মানব মুক্তির দর্শন হিসাবে মার্কসবাদ জানতে ও বুঝতে দলের মধ্যে আদর্শগত চর্চার যে ধারাবাহিক প্রক্রিয়া চলছে তার সহায়ক হিসাবেই আমরা কার্ল মার্কসের জীবন ও মার্কসবাদ সম্পর্কিত লেনিনের লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছি। এবার প্রথম কিস্তি।
(১)
কার্ল মার্কস সম্পর্কে এ প্রবন্ধটি আমি লিখি (যতদূর মনে পড়ে) ১৯১৩ সালে গ্রানাৎ বিশ্বকোষের জন্যে। এখন এটি পৃথক পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হল। প্রবন্ধের শেষে মার্কস সম্পর্কিত সাহিত্যের একটি বিশদ গ্রন্থপঞ্জি, তার অধিকাংশই বৈদেশিক ভাষায়। বর্তমান সংস্করণে তা বাদ দেওয়া হল। বিশ্বকোষের সম্পাদকেরা আবার তাঁদের দিক থেকে সেন্সরশিপের কারণে মার্কস বিষয়ে প্রবন্ধের শেষ দিকটা, অর্থাৎ যেখানে তাঁর বিপ্লবী কর্মকৌশলের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল, সে অংশটা ছাঁটাই করে দিয়েছিলেন।
দুর্ভাগ্যবশত, সেই শেষটুকু আমি এখানে পুনরুদ্ধার করতে পারিনি। কেন না প্রথম খসড়াটা আমার কাগজপত্রের সঙ্গে ক্রাকোভ কিংবা সুইজারল্যান্ডের কোথাও থেকে গেছে। আমার শুধু এইটুকু মনে আছে যে, প্রবন্ধের শেষে আমি অন্যান্য বিষয় ছাড়াও এঙ্গেলসের কাছে লেখা মার্কসের ১৬ এপ্রিল ১৮৫৬ সালের চিঠি থেকে একটা অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করেছিলাম। মার্কস তাতে বলেছিলেন, জার্মানিতে কৃষক সমরের দ্বিতীয় সংস্করণের মতো কোনও কিছু দিয়ে প্রলেতারীয় বিপ্লবকে সাহায্য করতে পারার সম্ভাবনার ওপরেই সবকিছু নির্ভর করবে। তা হলে চমৎকার হবে। ১৯০৫ সালে ও পরবর্তীকালে ঠিক এই কথাটিই আমাদের মেনশেভিকেরা বুঝে উঠতে পারেনি এবং অধুনা তারা সমাজতন্ত্রের প্রতি চড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা ও বুর্জোয়াদের পক্ষাবলম্বনের পথ ধরেছে। (ভ ই লেনিন, মস্কো, ১৪ মে, ১৯১৮)
নতুন ক্যালেন্ডার অনুসারে ১৮১৮ সালের ৫ মে ত্রিয়ের শহরে (প্রুশিয়ার রাইন অঞ্চলে) কার্ল মার্কসের জন্ম হয়। তাঁর পিতা ছিলেন আইনজীবী, ধর্মে ইহুদি। ১৮২৪ সালে তিনি প্রটেস্টান্ট ধর্ম গ্রহণ করেন। পরিবারটি ছিল সচ্ছল ও সংস্কৃতিবান, কিন্তু বিপ্লবী নয়। ত্রিয়েরের জিমনাসিয়াম স্কুল থেকে পাশ করে মার্কস প্রথমে বন এবং পরে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ও আইনশাস্ত্র পড়েন, কিন্তু বিশেষভাবে অধ্যয়ন করেন ইতিহাস ও দর্শন। ১৮৪১ সালে পাঠ শেষ করে এপিকিউরাসের দর্শন সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রির থিসিস পেশ করেন। দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে মার্কস তখনও ছিলেন হেগেলপন্থী ভাববাদী। বার্লিনে তিনি ‘বামপন্থী হেগেলবাদী’ (ব্রুনো বাউয়ের প্রভৃতি) গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। হেগেলের দর্শন থেকে এঁরা নিরীশ্বরবাদী ও বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করতেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে