এবার পুজো ভাল কাটেনি দুলাল দাসের৷ হাতিবাগান মার্কেটে জামাকাপড়ের ছোট দোকান তাঁর৷ বললেন, ‘‘বিক্রিবাটা কোথায়? এবার ভিড় দেখতে পেয়েছেন হাতিবাগানে? ওই ছুটির দিনগুলোতে যা একটু৷ অন্যান্য বার গার্ড রেল দিয়ে ভিড় সামলায় পুলিশ, এবার তার দরকারও পড়েনি৷’’ এক ব্যাগ বিক্রেতা বললেন, ‘‘অন্য বার দিনে যদি তিনটে ব্যাগ বিক্রি হত, এবার হয়েছে একখানা৷ কিনবে কে, পয়সা কোথায় লোকের হাতে?’’
বাস্তবিকই টাকা–পয়সা নেই বেশিরভাগ মানুষের হাতে৷ পশ্চিমবঙ্গে জামাকাপড়ের সবচেয়ে বড় তিনটি পাইকারি বাজার– হরিসা হাট, মঙ্গলা হাট আর মেটিয়াবুরুজ– সর্বত্রই এই উৎসবের মরশুমেও ছিল কেনাকাটায় মন্দা৷ আগের তুলনায় বিক্রি তিন ভাগের একভাগ হয়ে গেছে৷ রাজ্য সরকারের উদ্যোগে জামাকাপড়ের মেলা ‘তাঁতের হাট’–এর এক বিক্রেতা জানিয়েছেন, এ বছর বিক্রি প্রায় ৪০ শতাংশ কমে গেছে৷
শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, গোটা দেশের আর্থিক পরিস্থিতি যে সঙ্গীন, গত কয়েক মাস ধরে খবরের কাগজ খুললেই তার আঁচ পাওয়া যাচ্ছে৷ এবার আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার বা আইএমএফ–এর ম্যানেজিং ডিরেক্টরও মন্তব্য করেছেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মন্দা চলছে, তার প্রকট প্রভাব দেখা যাচ্ছে ভারতে এবং এই মন্দা শিগগির কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই৷ ভারতীয় অর্থনীতিতে মন্দার গ্রাসের কথা বলেছে বিশ্বব্যাঙ্কও৷
অবশ্য কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী সহ মোদি সরকারের নেতা–মন্ত্রীরা তো বটেই, এমনকী সংঘ–প্রধান মোহন ভাগবত অবধি মন্দার কথা স্বীকার করা দূরের কথা, তা নিয়ে আলোচনাতেও রাজি নন৷ যদিও সরকারি পরিসংখ্যানগুলিতেই প্রকট অর্থনীতির চরম রুগ্ণ চেহারা৷ পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, গত ছ’বছরের তুলনায় এ বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে (এপ্রিল–জুন ’১৯) ভারতে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি বৃদ্ধির হার সবচেয়ে কমে নেমে এসেছে ৫ শতাংশে৷ রিজার্ভ ব্যাঙ্কও ঘোষণা করেছে ২০১৯–’২০ আর্থিক বছরে বৃদ্ধির সম্ভাব্য হার ৬.৯ শতাংশ থেকে কমে ৬.১ শতাংশ হয়ে যেতে পারে৷ সরকারি হিসাবেই দেখা যাচ্ছে, যে আটটি শিল্প নিয়ে দেশের শিল্প উৎপাদনের প্রধান ক্ষেত্র তথা কোর সেক্টর গঠিত, সেই বিদ্যুৎ, ইস্পাত, পরিশোধিত ও অপরিশোধিত পেট্রোলিয়াম, কয়লা, সিমেন্ট, প্রাকৃতিক গ্যাস ও সারের উৎপাদন এ বছরের আগস্ট মাসে আগের বছরের এই সময়ের তুলনায় ০.৫ শতাংশ কমে গেছে৷ এই আটটি শিল্পের বৈশিষ্ট্য হল, এগুলি অন্য শিল্পে উৎপাদনের উপাদান হিসাবে কাজ করে৷ তাই এই শিল্পগুলিতে উৎপাদনের হার কমে যাওয়ার অর্থ, অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রে এই উপাদানগুলির চাহিদা কমে যাওয়া৷ অর্থাৎ অন্যান্য শিল্পগুলিতেও উৎপাদনের পরিমাণ কমছে৷
