্যিক সঙ্গী হিসাবে শুধু নয়, এমনকি আগে থেকেই সৃষ্টি হয় সম্পত্তিহীন দিনমজুরের একটি শ্রেণি, যারা মজুরি নিয়ে খাটে। এই শ্রেণিটির উদ্ভবের পর্বে, যখন তারা সবে দেখা দিচ্ছে এখানে-ওখানে, তখন স্বভাবতই অবস্থাপন্ন মুদ্রা-খাজনাদায়ী কৃষকদের মধ্যে নিজেদের কাজে খেতমজুরদের শোষণ করার একটা রীতি বেড়ে উঠতে থাকে, ঠিক যেভাবে সামন্ত যুগে অবস্থাপন্ন ভূমিদাস চাষিরা নিজেরাও আবার ভূমিদাস রাখত। এই সব চাষিদের পক্ষে ক্রমে ক্রমে হাতে কিছু সম্পদ জমিয়ে ভবিষ্যৎ পুঁজিপতিতে পরিণত হওয়া সম্ভব হয়। নিজের জমিতেই স্বনিযুক্ত পুরনো জমি-মালিকদের মধ্য থেকেই এইভাবে গড়ে ওঠে পুঁজিপতি ইজারাদারীর পাঠশালা, যাদের বিকাশ নির্ভর করছে গ্রামাঞ্চলের গণ্ডি ছাড়িয়ে পুঁজিবাদী উৎপাদনের সাধারণ বিকাশের ওপর’ (পুঁজি, খণ্ড ৩) (৩৭) … ‘গ্রামবাসীদের একাংশের উচ্ছেদ ও গ্রাম থেকে তাদের বিতাড়ন তাদের জীবনধারণের উপকরণ ও শ্রমের হাতিয়ার কেড়ে নিয়ে শিল্পপুঁজির প্রয়োজনে তাদের মুক্ত করে দিল। এর মধ্য দিয়ে গড়ে উঠল অভ্যন্তরীণ বাজার।’ (পুঁজি, খণ্ড ১) (৩৮)। কৃষিজীবী জনগণের দারিদ্র্যবৃদ্ধি ও ধ্বংস আবার পুঁজির জন্যে শ্রমের মজুত বাহিনী সৃষ্টিতে ভূমিকা নেয়। যে-কোনও পুঁজিবাদী দেশেই ‘তাই কৃষিজীবী জনগণের একাংশ অনবরত শহরের বা হস্তশিল্প কারখানার (অর্থাৎ কৃষিজীবী নয়) সর্বহারায় পরিণত হতে থাকে। আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত জনতার এই ধারা অবিরাম বয়ে চলে … গ্রাম্য মেহনতিকে নেমে আসতে হয় সর্বনিম্ন মাত্রার মজুরিতে, এক পা তার সবসময়েই ডুবে থাকে দুর্দশার পাঁকে’ (পুঁজি’, খণ্ড ১) (৩৯)। কৃষক যে জমি চাষ করছে তাতে তার ব্যক্তিগত মালিকানা হল ক্ষুদ্রাকার উৎপাদনের ভিত্তি, এটাই তার বিকাশ ও সর্বোন্নত রূপ গ্রহণের শর্ত। কিন্তু এ ধরনের ক্ষুদ্রাকার উৎপাদন খাপ খায় শুধু একটা অপরিসর আদিম ধাঁচের উৎপাদন ও সমাজের সঙ্গে। পুঁজিবাদের আওতায় কৃষকদের শোষণ শুধু রূপের দিক দিয়েই শিল্প শ্রমিকদের শোষণ থেকে ভিন্ন ধরনের। উভয়ের শোষক একই– পুঁজি। আলাদা আলাদা পুঁজিপতি শোষণ করে আলাদা আলাদা কৃষককে বন্ধকী ও সুদের কারবার মারফত। সামগ্রিকভাবে পুঁজিপতি শ্রেণি কৃষক শ্রেণিকে শোষণ করে রাষ্ট্রীয় কর মারফত (‘ফ্রান্সে শ্রেণিসংগ্রাম’) (৪০)। ‘কৃষকদের ক্ষুদ্রায়তন সম্পত্তি পুঁজিপতিদের কাছে জমি থেকে মুনাফা, সুদ ও খাজনা আদায়ের সুযোগ নিয়ে আসে। আর নিজের পারিশ্রমিকটুকু কোনওমতেঅর্জনের ভার তারা চাপিয়ে দেয় ভূমির মালিকেরই ওপর’ (‘আঠারোই ব্রুমেয়ার’) (৪১)। এটাই নিয়মে দাঁড়ায় যে, চাষি এমনকি তার নিজের পারিশ্রমিকের একাংশ পর্যন্ত দিয়ে দেয় পুঁজিবাদী সমাজের অর্থাৎ পুঁজিপতি শ্রেণির জন্যে এবং তাকে নিজেকে নেমে যেতে হয় ‘আইরিশ ঠিকাচাষির সমপর্যায়ে, অথচ ভাবখানা থাকে, যেন সে ব্যক্তিগত সম্পত্তি-মালিক’ (‘ফ্রান্সে শ্রেণিসংগ্রাম’) (৪২)। ‘যে সব দেশে চাষ হয় পুঁজিবাদী