মহান দার্শনিক কার্ল মার্কস ও তাঁর মতবাদ — ভ ই লেনিন

মানবমুক্তির দর্শন হিসাবে মার্কসবাদ জানতে ও বুঝতে দলের মধ্যে আদর্শগত চর্চার যে ধারাবাহিক প্রক্রিয়া চলছে তার সহায়ক হিসাবেই আমরা কার্ল মার্কসের জীবন ও মার্কসবাদ সম্পর্কিত লেনিনের লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছি। এবার দ্বিতীয় কিস্তি।

(২)

দ্বান্দ্বিকতা

বিকাশের সবচেয়ে সর্বাঙ্গীণ, সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং সবচেয়ে গভীর মতবাদ হিসেবে হেগেলীয় দ্বান্দ্বিক তত্ত্বকে মার্কস ও এঙ্গেলস চিরায়ত জার্মান দর্শনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে মনে করতেন। বিকাশের, বিবর্তনের অন্য সমস্ত নীতিসূত্রগুলিকে তাঁরা মনে করতেন একপেশে ও বিষয়ের দিক থেকে দুর্বল এবং সেগুলি প্রকৃতি ও সমাজ বিকাশের ধারাটি সম্বন্ধে প্রকৃত ধারণার বিকৃতি ও অঙ্গহানি ঘটায় (যে ধারা প্রায়ই সম্পূর্ণ হয় অতি দ্রুত, ঝড়ঝঞ্ঝা এবং বিপ্লবের মধ্য দিয়ে)। ‘বলতে গেলে একমাত্র মার্কস এবং আমিই ক্রিয়াশীল দ্বান্দ্বিক তত্ত্ব উদ্ধার করেছিলাম … (হেগেলবাদ সহ ভাববাদের সম্পূর্ণ আচ্ছন্নতা থেকে) তাকে প্রকৃতি সম্পর্কে বস্তুবাদী ধারণায় রূপান্তরিত করে …। প্রকৃতি হল দ্বন্দ্বতত্ত্ব পরীক্ষার কষ্টিপাথর এবং আমাদের বলতেই হবে যে, এই পরীক্ষার জন্য বিজ্ঞান বিপুল পরিমাণ উপাদান সরবরাহ করেছে। প্রতিদিন তার পরিমাণ বাড়ছে। শেষ বিচারে প্রকৃতি এগিয়ে চলে দ্বান্দ্বিক পথে, অধিবিদ্যা নির্ধারিত পথে বা ভাববাদী পথে নয় (এ কথা লেখা হয়েছিল রেডিয়ম, ইলেকট্রন, মৌলিক পদার্থের রূপান্তর প্রভৃতি আবিষ্কারের আগেই!)’। (অ্যান্টি ডুরিং, এঙ্গেলস)

আবার এঙ্গেলস লিখেছেনঃ ‘এই বিশ্বকে আগে থেকেই সম্পূর্ণ হওয়া বস্তুসমূহের সমাহার হিসাবে দেখা উচিত নয়, বরং বিশ্ব হল বহু প্রক্রিয়ার সমাহার, যেখানে আপাতদৃষ্টিতে স্থায়ী বস্তুসমূহ তথা আমাদের মস্তিষ্কের ভিতরে (আমাদের ধারণায়) সেগুলির প্রতিচ্ছবি অবিরাম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলেছে, কখনও উদ্ভূত হচ্ছে, কখনও বিলুপ্ত হচ্ছে। সেগুলি আপাত অর্থে আকস্মিক এবং ক্ষণস্থায়ী রূপে পশ্চাদগামী হলেও শেষপর্যন্ত তা এগিয়ে চলে বিকাশের পথে– এই মহান বুনিয়াদী ধারণা, বিশেষত হেগেলের সময় থেকে, সর্বজনীন চেতনার এত গভীরে প্রবেশ করেছে যে, সাধারণ আকারে এ উক্তির প্রতিবাদ বর্তমানে কেউই প্রায় করবে না। কিন্তু এই ধারণাটিকে কথায় স্বীকার করা এক জিনিস, আর প্রতিটি আলাদা ঘটনায়, অনুসন্ধানের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ হল আলাদা জিনিস।’

‘দ্বন্দ্বমূলক দর্শনের দৃষ্টিতে চিরকালীন বা পরম এবং পবিত্র বলে কিছু নেই। সবকিছুর ওপরে, সবকিছুর ভেতরে এই দর্শন অনিবার্য ক্ষয়ের সিলমোহর দেখে। সৃষ্টি ও ধ্বংসের অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়াকে কোনও কিছুই প্রতিরোধ করতে পারে না। নিম্নতর স্তর থেকে উচ্চতর স্তরে অন্তহীন এগিয়ে চলার ধারা– দর্শন হল চিন্তাশীল মানব মস্তিষ্কে এই প্রক্রিয়ারই সরল প্রতিফলনের ফল।’ এইভাবে মার্কসের মতে দ্বান্দ্বিকতা হল ‘বহির্জগৎ ও মানুষের চিন্তাজগতের গতির সাধারণ নিয়ম সংক্রান্ত বিজ্ঞান’।

