বছর দেড়েক আগে বিয়ে করে নতুন সংসার পেতেছে বছর তিরিশের নীলেশ। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা, সদ্য আসা ছোট্ট নতুন অতিথি। কিন্তু হঠাৎই ঘনিয়ে এল সঙ্কটের কালো মেঘ। পারিবারিক ছোট ব্যবসা বন্ধের মুখে, হাতে পয়সা নেই। অথচ সকলের দায়িত্ব তারই কাঁধে। যে সংসার হাসিখুশিতে ভরে থাকার কথা, তাতে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। দীর্ঘশ্বাসের সাথে গলা দিয়ে বেরিয়ে এল– ‘রেশনে চাল-গম না দিয়ে যদি একটু বিষ দিত’।
অনলাইন খাবার ডেলিভারি কোম্পানিতে কাজ করে অরুণ। দু’বেলা বাইক নিয়ে ছুটে চলে শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। মাসে যা রোজগার হয় তাতে কোনও রকমে তিন জনের সংসার চলে যায়। অতিমারিতে খাবারের অর্ডার কমে গেল। মানুষের রোজগার অনিশ্চিত হলে রেস্টুরেন্টের অর্ডারও অনিশ্চিত। ফলে অরুণদেরও মজুরির ওঠানামা বাড়ছে। অজস্র বেকার যুবক এই কাজে ঢোকায় কাজের ক্ষেত্রও ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে। তাকে আর ঘনঘন বাইক ছোটাতে দেখা যায় না। পেট্রল-ডিজেলের দাম প্রতিদিন বাড়তে থাকায় বাইকের খরচ জোগানোও কষ্টকর।
বাড়ি বাড়ি পরিচারিকার কাজ করেন কমলা মাসি। লক্ষ্মীকান্তপুর থেকে ট্রেনে শিয়ালদায় এসে কয়েকটি বাড়িতে তার কাজ। বাড়িতে পঙ্গু স্বামী, দুই ছেলে। ভোররাতে উঠে তাদের ফেলে দৌঁড়তে দৌঁড়তে কাজ সেরে আবার সন্ধ্যেয় বাড়ি ফেরা। এমনটাই চলছিল। করোনায় দীর্ঘদিন ট্রেন বন্ধ, তার উপর গৃহস্থ লোক রাখতে নারাজ। এখন কিছু কলমি শাক আর থানকুনি পাতা নিয়ে রাস্তার ধারে বসে কমলা সুর করে ডাকে– ‘শাক নিয়ে যান বাবু, ভাল শাক’। এভাবেই কমলারা বেঁচে থাকার লড়াই করছে। চিত্রগুলি শুধু কলকাতা শহরের নয়, দেশের সর্বত্রই করোনা ও লকডাউন পরিস্থিতিতে রোজগারহীন মানুষের এরকমই ভয়ঙ্কর দুর্দশা।
কেন্দ্রের সরকার শোনাচ্ছে ‘আচ্ছে দিনের’ কথা, ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশের’ কথা। অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সিএমআইই-র সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্র মিলিয়ে আগস্টে দেশে কাজ হারিয়েছেন প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ। যার মধ্যে রয়েছেন ওই দু’জনের মতো অসংখ্য যুবক এবং কমলা মাসিরাও।
বহু ছোট-মাঝারি ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হয়নি, উল্টে সরকারের শ্রমিক ছাঁটাই নীতি ও জনবিরোধী অন্যান্য নীতির ফলে কাজ চলে গেছে কয়েক কোটি মানুষের। বেকারত্বের হার মোদি জমানায় সাড়ে চার দশকে সর্বোচ্চ। নিরুপায় হয়ে আত্মহত্যার পথ নিতে বাধ্য হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ।
বিজেপি সরকারের আচ্ছে দিনের প্রতিশ্রুতি অবশ্য পুরোপুরি ‘মিথ্যা’ নয়। আচ্ছে দিন এসেছে দেশের ধনকুবেরদের, পুঁজিপতিদের। অতিমারির মধ্যেই মুকেশ আম্বানি, গৌতম আদানি সহ দেশের প্রথম সারির ধনকুবেরদের সম্পদ এক বছরে বেড়ে দেড়গুণ হয়েছে। ১০ হাজার কোটি ডলারের বেশি সম্পত্তির মালিক হয়ে বিশ্বের ধনকুবেরদের সাথে পাল্লা দিচ্ছে মুকেশ আম্বানি গোষ্ঠী। ২০২১-এ আদানি গোষ্ঠীর প্রায় সবকটি ব্যবসার শেয়ারের মূল্য ৫০ শতাংশ হারে বেড়েছে। কোনও কোনও ব্যবসায় আদানিদের মুনাফার হার ছাপিয়ে গিয়েছে ৯০ শতাংশ।