কেন কমছে উৎপাদন? এর আসল কারণ– বিজেপির নেতা–মন্ত্রীরা যতই অস্বীকার করুন– দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের চাহিদা তথা কেনার ক্ষমতার আকাল৷ যে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটির মধ্যে আমরা রয়েছি, তার চরিত্র বৈশিষ্ট্য হিসাবেই ক্রয়ক্ষমতার এ হেন অভাব৷ সমাজবিকাশের নিয়ম ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কার্ল মার্কস তাঁর যুগান্তকারী তত্ত্বে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন শোষণমূলক এই ব্যবস্থাটিতে কীভাবে শ্রমিককে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে পুঁজিপতি শ্রেণি সর্বোচ্চ মুনাফা লোটে৷ শোষিত বঞ্চিত শ্রমিক ক্রমে নিঃস্বতর হতে থাকে৷ পাশাপাশি, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে উৎপাদন খরচ কমানোর বাধ্যতায় ক্রমশ উৎপাদন ব্যবস্থাকে যন্ত্রনির্ভর করে তোলে পুঁজিমালিকরা৷ কমতে থাকে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা, আর লম্বা হতে থাকে বেকার বাহিনী ও ছাঁটাই শ্রমিকের মিছিল৷ টান পড়তে থাকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে–খাওয়া মানুষের পকেটে৷ কমতে থাকে তাদের কেনার সামর্থ্য৷ একটা পর্যায়ে পৌঁছে যখন ব্যাপক সংখ্যক মানুষ কেনার ক্ষমতা হারায় তখনই অর্থনীতি চলে যায় মন্দার গ্রাসে৷ একের পর এক বন্ধ হতে থাকে কল–কারখানা–দোকান৷ বেকারি আরও বাড়তে থাকে, আরও কমতে থাকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা৷
এদেশের ছবিটা এখন ঠিক এইরকম৷ বর্তমানে ভারতে বেকারির হার এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছেছে৷ গত ৪৫ বছরের মধ্যে এমন ভয়াবহ বেকারত্ব দেশের মানুষ দেখেনি৷ মন্দার কারণে শুধু গাড়ি শিল্পেই প্রায় ১০ লক্ষ মানুষের কাজ চলে যেতে বসেছে৷ করুণ অবস্থা পোশাক শিল্পের৷ উত্তর ভারতের কাপড়ের কারখানাগুলির সংগঠন ‘নিটমা’ আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, মন্দার প্রভাবে এই শিল্পে কাজ হারাতে পারেন ৫০ লক্ষেরও বেশি শ্রমিক–কর্মচারী৷ দেশের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ যুক্ত আছেন চাষবাসের কাজে৷ তাঁদের অবস্থা ভয়াবহ৷ সার–বীজ–কীটনাশকে খরচে জেরবার ঋণগ্রস্ত চাষি ফসলের ন্যায্য দাম পায় না৷ আত্মঘাতী চাষির মিছিল দিনে দিনে দীর্ঘতর হচ্ছে৷ অর্থনীতির বাকি ক্ষেত্রগুলিরও একই হাল৷ সব মিলিয়ে দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ঠেকেছে তলানিতে৷ উৎপাদিত শিল্পপণ্যগুলি গুদামে জমে থাকছে, বিক্রি হচ্ছে না৷ ফলে ক্রমে বেড়ে চলেছে বন্ধ হয়ে যাওয়া কলকারখানা–ব্যবসা সংখ্যা৷
