চলে গেল ৮ মার্চ। আরও একটি নারীদিবস পার হলাম আমরা। রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু কর়ে প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী– সকলেই হাসিমুখে সেদিন দেশের মহিলাদের অভিনন্দন জানালেন। নারীশক্তির সাফল্যকে কুর্নিশ জানিয়ে তাঁর ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বললেন, তাঁদের সরকার নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করে। আর রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রী বললেন, নারীর অধিকার তাঁর সরকারের অঙ্গীকার। অথচ খোদ কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান মন্ত্রক সম্প্রতি জাতীয় নমুনা সমীক্ষার যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, সেদিকে তাকালে এ কথা না বলে উপায় থাকে না যে, এ সবই হল প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীর স্রেফ কথার কথা।
২০২০-র জানুয়ারি থেকে ২০২১-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে করা এই সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণীদের প্রায় ৪৪ শতাংশই ঘরবন্দি জীবন কাটাচ্ছে। তারা না করছে স্কুল-কলেজে পড়াশোনা, না নিচ্ছে আগামী দিনে কাজে লাগার মতো কোনও প্রশিক্ষণ, না যুক্ত রয়েছে উপার্জনের কোনও একটা উপায়ের সঙ্গে। ঘরোয়া কাজকর্ম করেই দিন কাটছে তাদের। পশ্চিমবঙ্গের দশা আরও ভয়ানক। এ রাজ্যে এই বয়সী মেয়েদের অর্ধেক অংশেরই সুনির্দিষ্ট কোনও কাজ নেই। পশ্চিমবঙ্গে এমন মেয়েদের হার ৪৯.৯ শতাংশ। অর্থাৎ জীবনের যে সময়টায় আগামী দিনের জন্য নানা ভাবে তৈরি হওয়ার কথা, কিংবা যুক্ত হওয়ার কথা অর্থ-উপার্জনে, সেই সময়টায় এ সবের সমস্ত সুযোগ থেকে বঞ্চিত দেশের বিপুল সংখ্যক মেয়ে। নষ্ট হচ্ছে তাদের কর্মক্ষমতা, জীবনীশক্তি। ঘরের ছোট্ট গণ্ডিতে আটকে থাকায় না তারা সমাজের ভালমন্দ নিয়ে সচেতন হতে পারছে, না বাড়ছে তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা।
একই বয়সী ছেলেদের হাল তুলনায় ভালো। এই সমীক্ষাতেই দেখা যাচ্ছে, দেশে পড়াশোনা, ট্রেনিং বা কোনও কাজে যুক্ত না থাকা ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী ছেলে রয়েছে ১৬ শতাংশের সামান্য বেশি। রাজ্যে এই হার জাতীয় গড়ের কাছাকাছিই– প্রায় ১৮ শতাংশ।
বিশ শতকের শুরুর দিকে নারী-পুরুষে সমানাধিকার ও ভোটাধিকারের দাবিতে শুরু হয়েছিল যে নারী আন্দোলন, তারই ধারাবাহিকতায় ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক দল প্রথম নারীদিবস পালন করে। ১৯১৭ সালে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হওয়ার পর থেকে প্রতি বছর ৮ মার্চ দিনটি আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। আজ ভারতে ভোট দেওয়ার অধিকারটুকু পেয়েছে মেয়েরা, কিন্তু দীর্ঘ সময় কেটে যাওয়ার পরেও কোথায় নারী-পুরুষে সাম্য, কোথায় বা সমানাধিকার আনার জন্য সরকারি উদ্যোগ! নারী-পুরুষে সমতা যে বহু যোজন দূরে জাতীয় নমুনা সমীক্ষার সাম্প্রতিক এই রিপোর্টই তার প্রমাণ।
কাজের বাজারেও ক্রমাগত কমে যাচ্ছে মেয়েদের যোগদানের হার। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৪-‘০৫-এ দেশে কর্মরত ছিলেন ৩৭ শতাংশ মহিলা। ২০১৬-তে সেই হার নেমে পৌঁছেছে ২৬ শতাংশে। গত বছর প্রকাশিত অক্সফ্যাম ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টটি তো আরও মারাত্মক। তারা দেখিয়েছে শহরগুলিতে যেখানে ৬০ শতাংশ পুরুষ কোনও নিয়মিত কাজ বা স্বনিযুক্ত পেশায় যুক্ত, সেখানে এরকম মহিলার হার মাত্র ১৯ শতাংশ। গ্রামগুলিতে এ বৈষম্য আরও চওড়া।
কেন এই বৈষম্য? আসলে এই সমাজে মেয়েরা একদিকে পুঁজিবাদী শোষণের শিকার। একই সাথে তাদের উপর চেপে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শোষণ। এই দুই শোষণের ফলে মেয়েরা পিছিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে পুরুষদের তুলনায়। এ সমাজে আজও মনে করা হয়, পুরুষের কর্তৃত্ব মুখ বুজে মেনে, আর্থিক ভাবে তাদের উপরে নির্ভর করে চলাটাই ‘ভাল’ মেয়ের লক্ষণ। ঘরকন্না, বিশেষ করে সন্তানপালনকেই নারীজীবনের প্রধান ও একমাত্র কাজ বলে মনে করেন অধিকাংশ পরিবারের কর্তা। অনেক বাধা পার হয়ে যে অল্প কয়েকজন নারী আর্থিক স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে কাজের জগতে ঢুকতে