Breaking News

‘মন কি বাত’ – চাষিকে দিয়ে বলানো হল শেখানো বুলি

জনশ্রুতি, হজরত মহম্মদের এক উত্তরসূরি সুলতান মহম্মদ উমর তাঁর প্রজারা কেমন আছেন দেখার জন্য রাত্রিবেলা ছদ্মবেশে নগরীতে ঘুরতেন৷ তাঁদের সুবিধা–সুবিধা নিজ চোখে দেখে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতেন৷ এঁদের বলা হত প্রজাবৎসল৷ কিন্তু ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আচরণে প্রজাবাৎসল্যের চিহ্ণমাত্র নেই৷ তিনি তাঁর প্রজাদের দুরবস্থা নানা কৌশলে ঢেকে রাখতে চান৷ প্রজাদের ভাল রাখার থেকে তারা ভাল আছে দেখানোতে তাঁর আগ্রহ বেশি৷ তার জন্য আয়োজনও অঢেল৷ তেমনই একটি আয়োজন প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’৷

রেডিও এবং টিভিতে প্রচারিত এই অনুষ্ঠানটিতে প্রধানমন্ত্রীই বলেন বেশি, প্রজাদের কথা শোনেন কম৷ যদি বা কখনও শোনেন তা প্রজাদের মনের কথা নয়, প্রজাদের মুখ দিয়ে বলানো তাঁর নিজেরই শুনতে চাওয়া রঙ চড়ানো, বানানো কথা৷ এই যেমন ছত্তীসগঢ়ের গরিব চাষি চন্দ্রমণি কৌশিকের কথাই ধরুন৷ ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, চাষ করে তাঁর আয় বেড়েছে কি না? উত্তরে তিনি জানান, হ্যাঁ বেড়েছে৷ এর দ্বারা সারা দেশের মানুষকে বোঝানো গেল, চাষিরা কত ভাল আছে৷

এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল৷ কিন্তু সমস্যা বাধল অন্য জায়গায়৷ দিল্লির এক টিভি চ্যানেলের প্রতিনিধি পৌঁছে যান ওই কৃষক রমণীর কাছে৷ তাতেই ঝুলি থেকে বিড়াল বেরিয়ে এল৷ চন্দ্রমণি ওই সাংবাদিককে জানান, তাঁর আয় বাড়েনি৷ তা হলে তিনি এমন কথা বললেন কেন প্রধানমন্ত্রীকে? উত্তরে তিনি বলেন, ওই অনুষ্ঠানের আগে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কর্মীরা তাঁর বাড়ি এসে তাঁকে শিখিয়ে দেন ফোন করে প্রধানমন্ত্রীকে কী বলতে হবে৷ তিনি তাই বলেছেন৷

স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপি এর বিরোধিতা করেছে৷ তাঁদের বক্তব্য, ধান চাষে তাঁর আয় বাড়েনি– ওই মহিলা এ কথা ওই চ্যানেলকে বললেও আতা চাষে যে তাঁর আয় বেড়েছে সে কথাও বলেছিলেন৷ চ্যানেলটি নাকি সে কথা প্রকাশ করেনি৷ আতা চাষে চন্দ্রমণির আয় যদি সামান্য কিছু বেড়েও থাকে, মোদিজির মন কি বাতে কারও কারও গলায় আচ্ছে দিনের জয়গান যে আসলে আগে থেকে শিখিয়ে–পড়িয়ে রাখা কিছু মিথ্যে বুলিমাত্র– এ ঘটনায় তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার৷

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এমন করে শিখিয়ে দেওয়ার দরকার কী?  সরাসরি সত্যিটা জানলে অসুবিধা কোথায়? আসলে, না শেখালে দেশজুড়ে প্রচারিত এই অনুষ্ঠানে সাধারণ মানুষের মনের আসল কথাটি বেরিয়ে এসে বিজেপির আচ্ছে দিনের হাঁড়ি ভরা–হাটে ভেঙে দেবে৷ এইখানেই প্রধানমন্ত্রীর ভয়৷

গত লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দল বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল, বছরে দু’কোটি বেকারের চাকরি৷ সরকারি হিসেব বলছে, বছরে দু’লক্ষ চাকরির কথা স্বীকার করতেও এখন সরকারি আমলাদের জিভে আটকাচ্ছে৷ সম্প্রতি রেলের প্রায় ৯০ হাজার পদের জন্য আবেদন করেছেন আড়াই কোটিরও বেশি জন৷ উত্তরপ্রদেশে সরকারি অফিসে ৩৬৬টি পিওনের পদে আবেদন জমা পড়েছে ২৩ লক্ষ৷ তার মধ্যে ২৫৫ জন পিএইচডি, ২ লক্ষের বেশি ইঞ্জিনিয়ার৷ প্রধানমন্ত্রী চাকরি চেয়ে সময় নষ্ট না করে দেশের বেকারদের পকোড়া ভেজে আয় করতে পরামর্শ দেন৷ সামনেই কয়েকটি রাজ্য এবং লোকসভার নির্বাচন৷ দেশজোড়া লাগাতার কৃষক বিক্ষোভে জেরবার বিজেপি সরকার কৃষকদের ক্ষোভকে স্তিমিত করতে বেশ কিছু ফসলের সহায়ক মূল্য কিছুটা বাড়ানোর কথা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে৷ এই যৎসামান্য সহায়তাও কৃষকরা কবে পাবেন বা আদৌ পাবেন কি না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই৷ কারণ শুধু ঘোষণা করলেই চাষিরা সহায়ক মূল্য পাবেন না৷ টাকা বরাদ্দ করতে হবে, তা পাওয়ার পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে৷ সে উদ্যোগ কোথায়? ক্ষমতায় এসে একশো দিনে কালো টাকা উদ্ধার করে সবার অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ করে টাকা জমা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মোদি৷ নোট বাতিল করে বলেছিলেন, কালো টাকার মালিকরা আর রেহাই পাবে না৷ সম্প্রতি সুইস ব্যাঙ্কের দেওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, নোট বাতিলের পরে শুধু ২০১৭ সালেই সুইস ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের জমা করা কালো টাকার পরিমাণ ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে৷ লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি মানুষের জীবনকে জেরবার করে দিচ্ছে৷ লে–ফ, লক–আউট, ছাঁটাই শ্রমিকদের জীবন তছনছ করে দিচ্ছে৷ মহিলাদের উপর নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে৷ সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই ব্যর্থতার কথা প্রধানমন্ত্রী কিংবা তাঁর দলের নেতাদের অজানা নয়৷ এই অবস্থায় সাধারণ মানুষের মনের কথা শুনে সত্যের মুখোমুখি হওয়ার সাহস কি প্রধানমন্ত্রী দেখাতে পারেন তাই শেখানো বুলি বলানোর ব্যবস্থা!

(৭০ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা ২০ জুলাই, ২০১৮)