মতুয়া ও নমশূদ্র উন্নয়ন বোর্ড নামে আরও দুটি উন্নয়ন বোর্ড গঠনের সিদ্ধান্ত নিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার৷ এই বোর্ড দু’টি কোনও এলাকাভিত্তিক নয়, ধর্ম–সম্প্রদায় ভিত্তিক৷ একটি নমশূদ্রদের জন্য, অপরটি মতুয়া সম্প্রদায়ের৷ সরকারি ভাষ্য হল, সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষের কাছে সরকারি উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দিতেই এই সিদ্ধান্ত৷ এর আগে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার দার্জিলিং পার্বত্য পরিষদ এলাকাতেই লেপচা, ভুটিয়া, তামাং, শেরপা, ভুজেল, নেওয়ার, কুম্ভ, রাই সহ ১৫টি জনজাতির জন্য ১৫টি পৃথক উন্নয়ন বোর্ড গঠন করেছে৷
মতুয়া ও নমশূদ্র উন্নয়ন বোর্ড গঠনের ক্ষেত্রে যে সম্প্রদায় দু’টিকে ধরা হয়েছে, তা বেশ গোলমেলে৷ কারণ, যাঁরা মতুয়া, সাধারণত তাঁরা প্রায় সকলেই নমশূদ্র৷ তাহলে শুধু নমশূদ্র উন্নয়ন বোর্ড করলেই তো হত আলাদা উন্নয়ন বোর্ড কেন? উত্তরটা দিয়ে দিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের এক নেতা এবং মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক৷ তিনি বলেছেন– ‘‘মতুয়ারা সংখ্যায় প্রায় দেড় কোটি৷ তাঁরা আমাদের সঙ্গে আছেন৷’’ অর্থাৎ মতুয়াদের উপর দলীয় রঙ লাগিয়ে ঘুরপথে তিনি বলে দিয়েছেন, ‘মতুয়ারা তৃণমূলের সঙ্গে আছেন’, যা তারা ভোটের কাজে লাগাবেন৷ অন্য এক নেতার কথায়, ‘মতুয়ারা বেশিরভাগই নমশূদ্র হলেও তাঁদের মধ্যে অনেক মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষও আছেন৷ যাঁরা হরিচাঁদ ঠাকুরের ভক্ত তাঁরাই মতুয়া৷ তাহলে প্রশ্ণ হল, নমশূদ্রদের তো কাস্ট সার্টিফিকেট দিয়ে প্রমাণ করা যাবে যে তাঁরা নমশূদ্র৷ কিন্তু উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দিতে অন্যান্য কাস্ট বা ধর্মাবলম্বী হরিচাঁদ ঠাকুরের ভক্ত মতুয়াদের কীভাবে চিহ্ণিত করা যাবে?
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ণটি হল, পিছিয়ে পড়া মানুষের কাছে উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দেওয়ার জন্য জাতি, উপজাতি, সম্প্রদায়ভিত্তিক অসংখ্য বোর্ড গঠনের দরকার ছিল কী? এই উন্নয়ন বোর্ডগুলি যে যে সুবিধাগুলি দেবে বলছে, সেগুলি ধর্ম–বর্ণ–সম্প্রদা নির্বিশেষে সামাজিক ও আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া সকল মানুষের জন্য করলেই তো হত তা কেন করা হচ্ছে না? সরকারি উন্নয়নের সুফল তাঁরা পাচ্ছেন না কেন? তা কি অপ্রতুল বরাদ্দের জন্য নয়?