অধ্যাপক হওয়ার ইচ্ছায় মার্কস বন শহরে যান। কিন্তু সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল নীতি, যা ১৮৩২ সালে ল্যুদভিগ ফয়েরবাখকে অধ্যাপক পদ থেকে বিতাড়িত করেছিল ও ১৮৩৬ সালে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় প্রবেশের অনুমতি দেয়নি– ১৮৪১ সালে বন-এ তরুণ অধ্যাপক ব্রুনো বাউয়েরকেও বত্তৃতা দিতে দেয়নি। এ-সব জানার পর মার্কস অধ্যাপকের পেশা গ্রহণের ইচ্ছা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন। সেই সময় জার্মানিতে বামপন্থী হেগেলবাদীদের মতবাদ অতি দ্রুত বিকশিত হয়ে উঠছিল। ১৮৩৬ সালের পর থেকে ল্যুদভিগ ফয়েরবাখ বিশেষ করে ধর্মতত্ত্বের সমালোচনা শুরু করেন এবং আকৃষ্ট হন বস্তুবাদের দিকে, যা ১৮৪১ সালে তাঁর দর্শনের মধ্যে (‘খ্রিস্ট ধর্মের সারমর্ম’) প্রধান হয়ে ওঠে। ১৮৪৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘ভবিষ্যৎ দর্শনশাস্ত্রের মূলসূত্র’। ফয়েরবাখের এই সব রচনা সম্পর্কে এঙ্গেলস পরে লিখেছিলেন, এই বইগুলি কী ভাবে চিন্তার মুক্তি ঘটায়, পাঠকমাত্রেরই সেই অভিজ্ঞতা হয়েছে। ‘আমরা সকলে’ (অর্থাৎ মার্কস সমেত বামপন্থী হেগেলবাদীরা) ‘তৎক্ষণাৎ ফয়েরবাখপন্থী হয়ে গেলাম।’ রাইন অঞ্চলের এমন কিছু র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া, বামপন্থী হেগেলবাদীদের সঙ্গে যাঁদের কিছু কিছু মিল ছিল, তাঁরা মিলে কলোন শহরে ‘রাইনসে জাইতুং’ নামে সরকারবিরোধী একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন (প্রকাশ শুরু হয় ১৮৪২-এর ১ জানুয়ারি থেকে)। মার্কস ও ব্রুনো বাউয়েরকে পত্রিকাটির প্রধান লেখক হওয়ার জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৮৪২ সালের অক্টোবরে মার্কস পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক হন ও বন থেকে কলোনে চলে আসেন। মার্কসের সম্পাদনায় পত্রিকাটির বিপ্লবী গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি উত্তরোত্তর স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে এবং সরকার পত্রিকাটির উপরে প্রথমে দুই দফা ও তিন দফা সেন্সর ব্যবস্থা চাপায়, পরে ১৮৪৩-এর ১ এপ্রিল থেকে পত্রিকাটিকে পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই পরিস্থিতিতে মার্কস পত্রিকাটির সম্পাদক পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন। কিন্তু তাতেও পত্রিকাটি রক্ষা পেল না, ১৮৪৩ সালের মার্চ মাসে সেটি বন্ধ হয়ে গেল। রাইনসে জাইতুং পত্রিকায় মার্কসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রচনা ছাড়াও মোজেল উপত্যকায় আঙুর-চাষিদের অবস্থা সম্পর্কে একটি প্রবন্ধের উল্লেখ করেছেন এঙ্গেলস। পত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে মার্কস বুঝলেন রাজনৈতিক-অর্থশাস্ত্রের সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট পরিচয় নেই। তাই এই বিষয়ে তিনি সাগ্রহে পড়াশুনো শুরু করলেন।