পারে, সমাজমননে বহাল থাকা সামন্তী পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে সেখানেও অধিকাংশ সময় তাদের স্বাগত জানানো হয় না। পদে পদে নানা মানসিক, এমনকি শারীরিক লাঞ্ছনা সয়ে সেখানে কাজ করতে হয় তাদের। অসহায়তার সুযোগ নিয়ে কম মজুরিতে মেয়েদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেয় মালিকরা। নিরাপত্তার অভাবে অনেকে কাজ ছেড়ে দিতেও বাধ্য হয়। এই পরিস্থিতি কাজের জগতে আসার ক্ষেত্রে মেয়েদের এবং তাদের অভিভাবকদের মনে অনীহা তৈরি করে। তাই দেখা যায়, পরিবারের আর্থিক সঙ্কটের কারণে মেয়েরা কখনও কাজে যোগ দিলেও সমস্যা কমতেই তারা ফিরে চলে যায় সংসারের ঘেরাটোপে।
দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তার বড় অংশটাই যদি এভাবে পড়াশোনা, কাজকর্ম ইত্যাদি থেকে মুখ ফিরিয়ে ঘরবন্দি থাকে, যদি তাদের বুদ্ধি, চেতনা ও কর্মক্ষমতার যথাযথ ব্যবহার না হয়, তাহলে তো গোটা সমাজটাই পিছিয়ে পড়ে থাকে। এ দেশে সেটাই হচ্ছে। অন্যদিকে উৎপাদনে ও সমাজ বিকাশের লড়াইয়ে অধিকাংশ নারী যোগ দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত বলে তাদের শুধুই ভোগের সামগ্রী হিসাবে দেখার, সমস্ত দিক দিয়ে পুরুষের থেকে খাটো এক ধরনের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে ভাবার অভ্যাস সমাজমননে থেকেই যাচ্ছে। নারীর প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে চরম নৈতিক অবক্ষয় যুক্ত হয়ে ক্রমাগত বাড়িয়ে তুলছে নারীধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা। নিজেকে মানুষ হিসাবে সমমর্যাদার যোগ্য বলে প্রমাণ করার সুযোগ মিলছে না নারীর।
এই অবস্থা পাল্টাতে উদ্যোগ নেওয়ার কথা তো প্রধানত কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে মঞ্চ-কাঁপানো ভাষণ আর নারীদিবসে লোক-দেখানো, চটকদার কিছু উৎসব-অনুষ্ঠানে দেদার পয়সা খরচ করা ছাড়া মেয়েদের পূর্ণ মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কাজের কাজ সরকারগুলি কিছুই করছে না।
কেন্দ্রীয় সরকারে আসীন বিজেপি দলটির আদর্শগত অবস্থান এ দেশের পিছিয়ে-পড়া সামন্তবাদী পুরুষতান্ত্রিক মননের সঙ্গে চমৎকার খাপ খেয়ে যায়। তাই ‘সুসন্তান’-এর জন্ম দিতে আরএসএসের নিদান মেনে গর্ভবতী নারীদের জন্য চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক ভাবে ১ হাজার দিনের ‘গর্ভসংস্কার’ কর্মসূচি রূপায়ণে তাদের যত সক্রিয়তা, তার সামান্যও দেখা যায় না নারী-পুরুষের সমবেতন চালু কিংবা কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা রোধের আইন ঠিকমতো রূপায়িত হচ্ছে কি না, তার নজরদারিতে। কর্মরত মায়ের সন্তানদের দেখভালের জন্য কর্মক্ষেত্রের কাছে উন্নত মানের ক্রেশ তৈরির উদ্যোগ তো অনেক দূরের কথা। বুঝতে অসুবিধা হয় না, নারীদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ স্লোগান আসলে নিতান্তই লোক-দেখানো।
রাজ্য সরকারের ভূমিকাও অন্যরকম কিছু নয়। মাসে মাসে মহিলাদের অ্যাকাউন্টে কিছু খয়রাতি করেই মুখমন্ত্রী দায়িত্বপালনের গর্ব অনুভব করছেন। মহিলাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থায় তাঁর উদ্যোগ কোথায়? নিজে মহিলা হওয়ার সুবাদে মেয়েদের আরও বেশি করে শিক্ষার আঙিনায় টেনে আনা যাঁর গুরুদায়িত্ব ছিল, সেই মুখ্যমন্ত্রী কন্যাশ্রী প্রকল্প চালু করে দায় সেরেছেন। বহু ক্ষেত্রেই সেই প্রকল্পের টাকা যে উচ্চশিক্ষার বদলে কন্যাদের আঠারো বছর পার হলেই চটপট বিয়ে দেওয়ার কাজে লাগছে, সে ব্যাপারে তাঁর সরকারের হেলদোল নেই। রামমোহন, বিদ্যাসাগরের বাংলা আজ নাবালিকা বিবাহের হারে জাতীয় গড় ছাপিয়ে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। এ লজ্জা রাখার ঠাঁই কোথায়!
ফলে শুধু সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলে চলবে না। পূর্ণ মানুষের অধিকার নিয়ে নারীর মর্যাদাময় জীবনের দাবিতে এগিয়ে আসতে হবে সেইসব মহিলাদের, যাঁরা এই বৈষম্যের সমাজেও কিছুটা আলোয় আসার সুযোগ পেয়েছেন। সোচ্চার হতে হবে দেশের সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকেই। অল্পবয়সী মেয়েদের বিয়ে রুখতে, তাদের পড়াশোনার সুযোগ করে দিতে সরকারগুলি যাতে সক্রিয় হয়, সেই দাবিতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া এই অন্ধকার দূর করার রাস্তা কোথায়!