উৎপাদন-পদ্ধতিতে, তাদের তুলনায় ক্ষুদ্রাকার চাষবাসের আধিক্য যে সব দেশে সেখানে খাদ্যশস্যের দাম কম, তার অন্যতম কারণ কী? (পুঁজি’, খণ্ড ৩) (৪৩)। কারণ, কৃষক তার উদ্বৃত্ত উৎপন্ন দ্রব্যের একাংশ বিনামূল্যে সমাজের হাতে (অর্থাৎ পুঁজিপতি শ্রেণির হাতে) ছেড়ে দেয়। সুতরাং, (খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য কৃষিজাত দ্রব্যের) এই নিচু দাম হল উৎপাদকদের দারিদ্রের পরিণাম, কোনও মতেই তাদের শ্রম-উৎপাদনশীলতার ফল নয়’ (‘পুঁজি’, খণ্ড ৩)(৪৪)। ক্ষুদ্রাকার উৎপাদনের স্বাভাবিক রূপ হল ক্ষুদ্র ভূমি-মালিকানা, পুঁজিবাদের আওতায় তা অধঃপতিত, বিলুপ্ত ও ধ্বংস হয়। ‘ক্ষুদ্র ভূমি-মালিকানার প্রকৃতিটাই এমন যে তাতে শ্রমের সামাজিক উৎপাদন-শক্তির বিকাশ, শ্রমের সামাজিক রূপ, পুঁজির সামাজিক পুঞ্জীভবন, বৃহদাকারে পশুপালন এবং বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান প্রয়োগ অসম্ভব। সুদের কারবারও করব্যবস্থার ফলে সর্বত্রই তার নিঃস্ব হয়ে যাওয়াটা অনিবার্য। জমি কেনার জন্যে যে পুঁজি ব্যয় হয় তা চাষের কাজ থেকে বাদ পড়ে। উৎপাদনের উপকরণ বহু খণ্ডে বিভক্ত হলে খোদ উৎপাদকরাই তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।’ (সমবায়, অর্থাৎ ক্ষুদ্র চাষিদের সমিতিগুলি অসাধারণ প্রগতিশীল বুর্জোয়া ভূমিকা পালন করলেও তাতে করে এ ঝোঁকটা দুর্বল হয় মাত্র, তার অবসান ঘটে না, এ কথাও ভুললে চলবে না যে, অবস্থাপন্ন কৃষকদের জন্যে সমবায় অনেক কিছু করলেও গরিব চাষিদের ব্যাপক অংশের জন্য প্রায় কিছুই করে না। পরে সমিতিগুলি নিজেরাই মজুরি-শ্রমের শোষক হয়ে বসে)। ‘মনুষ্যশক্তির বিপুল অপচয়। টুকরো টুকরো (ক্ষুদ্র) ভূমি-মালিকানার নিয়মই হল উৎপাদনের অবস্থার ক্রমান্বয়ে অবনতি এবং উৎপাদনের উপকরণের ক্রমাগত মুল্যবৃদ্ধি’ (৪৫)। যেমন শিল্পে, তেমনি কৃষিতেও পুঁজিবাদ উৎপাদন প্রক্রিয়ার রূপান্তর ঘটায় শুধু উৎপাদককে শহিদ বানিয়ে। ‘অনেকখানি জায়গায় ছড়িয়ে থাকার দরুন গ্রাম্য শ্রমিকদের প্রতিরোধক্ষমতা ভেঙে পডে, অন্য দিকে একত্রে থাকার় ফলে শহুরে শ্রমিকদের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। শহরের কারখানার মতোই আধুনিক পুঁজিবাদী কৃষিব্যবস্থাতেও শ্রমের পরিমাণ ও উৎপাদশীলতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া গতিলাভ করে শ্রমশক্তিকেই ছিবড়ে করে তাকে জীর্ণ করে দেওয়ার বিনিময়ে। অধিকন্তু, পুঁজিবাদী কৃষির সমস্ত অগ্রগতির কৌশল হল শুধু শ্রমিককে নয়, ভূমিকেও লুঠ করার কৌশলের অগ্রগতি…সুতরাং, পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রযুক্তির বিকাশ ঘটায় এবং উৎপাদনের বহুমুখী প্রক্রিয়াকে সামগ্রিকভাবে সামাজিক করে তোলে। করে এমনভাবে যাতে একইসঙ্গে সব সম্পদের মূল দুটি আধার–ভূমি ও শ্রমিকের সব রস শুষে নেয়।’ (পুঁজি’, খণ্ড ১, ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদের শেষ ভাগ)। (চলবে)