১৮৪৩ সালে ক্রয়েজনাখ শহরে মার্কস জেনি ফন ভেস্টফালেনকে বিবাহ করেন। জেনি তাঁর বাল্যবন্ধু, ছাত্রাবস্থা থেকেই তাঁদের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। মার্কসের স্ত্রী প্রুশিয়ার এক প্রতিক্রিয়াশীল অভিজাত পরিবারের মেয়ে। প্রুশিয়ার সর্বাধিক প্রতিক্রিয়াশীল যুগ বলে যা পরিচিত, সেই ১৮৫০-১৮৫৮ সময়কালে জেনির দাদা ছিলেন প্রুশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। আর্নোল্ড রুগে (১৮০২-১৮৮০-তে যিনি একজন বামপন্থী হেগেলবাদী, ১৮২৪-১৮৩০-এ কারারুদ্ধ, ১৮৪৮-এর পর নির্বাসিত, ১৮৬৬-১৮৭০ সালের পর বিসমার্কপন্থী), তাঁর সঙ্গে একত্রে বিদেশ থেকে একটি রেডিক্যাল পত্রিকা বার করার জন্য মার্কস ১৮৪৩ সালের শরৎকালে প্যারিসে পৌঁছান। ‘ডয়েস ফ্রানজোসিসে জহরবুশারা’ নামের এই পত্রিকাটির শুধু একটিই সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। জার্মানিতে পত্রিকাটির গোপনে প্রচারের অসুবিধা এবং রুগের সঙ্গে মতান্তরের ফলে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। এই পত্রিকায় মার্কস যে-সব প্রবন্ধ লিখেছিলেন তাতে দেখা যায় যে, তিনি ইতিমধ্যেই এমন একজন বিপ্লবী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছেন, যিনি প্রচলিত সবকিছুর নির্মম সমালোচনা, বিশেষত ‘অস্ত্রের সমালোচনা’র মধ্য দিয়ে জনগণ ও সর্বহারাদের কাছে আবেদন রাখছেন।
১৮৪৪ সালের সেপ্টেম্বরে ফ্রেডরিক এঙ্গেলস কয়েক দিনের জন্যে প্যারিসে আসেন এবং তখন থেকে মার্কসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন। উভয়েই প্যারিসের তদানীন্তন বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলির টগবগে মতবাদিক কর্মকাণ্ডে অত্যন্ত সক্রিয় অংশ নেন। এঁদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল প্রুধোঁর মতবাদ, ১৮৪৭ সালে মার্কস তাঁর ‘দর্শনের দারিদ্র’ গ্রন্থে প্রুধোঁর মতবাদকে ছিন্নভিন্ন করে দেন এবং পেটিবুর্জোয়া সমাজতন্ত্র সংক্রান্ত নানাবিধ মতবাদের বিরুদ্ধে প্রবল সংগ্রাম চালিয়ে বৈপ্লবিক প্রলেতারিয় সমাজতন্ত্র অর্থাৎ কমিউনিজমের (মার্কসবাদের) তত্ত্ব ও রণকৌশল গড়ে তোলেন। প্রুশিয়ান সরকারের দাবিতে ১৮৪৫ সালে বিপজ্জনক বিপ্লবী বলে মার্কসকে প্যারিস থেকে বহিষ্কৃত করা হয়। অতঃপর ব্রাসেলসে আসেন মার্কস। ১৮৪৭ সালের বসন্তে তিনি ও এঙ্গেলস ‘কমিউনিস্ট লিগ’ নামে একটি গুপ্ত প্রচার সমিতিতে যোগ দেন। লিগের দ্বিতীয় কংগ্রেসে (লন্ডন, ১৮৪৭ নভেম্বর) তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন এবং কংগ্রেস থেকে দায়িত্ব পেয়ে সুপ্রসিদ্ধ ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’ রচনা করেন। ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তা প্রকাশিত হয়। প্রতিভার দীপ্তি, স্বচ্ছতা ও উজ্জ্বলতায় ভাস্বর এই রচনাটি এক নতুন বিশ্ববীক্ষার জন্ম দিয়েছে যা বস্তুবাদের অনুসারী। এই বিশ্ববীক্ষা প্রসারিত হয়েছে সমাজজীবনের ক্ষেত্রেও। এর মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিকাশের সর্বাঙ্গীন ও সর্বদিক ব্যপ্ত মতবাদ ‘ডায়লেকটিকস’। এসেছে শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্ব এবং নতুন কমিউনিস্ট সমাজের স্রষ্টা প্রলেতারিয়েতের বিশ্বব্যাপী ঐতিহাসিক বিপ্লবী ভূমিকার তত্ত্ব।
১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব শুরু হলে মার্কস বেলজিয়াম থেকে নির্বাসিত হন। আবার তিনি প্যারিসে চলে আসেন এবং মার্চ বিপ্লবের পর ফিরে আসেন জার্মানির কলোন শহরেই। প্রকাশিত হয় ‘নিউ রাইনসে জাইতুং’ পত্রিকা, ১৮৪৮ সালের ১ জুন থেকে ১৮৪৯ সালের ১৯ মে পর্যন্ত। মার্কস ছিলেন তার প্রধান সম্পাদক। মার্কসের নতুন তত্ত্ব চমৎকার ভাবে প্রমাণিত ১৮৪৮-১৮৪৯ এর বৈপ্লবিক ঘটনাস্রোতে। একই ভাবে তা সত্য প্রমাণিত হয়েছে পরবর্তীকালে পৃথিবীর সব দেশের সমস্ত প্রলেতারীয় ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। জার্মানিতে প্রতিবিপ্লবের বিজয় ঘটলে প্রথমে মার্কসকে আদালতে অভিযুক্ত করা হয় (১৮৪৯ এর ৯ ফেব্রুয়ারি তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন)। পরে তিনি জার্মানি থেকে নির্বাসিত হন (১৮৪৯ এর ১৬ মে)। প্রথমে প্যারিসে গেলেন মার্কস। ১৮৪৯ সালের ১৩ জুনের মিছিলের পর সেখান থেকেও পুনরায় নির্বাসিত হয়ে লন্ডনে আসেন এবং সেখানেই বাকি জীবন কাটান।
এই নির্বাসিত জীবন কত কঠিন ছিল তা স্পষ্ট বোঝা যায় মার্কস-এঙ্গেলসের মধ্যে আদান-প্রদান হওয়া চিঠিপত্রে (১৯১৩-তে প্রকাশিত)। মার্কস ও তাঁর পরিবারের উপর দারিদ্রের গুরুভার একেবারে চেপে বসে। মার্কসের সাহায্যার্থে এঙ্গেলস নিজেকে উৎসর্গ করে না দিলে মার্কসের পক্ষে ‘পুঁজি’ বইখানি শেষ করা তো দূরের কথা, অভাবের তাড়নায় জীবনরক্ষাই অসম্ভব হত। তা ছাড়া, পেটি বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রের, সাধারণভাবে অ-প্রলেতারীয় সমাজতন্ত্রের মতবাদগুলির প্রাধান্য মার্কসকে নিরন্তর কঠিন সংগ্রামে বাধ্য করেছে এবং মাঝে মাঝে অতি ক্ষিপ্ত বন্য ব্যক্তিগত আক্রমণও প্রতিহত করতে হয়েছে তাঁকে। দেশান্তরীদের চক্রগুলি থেকে পৃথক থেকে মার্কস তাঁর একাধিক ঐতিহাসিক রচনায় নিজের বস্তুবাদী তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন, এবং প্রধানত রাজনৈতিক-অর্থশাস্ত্রের চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। এই বিজ্ঞানটির ক্ষেত্রে মার্কস তাঁর ‘রাজনৈতিক-অর্থশাস্ত্রের সমালোচনা প্রসঙ্গে’ (১৮৫৯) এবং ‘পুঁজি’ (প্রথম খণ্ড, ১৮৬৭) রচনা করে এই বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধন করেছেন।