পার্বত্য পরিষদ এলাকার ১৫টি উন্নয়ন বোর্ডের কাজকর্মের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে সমতলে যা ‘আমার বাড়ি’ প্রকল্প সেটাকেই লেপচা উন্নয়ন বোর্ডে ‘রংলি আবাস প্রকল্প’ তামাং উন্নয়ন বোর্ডে ‘হাঙ্গলা ধীম (আওয়ার হাউস)’, ভুটিয়া উন্নয়ন বোর্ডে ‘তাসিলিং হাউস স্কিম’ বলা হয়েছে৷ সমতলের কন্যাশ্রী, শিক্ষাশ্রী, সেল্ফ–হেল্প গ্রুপ, সবলা মেলা ইত্যাদি ওই বোর্ডগুলির অধীনেও আছে৷ বোর্ডগুলির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এই জনজাতি সম্প্রদায়গুলি সারা দার্জিলিং, কালিম্পং জেলা এবং তার বাইরেও ছড়িয়ে আছে৷ তাহলে ট্যুরিজম সেন্টার, কালচারাল সেন্টার, কমিউনিটি সেন্টারের সুযোগগুলি ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলি পাবে কী করে? তামাং বোর্ডের ড্রিংকিং ওয়াটার সাপ্লাই স্কিমের জল যে এলাকা দিয়ে যাবে সেই এলাকাগুলিতে কি অন্য কেউ তা পান করবে না? প্রায় একই ধরনের কাজ শেখার জন্য এই সব বোর্ডগুলি আলাদা আলাদা সম্প্রদায়ের জন্য স্কিল ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিং সেন্টার খুলেছে৷ আরও লক্ষণীয় হল, এই বোর্ডগুলির জন্য অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ অতি অল্প, অথচ বোর্ড মেম্বার করা হয়েছে বিপুল সংখ্যক মানুষকে নিয়ে৷ ভুজেল জনজাতির জনসংখ্যা যেখানে মাত্র ৫০ হাজার, সেখানে ভুজেল উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য সংখ্যা হল ৩১ জন৷ ৩১ জন করে সদস্য রয়েছে শেরপা, ভুটিয়া সহ আরও কয়েকটি উন্নয়ন বোর্ডে, লেপচা উন্নয়ন বোর্ডে সদস্য সংখ্যা ২৮৷ সব বোর্ডের সদস্য সংখ্যা যোগ করলে দেখা যাবে সংখ্যাটা ৩৫০ ছাড়িয়ে গিয়েছে এবং এরা সকলেই সরকার দ্বারা মনোনীত৷ সদস্য নির্বাচনে গণতান্ত্রিক কোনও রীতিনীতিই এখানে কাজ করে না৷ এইভাবে বিভিন্ন এলাকার এক–একটি জনজাতির প্রভাবশালী লোককে বোর্ডের সদস্য করে তৃণমূল কংগ্রেস তার রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে৷ ৭ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে ‘দার্জিলিং ক্রনিক্যাল’–এ প্রকাশিত হয়েছে, তামাং, শেরপা, ভুটিয়া, মানজার, লিমবু ও রাই – এই ছয়টি উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানরা এক বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থন করবেন৷ তামাং বোর্ডের চেয়ারম্যান সঞ্জয় মোক্তান বলেছেন, ‘‘সরকার আমাদের উন্নয়নে সাহায্য করায় আমরা তৃণমূল কংগ্রেসকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি’’৷ ফলে নমশূদ্র ও মতুয়া উন্নয়ন বোর্ডেও যে শুধুমাত্র তৃণমূল কংগ্রেসের আরও কিছু লোক মনোনীত হয়ে ‘করে খাওয়া’র জায়গা পাবে বা খবরদারি করতে সুযোগ পাবে সে কথা বলাই বাহুল্য৷
নমশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যাটা বলা হচ্ছে প্রায় পৌনে তিন কোটি৷ তাঁরা তফসিলি জাতিভুক্ত৷ দেখা যাবে যে সব সুযোগ সুবিধা বা প্রকল্প তফসিলিভুক্ত হওয়ার ফলে তাঁদের জন্য আছে, সেগুলিকেই নমশূদ্র উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে নিয়ে এসে বাস্তবে তাঁদের বাড়তি কোনও সুযোগের সংস্থান না করে এই বিরাট সংখ্যক মানুষের সামনে আলাদা উন্নয়নের বোর্ড ঝুলিয়ে প্রতারিত করা হবে৷ এর দ্বারা নমশূদ্র বা মতুয়া সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য পরিষেবা বা শিক্ষার ক্ষেত্রে বাড়তি কোনও উন্নয়ন না হলেও তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক ফায়দা তোলার পথটি সুগম হবে৷ অন্যান্য উন্নয়ন বোর্ড গঠনের পরিণতি অন্তত সে কথাই বলছে৷
(৭১ বর্ষ ১৪ সংখ্যা ১৬ – ২২ নভেম্বর, ২০১৮)