এই যখন অবস্থা তখন দরকার ছিল সরকারের তরফে ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের হাতে টাকার জোগান দেওয়া৷ দরকার ছিল সার–বীজ–কীটনাশকে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সীমাহীন মুনাফা বন্ধ করে সেগুলি চাষিদের সস্তায় সরবরাহের ব্যবস্থা করা এবং উপযুক্ত মূল্যে চাষির ফসল কিনে নিয়ে গ্রামীণ মানুষের হাতে নগদ টাকার জোগান বাড়ানো৷ এভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের হাতে কেনার ক্ষমতা তুলে দিতে পারলে অর্থনৈতিক মন্দা কিছুটা হলেও কাটানো যেত৷ সরকারের উচিত ছিল সেই পথে হাঁটা৷ কিন্তু তা না করে দেখা যাচ্ছে পুঁজিপতিদের জন্য খয়রাতির দানছত্র খুলে দিয়েছে কেন্দ্রের মোদি সরকার৷ বাজেটে বিপুল সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার পরেও গত ২০ সেপ্টেম্বর মোদি সরকারের অর্থমন্ত্রী কর্পোরেট সংস্থাগুলির করের হার কমানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে বৃহৎ পুঁজির মালিকদের হাতে নতুন করে প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকা তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন৷ এই ঘোষণার ঠিক আগেই রপ্তানি ব্যবসায় সুবিধা দেওয়ার নামে পুঁজিপতিদের ৫০ হাজার কোটি টাকা পাইয়ে দিয়েছে মোদি সরকার৷ বড় মাপের রিয়েল এস্টেট কারবারিদের জন্যও ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ঘোষণা করেছে তারা৷ বাস্তবে ২০১৪ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর থেকে পুঁজিমালিকদের তুষ্ট করার কাজে ছেদ ঘটায়নি মোদি সরকার৷ গত সাড়ে পাঁচ বছরে প্রায় ৬ লক্ষ কোটি টাকা পুঁজিপতিদের উপঢৌকন দিয়েছে তারা৷
এর উপর রয়েছে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার নিয়ে শোধ না করার ঘটনা৷ শুধু বিজয় মাল্য, নীরব মোদি, মেহুল চোকসিদের মতো রাঘব–বোয়ালরাই নয়, আরও বহু বিত্তশালী শিল্পপতি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেন না৷ একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০১৫ থেকে ’১৮ সাল পর্যন্ত শোধ না হওয়া ঋণ বা এনপিএ–র মোট পরিমাণ ২ লক্ষ ১৭ হাজার কোটি টাকা৷ এইসব ঋণখেলাপিদের মধ্যে একটা বড় অংশই হল বৃহৎ পুঁজিপতি৷ এদের গ্রেপ্তার করে, সম্পত্তি ক্রোক করে ঋণের টাকা আদায় করার বদলে মোদি সরকার ব্যাঙ্কগুলিকে বাঁচাতে এ বছরে জনগণের কাছ থেকে আদায় করা ৭০ হাজার কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে৷ যদিও ব্যাঙ্ক থেকে নতুন ঋণ নেওয়ার লোকেরই অভাব৷ বিনিয়োগ হলে তবে তো ঋণের প্রশ্ন আসে৷ চাহিদার অভাবে সে পথ বন্ধ৷ স্টেট ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যানই বলছেন, ২ লক্ষ কোটি টাকা নিয়ে বসে আছেন তাঁরা, ঋণ নেওয়ার লোক নেই৷