১৮৫০-এর দশকের শেষে ও ষাটের দশকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুনরুজ্জীবনের যুগ মার্কসকে আবার প্রত্যক্ষ কার্যকলাপের মধ্যে টেনে নেয়। ১৮৬৪ সালে (২৮ সেে›টম্বর) লন্ডনে বিখ্যাত প্রথম আন্তর্জাতিক বা আন্তর্জাতিক শ্রমিকসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। মার্কস ছিলেন এই সমিতির প্রাণস্বরূপ। তার প্রথম ‘অভিভাষণ’ এবং বহুবিধ প্রস্তাব, ঘোষণা ও ইশতেহার তাঁরই রচনা। বিভিন্ন দেশের শ্রমিক আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করে, বিভিন্ন ধরনের মার্কসপূর্ব অ-প্রলেতারীয় সমাজতন্ত্রের চিন্তাকে (মাতসিনি, প্রুধোঁ, বাকুনিন, ইংলন্ডের উদারনৈতিক ট্রেড ইউনিয়নবাদ, জার্মানিতে লাসালপন্থীদের দক্ষিণমুখী দোদুল্যমানতা ইত্যাদি) সংযুক্ত কার্যকলাপের পথে সরাসরি রুখে দাঁড়িয়ে এবং এই সব সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীগুলির মতবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে করতে মার্কস বিভিন্ন দেশের শ্রমিক শ্রেণির প্রলেতারিয় সংগ্রামের একটি সাধারণ রণকৌশল গড়ে তোলেন। প্রত্যক্ষ সংগ্রামী, বিপ্লবীতত্ত্ববিদ মার্কস তাঁর ‘ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ’ রচনায় (১৮৭১) প্যারি কমিউনের সুগভীর, অত্যন্ত কার্যকর এবং প্রতিভাদীপ্ত বিশ্লেষণ উপস্থিত করেছেন। ১৮৭১-এ তার পতন ও বাকুনিনপন্থীদের দ্বারা প্রথম আন্তর্জাতিকের মধ্যে বিভেদসৃষ্টির পর ইউরোপে আন্তর্জাতিকের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ল। আন্তর্জাতিকের হেগ কংগ্রেসের (১৮৭২) পর মার্কস এর সাধারণ পরিষদকে নিউ ইয়র্কে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করেন। প্রথম আন্তর্জাতিকের ঐতিহাসিক ভূমিকা শেষ হয়ে গিয়েছিল। পৃথিবীর সমস্ত দেশের শ্রমিক আন্দোলনের অপরিসীম বৃদ্ধি নতুন যুগের সূচনা করে। বিশেষত সেই যুগটা ছিল শ্রমিক আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান সম্ভাবনা ও তার প্রসারবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে এক একটি জাতীয় রাষ্ট্রের ভিত্তিতে ব্যাপক জনসাধারণের সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক পার্টি গড়ে তোলার যুগ। আন্তর্জাতিক তার কাছে নিজের স্থান ছেড়ে দেয়।
আন্তর্জাতিকের প্রয়োজনে কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গে তত্ত্বগত বিষয়ে কঠিন থেকে কঠিনতর পরিশ্রমে মার্কসের স্বাস্থ্য চূড়ান্তরূপে ভেঙে গিয়েছিল। রাজনৈতিক-অর্থশাস্ত্রকে ঢেলে সাজানো এবং পুঁজি বইখানিকে সম্পূর্ণ করার কাজ তিনি চালিয়ে যান, রাশি রাশি নতুন তথ্য সংগ্রহ করেন ও একাধিক ভাষা (যথা রুশ) আয়ত্ত করেন, কিন্তু ভগ্নস্বাস্থে্য ‘পুঁজি’ সম্পূর্ণ করা তাঁর আর হয়ে উঠল না।