দেশের মানুষের কর্মহীনতা, দারিদ্রের চিত্র সামনে এলেই সরকারি নীতির সমর্থক এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী বলতে থাকেন, কর্মহীন, দরিদ্র মানুষদের সরকার কিছু অনুদান দিলে সমাজে একটা সাম্যের পরিবেশ তৈরি হত। তাঁরা মনে করেন এবং অন্যদের বোঝান, এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেও কিছু কল্যাণমূলক পদক্ষেপ নিলেই ধনী-দরিদ্রের মধ্যেকার শতযোজন দূরত্ব ঘুচে যেতে পারে। সেই ব্যবস্থা কী? সরকার দরিদ্রদের কিছু ভরতুকি দিতে পারে, বাজেটে তাদের জন্য কিছু প্রকল্প ঘোষণা করতে পারে অথবা ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধি হলে তার থেকে ছিটেফোঁটা কিছু দরিদ্রদের দিতে ‘কর্পোরেট সোসাল রেসপনসিবিলিটি’ জাতীয় কিছু করতে পারে। কিন্তু মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর প্রশ্নে সরকার কী করেছে? একটা দুটো প্রকল্পের সুবিধাভোগী হলে কি ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে মানুষের? দেশের বেশিরভাগ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লে কি অর্থনীতি চাঙ্গা হতে পারে? অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ার কারণ হিসেবে অতিমারির অজুহাত দিচ্ছেন দেশের অর্থমন্ত্রী। অতিমারি আসার আগেও কী অর্থনীতির কিছুমাত্র সুস্থির অবস্থা ছিল? নাকি মৃতপ্রায় পুঁজিবাদী অর্থনীতি মৃত্যুশয্যায় কোনওক্রমে সংস্কারের কোরামিন নিয়ে ধুঁকছিল? আর্থিক বৃদ্ধির হার ক্রমাগত নিচে নামছিল। ফলে করোনাতে বিজেপি নেতাদের মুখরক্ষা হয়নি।
সাধারণ মানুষ রুটি-রুজি হারাচ্ছেন, শ্রমিকদের রক্ত-ঘাম নিংড়ে নিচ্ছে মালিকরা, ছাঁটাই চলছে নির্বিচারে। কৃষিক্ষেত্রকে বেসরকারি মালিকের মুনাফার গ্রাসে দেওয়ায় কৃষিজীবী মানুষ সর্বস্বান্ত। এরকম অবস্থায় সরকারের দরকার ছিল তাদের পাশে দাঁড়ানো। এই সব ক্ষেত্রের মানুষদের সব রকমের ট্যাক্স মকুব করা, খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, তা না করে পুঁজিপতিদের কর মকুব করছে সরকার। বৃহৎ পুঁজিমালিকদের কর ছাড় দিয়ে আর্থিক সুবিধা হিসাবে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। কারণ তাদের নাকি ব্যবসায় ভয়ানক ক্ষতি হয়েছে! মুকেশ আম্বানির বিশ্বের ধনকুবেরদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কি ব্যবসায় লোকসানের নমুনা? দেখা যাচ্ছে, কর্পোরেট কর আদায় আগের বছরের তুলনায় ২০২০ তে কমেছে ৫৫ শতাংশ।
সরকারকে দেয় করের বিপুল পরিমাণ ফাঁকি দিচ্ছে ধনকুবেররা। চূড়ান্ত অসমাম্যের এই পুঁজিবাদী সমাজে অসংখ্য নীলেশ, অরুণ, কমলা মাসি ক্রমাগত দারিদ্রের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে, হাবুডুবু খাচ্ছে সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে। আর সরকার সাধারণ মানুষকে উন্নয়নের খোয়াব দেখিয়েই দায়িত্ব শেষ করছে!