উৎপাদনের জন্য লগ্ণিতে উৎসাহ দেওয়ার নামে পুঁজিপতিদের পায়ে দেদার টাকা উপঢৌকন দিয়ে চলেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার৷ অথচ পুঁজিমালিকদের মুনাফা যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তা থেকেই স্পষ্ট লগ্নি বা পুঁজির অভাবের জন্য নয়, দেশের অর্থনীতি মন্দায় ধুঁকছে দেশের মোট ক্রেতাদের অধিকাংশ, অর্থাৎ খেটে–খাওয়া সাধারণ মানুষের হাতে পয়সা না থাকার কারণে৷ পুঁজিপতিদের পাইয়ে দিতে সরকার যত দরাজ হচ্ছে, ততই দুর্দশা বাড়ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের৷ কারণ মালিকদের পায়ে যত টাকা ঢালা হচ্ছে, ততই কমছে সাধারণ মানুষের জন্য সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ৷ তাই পুঁজিমালিকদের তুষ্ট করার দাপটে রাজকোষে যখনই টান পড়ছে, তখনই কমতে থাকছে ভরতুকি সহ কল্যাণমূলক খাতগুলিতে সরকারি খরচ৷ কমছে শিক্ষা, স্বাস্থ্যে বরাদ্দের পরিমাণ৷ উঠে যেতে বসেছে রেশনের মতো কম দামে মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়ার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাটিও৷
গরিবি বেকারি ছাঁটাইয়ে জর্জরিত কোটি কোটি মানুষ দিনে দিনে তলিয়ে যাচ্ছে দারিদ্রের অন্ধকারে৷ অসহনীয় জীবনযন্ত্রণায় জেরবার হয়ে বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ৷ প্রধানমন্ত্রী কিংবা সরকারে তাঁর প্রধান সহযোগী অমিত শাহদের হেলদোল নেই৷ তাঁরা ব্যস্ত পুঁজিমালিকদের মুনাফার ভাণ্ডার রক্ষার ‘মহান’ কাজে৷
পুঁজিবাদী এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় এটাই নিয়ম৷ এখানে শাসক পুঁজিপতি শ্রেণির রাজনৈতিক ম্যানেজারের কাজ করে সরকারে আসীন দলগুলি৷ সেই পথ ধরেই পুঁজিপতিদের পায়ে দাসখত লিখে দিয়ে কেন্দ্রে সরকারি ক্ষমতায় বসেছে বিজেপি৷ সেই দাসখত মেনেই জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ পুঁজিপতিদের হাতে অবাধে তুলে দেন মোদি–শাহরা৷ তাই আম্বানি, আদানিদের সম্পদের পরিমাণ যখন আকাশ ছোঁয়, ঠিক তখনই দেশের খাদ্যভাণ্ডারে ৭১৩ লক্ষ টন খাদ্যশস্য সঞ্চিত থাকা সত্ত্বেও কেনার ক্ষমতা না থাকায় সরকারি হিসাবেই ২০ কোটিরও বেশি মানুষকে না খেয়ে মরতে হয়৷
যতদিন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা টিকে থাকবে, অর্থাৎ ব্যক্তিমালিকের সর্বোচ্চ মুনাফার লক্ষ্যে উৎপাদন ব্যবস্থা চলবে, ততদিন এই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্তি নেই৷ অথচ, দেশবাসীর প্রয়োজনকে সামনে রেখে যদি উৎপাদন হত, তবে সেই প্রয়োজন মেটাতে অজস্র কল–কারখানা স্থাপনের প্রয়োজন হত এবং সেই পথেই বেকার সমস্যারও সমাধান হত৷ কিন্তু পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অটুট রেখে তা হওয়ার উপায় নেই৷ তাই পুঁজিবাদ যতদিন থাকবে, ততদিন এই সংকট থাকবে এবং ক্রমাগত তীব্র হবে৷ এর মধ্যেও বেসরকারিকরণ রুখে দিয়ে জনগণের স্বার্থে সামাজিক কল্যাণে সরকারকে খরচ করতে বাধ্য করা, কৃষকদের আয়ের গ্যারান্টি ইত্যাদি দাবি আদায় করার জন্য ব্যাপক গণআন্দোলন চাই৷ একই সাথে এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রয়োজনের ভিত্তিতে পরিচালিত পরিকল্পিত অর্থনীতি তথা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে৷