হেগেলীয় দর্শনের এই বিপ্লবী দিকটাকে মার্কস গ্রহণ করেন ও বিকশিত করে তোলেন। সমস্ত বিজ্ঞানের ঊর্ধ্বে অবস্থিত কোনও দর্শনের প্রয়োজন দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের নেই। পূর্বতন দর্শনগুলি থেকে রয়ে গেল ‘চিন্তার বিজ্ঞান ও তার নিয়মকানুনগুলি, অর্থাৎ সাধারণ যুক্তিবিজ্ঞান (ফর্মাল লজিক) ও দ্বান্দ্বিকতা।’

হেগেলকে অনুসরণ করে মার্কস যে দ্বান্দ্বিকতা শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, তার মধ্যে রয়েছে বর্তমানে যাকে বলা হয় চেতনার তত্ত্ব বা জ্ঞানতত্ত্ব বা জ্ঞান ও চেতনার দর্শন। এটি এমন এক বিজ্ঞান যার গভীর অনুশীলন করা প্রয়োজন। জ্ঞান ও চেতনার ক্রমবিকাশ, অচেতন অবস্থা থেকে চেতনার স্তরে পৌঁছানোর ধারা– এগুলিকে বিচার করতে হবে ঐতিহাসিক ভাবে এবং অর্জিত জ্ঞানের সাধারণীকরণের মধ্য দিয়ে।

আমাদের সময়ে বিকাশের ধারণা, বিবর্তনের ধারণা প্রায় পুরোপুরি সামাজিক চেতনার মধ্যে প্রবেশ করেছে। কিন্তু তা করেছে অন্য পথে, হেগেলীয় দর্শনের মধ্য দিয়ে নয়। কিন্তু হেগেলের দর্শনের ভিত্তিতে মার্কস ও এঙ্গেলস এই বিষয়ে যে ধারণাকে সূত্রবদ্ধ করেছিলেন, তা অনেক বেশি সামগ্রিক, বিবর্তনের প্রচলিত তত্ত্বের তুলনায়, বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে তা অনেক বেশি সমৃদ্ধ। পার হয়ে আসা স্তরগুলিতে যেমন ছিল, এই বিকাশ তার পুনরাবৃত্তি ঘটায়। কিন্তু এই পুনরাবৃত্তি ঘটে অন্য ভাবে, উচ্চতর স্তরে (নেগেশন অফ নেগেশন)। এই বিকাশ বলতে গেলে সরল রেখায় হয় না, এর গতি আঁকাবাঁকা। অতি দ্রুতগতিতে, ঝড়ঝঞ্ঝা, বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ঘটে এই বিকাশ। বিকাশের দ্বান্দ্বিক নিয়মের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হল ‘ধারাবাহিকতার মধ্যে ঘটে ছেদ’, পরিমাণগত থেকে গুণগত রূপান্তর, বিকাশের জন্য দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত অভ্যন্তরীণ তাড়না, একটি নির্দিষ্ট বস্তু, ঘটনা অথবা একটি নির্দিষ্ট সমাজের ভিতরে সক্রিয় বিভিন্ন শক্তি ও প্রবণতাগুলির মধ্যেকার দ্বন্দ্ব। প্রতিটি ঘটনাই সার্বিক ভাবে পরস্পর-নির্ভর এবং এদের মধ্যে আছে সুনিবিড়, অবিচ্ছেদ্য যোগাযোগ (ইতিহাস এর নতুন নতুন দিক উদঘাটন করছে)। এ যোগাযোগ থেকেই বিশ্বজনীন গতির একক নিয়মের উদ্ভব। প্রচলিত মতবাদের তুলনায় দ্বন্দ্বতত্ত্ব বিকাশের নিয়ম হিসাবে অনেক বেশি অর্থবহ। (১৮৬৮ সালের ৮ জানুয়ারি এঙ্গেলসকে লেখা মার্কসের চিঠি দ্রষ্টব্য। এই চিঠিতে মার্কস বিদ্রূপ করেছিলেন স্টাইনের ‘কেঠো ট্রাইকোটমিকে’, বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিকতার সঙ্গে যা গুলিয়ে ফেলা হাস্যকর।) (চলবে)

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ২১ সংখ্যা ৩১ ডিসেম্বর ২০২১