১৮৮১ সালের ২ ডিসেম্বর তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়। ১৮৮৩ সালের ১৪ মার্চ আরামকেদারায় বসে শান্তভাবে মার্কস তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। লন্ডনের হাইগেট সমাধিক্ষেত্রে মার্কসকে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে একত্রে সমাধিস্থ করা হয়। মার্কসের সন্তানদের মধ্যে কয়েক জন বাল্যাবস্থাতেই মারা যায় লন্ডনে, যখন চরম অভাবের মধ্যে পরিবারটি বাস করছিল। এলিওনর অ্যাভেলিং, ল্যরা লাফার্গ ও জেনি লোঙ্গে– মেয়েদের এই তিনজনের বিয়ে হয় ব্রিটিশ ও ফরাসি সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে। শেষোক্ত জনের পুত্র ফরাসি সোস্যালিস্ট পার্টির একজন সভ্য।
মার্কসের মতবাদ
মার্কসের দষ্টিভঙ্গির নিয়ম ও তাঁর শিক্ষাকে বলা হয় মার্কসবাদ। মার্কস হলেন সেই প্রতিভাধর, যিনি মানবজাতির তিনটি সবচেয়ে অগ্রসর দেশে উনিশ শতকে আবিভূর্ত তিনটি প্রধান ভাবাদর্শের বিকাশের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যান ও তাদের পূর্ণতাসাধন করেন। এই তিনটি অবদান হল, জার্মান চিরায়ত দর্শন, ইংল্যান্ডের চিরায়ত অর্থশাস্ত্র এবং ফরাসি সমাজতন্ত্র তথা সাধারণভাবে ফরাসি বিপ্লবী মতবাদ–মার্কসের মতবাদের সাধারণ দৃঢ়তা ও ধারণার অখণ্ডরূপ সঙ্গতিকে তাঁর শত্রুরাও স্বীকার করেন। এই মতবাদ সামগ্রিক ভাবে আধুনিক বস্তুবাদ, আধুনিক বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারণাকে গড়ে তোলে, যা পৃথিবীর সব সভ্য দেশের শ্রমিক আন্দোলনের তত্ত্ব ও কর্মসূচিকে রূপদান করে। ঠিক এই জন্যেই মার্কসবাদের প্রধান বিষয়, অর্থাৎ মার্কসের অর্থনৈতিক মতবাদ পরিব্যাখ্যানের আগে মার্কসের সাধারণ বিশ্ববোধ বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত মুখবন্ধ করা দরকার।
দার্শনিক বস্তুবাদ
১৮৪৪-১৮৪৫ সালে যখন কার্ল মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি রূপ নিয়েছিল তখন থেকেই তিনি বস্তুবাদী, বিশেষ করে ফয়েরবাখের অনুগামী। এমনকি পরবর্তী কালেও মার্কস মনে করতেন, ফয়েরবাখের দুর্বলতার একমাত্র কারণ, তাঁর বস্তুবাদ যথেষ্ট সুসঙ্গত ও সর্বাঙ্গীণ ছিল না। মার্কস মনে করতেন ফয়েরবাখের বিশ্ব-ঐতিহাসিক, ‘যুগান্তকারী’ গুরুত্ব ঠিক এই যে, তিনি হেগেলের ভাববাদকে দৃঢ়তার সঙ্গে ভেঙেছিলেন। তাঁর বস্তুবাদের ধারণার সঙ্গে ইতিপূর্বেই ‘অষ্টাদশ শতব্দীতে, বিশেষ করে ফ্রান্সে ‘সংগ্রাম বেধেছিল শুধু প্রচলিত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নয়, সেই সঙ্গে ধর্ম ও ধর্মতত্ত্বের এবং … সর্ববিধ অধিবিদ্যার (অর্থাৎ ‘প্রকৃত দর্শনচিন্তার’ বিপরীতে ‘উন্মত্ত কল্পনার’) সঙ্গেও’ (‘সাহিত্যিক উত্তরাধিকার’ পুস্তকের ‘পবিত্র পরিবার’। ‘পুঁজি’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় মার্কস লিখেছিলেন ‘হেগেলের কাছে মনন প্রক্রিয়া হল বাস্তবের ডিমিয়ারগস (অর্থাৎ স্রষ্টা, নির্মাতা)। এই প্রক্রিয়াকে তিনি আইডিয়া আখ্যা দিয়ে একটি স্বাধীন কর্তায় পর্যন্ত পরিণত করেছিলেন। … এর বিপরীতে আমার কাছে আইডিয়া হল, বস্তুর পরিবর্তিত রূপ, যা মানব মস্তিষ্কের মধ্যে যার রূপান্তর ঘটেছে’ (‘পূঁজি’, খণ্ড ১, দ্বিতীয় সংস্করণের উত্তরনিবেদন)। মার্কসের এই বস্তুবাদী দর্শনের সঙ্গে পূর্ণ সঙ্গতি রেখে এবং তারই ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস তাঁর ‘অ্যান্টি-ড্যুরিং’ গ্রন্থে লেখেন (বইখানির পাণ্ডুলিপি মার্কস পড়েছিলেন) … দর্শন ও প্রকৃতি বিজ্ঞানের দীর্ঘ যাত্রাপথে কষ্টার্জিত অগ্রগতির মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত যে, বিশ্বজগতের বস্তুময়তাই তাকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছে। … অস্তিত্ব আছে বলেই তা ঐক্যবদ্ধ এমনটা নয়। … বস্তুর গতিই হল তার অস্তিত্বের রূপ (ফর্ম)। গতিবিহীন বস্তু অথবা বস্তুবিচ্ছিন্ন গতি কোথাও কখনও ছিল না, থাকতেও পারে না … গতি ছাড়া বস্তু অথবা বস্তু ছাড়া গতির কথা চিন্তাও করা যায় না। যদি প্রশ্ন করা যায়, … ভাবনা ও চেতনা কী জিনিস, বা কী ভাবে তারা এল, তা হলে আমরা দেখতে পাব যে, তা মানব মস্তিষ্কের সৃষ্টি আর খোদ মানুষও প্রকৃতির সৃষ্টি, একটা নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে থেকে এবং তার সঙ্গেই তার বিকাশ ঘটছে। স্পষ্টত, মানব মস্তিষ্কের যে কোনও সৃষ্টি চূড়ান্ত বিবেচনায় প্রকৃতিরই সৃষ্টি হওয়ায় তা অবশিষ্ট প্রাকৃতিক সম্পর্কগুলির বিরোধী নয়, বরং তার অনুসারী।’ আরও লিখেছেন, ‘হেগেল ছিলেন ভাববাদী, অর্থাৎ তাঁর কাছে মাথায় যে চিন্তাগুলি আসছে তা বাস্তব বস্তু ও ঘটনাপ্রবাহের প্রতিফলনের বিমূর্ত রূপ নয়। (প্রতিফলন, মাঝে মাঝে এঙ্গেলস ‘ছাপ’ও লিখেছেন), পক্ষান্তরে, হেগেলের মতে বিশ্বজগৎ আবির্ভাবের পূর্বেই কোথায় যেন বিদ্যমান কোনও এক আইডিয়ার প্রতিচ্ছবিই হল বস্তু ও তার বিকাশ’। ‘লুডভিগ ফয়েরবাখ’ গ্রন্থে এঙ্গেলস ফয়েরবাখের দর্শন সম্পর্কে তাঁর ও মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করেছেন; হেগেল, ফয়েরবাখ ও ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণার বিষয়ে ১৮৪৪-১৮৪৫ সালে তিনি ও মার্কস যা লিখেছিলেন, তার পুরনো পাণ্ডুলিপিটি আবার পড়ে দেখার পর তিনি এ রচনাটি ছাপতে দিয়েছিলেন, তাতে এঙ্গেলস লিখেছেন ‘সমস্ত দর্শনের, বিশেষ করে সাম্প্রতিক দর্শনের বিরাট বনিয়াদি প্রশ্ন হল বাস্তব অস্তিত্বের সঙ্গে চিন্তার, প্রকৃতির সঙ্গে ভাবের সম্পর্ক বিষয়ক প্রশ্ন … কোনটা কার আগে, প্রকৃতির আগে ভাব না ভাবের আগে প্রকৃতি … এই প্রশ্নের যে যেমন উত্তর দিয়েছেন সেই অনুসারে দার্শনিকেরা দুইটি বৃহৎ শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। যাঁরা প্রকৃতির আগেই ভাবের অস্তিত্ব ঘোষণা করেছেন এবং সেই কারণে শেষ পর্যন্ত কোনও না কোনও ভাবে মেনেছেন যে, কেউ একজন বিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁরা হলেন ভাববাদী শিবির। আর যাঁরা প্রকৃতিকেই আদি বলে ধরেছেন, তাঁরা হলেন বিভিন্ন গোষ্ঠীর বস্তুবাদী। এছাড়া অন্য কোনও অর্থে (দার্শনিক ক্ষেত্রে) ভাববাদ ও বস্তুবাদ কথাটির ব্যবহার শুধু বিভ্রান্তিরই সষ্টি করবে। মার্কস যে শুধু কোনও না কোনও রূপে ধর্মের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ভাববাদকেই চূড়ান্তরূপে বর্জন করেছেন তাই নয়, আমাদের সময়ে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল যে মতবাদগুলি, হিউম ও কান্টের সেই সব দৃষ্টিভঙ্গি, অজ্ঞেয়বাদ, সমালোচনাবাদ, বিভিন্ন ধরনের পজিটিভিস্ট মতবাদকেও তিনি সুনির্দিষ্ট ভাবে নাকচ করেছেন। এই ধরনের দর্শনকে করতেন ভাববাদের কাছে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ নতিস্বীকার, কিংবা বড় জোর জগতের সামনে বস্তুবাদকে অস্বীকার করে, পিছনের দরজা দিয়ে লজ্জিত মুখে তাকে মেনে নেওয়ার একটা ধরন মাত্র। এই প্রসঙ্গে মার্কস ও এঙ্গেলসের পূর্বোক্ত রচনাবলি ছাড়াও ১৮৬৬ সালের ১২ ডিসেম্বরে এঙ্গেলসের কাছে লেখা মার্কসের একটি চিঠি দ্রষ্টব্য। তাতে সুবিদিত প্রকৃতিবিজ্ঞানী টমাস হাক্সলির একটি উক্তির উল্লেখ করে মার্কস লিখেছেন, ‘তাঁর সাম্প্রতিক কালে করা সব উক্তির চেয়ে বেশি বস্তুবাদী উক্তি’, ‘যতদূর আমরা প্রকৃত অর্থে পর্যবেক্ষণ করি ও চিন্তা করি, আমরা বস্তুবাদের থেকে সরে যেতে পারি না।’ তাঁর এই স্বীকৃতির উল্লেখ করেও মার্কস তাঁকে ভৎর্সনা করে বলেছেন, অজ্ঞেয়বাদ, হিউমবাদের জন্যে খিড়কির দরজাটা খুলে রেখে গেছেন। প্রয়োজনের (নেসেসিটি) সঙ্গে স্বাধীনতার সম্পর্ক বিষয়ে মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য প্রয়োজনের সঠিক উপলব্ধিই হল স্বাধীনতা। (ফ্রিডম ইজ রেকগনিশন অফ নেসেসিটি)। কিন্তু প্রয়োজনের উপলব্ধি সঠিক না হলে তা অন্ধ। এর অর্থ প্রকৃতিতে বাস্তব নিয়মের সার্বভৌম ক্ষমতাকে এবং প্রয়োজনের দ্বান্দ্বিক পরিবর্তনকে স্বীকৃতি দেওয়া। এটাই হল যথার্থ স্বাধীনতার স্বীকৃতি । একইভাবে অজ্ঞাত বস্তু পরিবর্তিত হয় জ্ঞাত বস্তুতে। স্বগত সত্ত্বার বস্তু (thing-in-itself ) পরিবর্তিত হয় বাস্তব ‘ আমাদের বস্তুতে’ (thing-for-us)। বিশেষ বস্তুর সারমর্ম (essence of things) পরিণত হয় বস্তুর সাধারণ সত্যে। ‘সেকেলে’ বস্তুবাদ তার মধ্যে ফয়েরবাখের বস্তুবাদেরও (এবং আরও বিশেষ করে ব্যুখনার, ফগ্ট ও মলেশতের ‘অর্বাচীন’ বস্তুবাদের) মৌলিক ত্রুটি মার্কস ও এঙ্গেলসের মতে এই (১) এ বস্তুবাদ ‘প্রধানত যান্ত্রিক’, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের সাম্প্রতিক আবিষ্কারের (পদার্থের বৈদ্যুতিক তত্তে্বর কথাটাও আজকের দিনে যোগ করা দরকার) হিসাব নেয়নি; (২) সেকেলে বস্তুবাদ অনৈতিহাসিক ও অদ্বান্দ্বিক (দ্বান্দ্বিকতাবিরোধী এই অর্থে অধিবিদ্যামূলক), বিকাশের দৃষ্টিকোণকে সুসঙ্গত ও সর্বাঙ্গীণভাবে অনুসরণ করেনি; (৩) মানব সারসত্তাকে’ (বিশেষ সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক) সর্বপ্রকার সামাজিক সম্পর্কের সমাহার’ হিসেবে না দেখে দেখা হয়েছে বিমূর্তভাবে, সুতরাং শুধু, বিশ্বের ‘ব্যাখ্যাই করা হয়েছে’ যেখানে প্রশ্ন হল এ বিশ্বকে পরিবর্তন করা, অর্থাৎ বিপ্লবী ব্যবহারিক ক্রিয়াকলাপের’ গুরুত্ব তারা বোঝেনি। (চলবে)