মণিপুরের যে নারীরা বিবস্ত্র অবস্থায় রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য হয়েছেন, যাঁরা গণধর্ষণের শিকার, যাঁরা দেখেছেন বাবা-মা-ভাইবোন-প্রতিবেশীদের নৃশংস হত্যা– প্রধানমন্ত্রী কথিত অমৃতকালে তাঁদের কি আদৌ কোনও ভাগ আছে? যদি থাকত, তাহলে তিন নারীর ওপর নারকীয় নির্যাতনের ভিডিও প্রকাশ্যে আসার আগে পর্যন্ত ৭৮ দিন ধরে প্রধানমন্ত্রী কি পারতেন এর একটা নিন্দা, নির্যাতিতের প্রতি একটা সহানুভূতির কথাও উচ্চারণ না করতে? ৭৯তম দিনেও মাত্র একবার বিষয়টার উল্লেখ করেই তিনি অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন! ঘটনাটা কি এতই তুচ্ছ? প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেই তাঁর দোসর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফাটা রেকর্ডের মতো আউড়ে চলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী প্রতিদিন মণিপুরের খোঁজ নেন, তিনি সব খোঁজ রাখেন’। তাহলে, ৪ মে মহিলাদের ওপর নারকীয় নির্যাতনের খবরটাও নিশ্চয়ই তিনি আগেই জানতেন! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেও অনেক টালবাহানার পর তিনদিনের মণিপুর ভ্রমণ সেরে সব ‘খোঁজখবর’ নিয়ে এসেছেন বলে জানিয়েছিলেন। তাঁরও তো বিষয়টা না জানার কথা নয়! আর যদি তর্কের খাতিরেও ধরে নেওয়া যায়, কেউ তাঁদের মণিপুরের এইসব ভয়াবহ ঘটনা জানায়নি, তাহলে ভাবতে হবে– কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে এমন মন্ত্রী পুষে দেশের মানুষের কী লাভ? এখন জানা যাচ্ছে রাজ্যের পুলিশ কর্তা, কেন্দ্রের নিযুক্ত নিরাপত্তা উপদেষ্টা থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত সকলেই বিষয়টা জানতেন। অথচ ভিডিওটি সামনে আসার আগে তাঁরা কেউ দুষ্কৃতীদের গ্রেপ্তারের কথা ভেবেই উঠতে পারেননি কেন?
বিজেপি পরিচালিত ‘ডবল ইঞ্জিন’ রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রী আরও সাংঘাতিক কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, এমন শত শত ঘটনা আছে, পুলিশ কতজনকে গ্রেপ্তার করবে? সব দেখেও চোখ বুজে থাকার জন্যই কি তিনি মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার আঁকড়ে আছেন? গত তিন মাস ধরে মণিপুরের এইরকম বা এর থেকেও ভয়াবহ নানা ঘটনার ভিডিও সমাজমাধ্যমে দেখা গেছে। যা দেখে শিউরে না উঠে কোনও মানুষই পারে না। অথচ মণিপুরের ঘটনাকে লঘু করে দেখাতে দেশের অন্যান্য জায়গায় যত নারী নির্যাতনের ঘটনা হচ্ছে বিজেপি নেতারা এখন সেগুলিকেই বেশি করে তুলে ধরছেন। কোথাওই নারী নির্যাতনের একটি ঘটনাও ঘটা উচিত নয়, সবগুলিই চরম নিন্দনীয়। কিন্তু এর দ্বারা কি মণিপুরের সামগ্রিক পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে চাপা দেওয়া যায়? মণিপুরের সমস্যা কি নিছক একটি আইনশৃঙ্খলার, বা শুধুই নারী নির্যাতনের সমস্যা? সেখানে একটা জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য আক্রমণের অভিযোগ উঠছে। একই রাজ্যে পাশাপাশি বাস করা দুটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিশ্বাসের বাতাবরণ পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে, কুকিরা মেইতেই এলাকা থেকে পালাচ্ছেন, মেইতেইরা কুকি এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। পুলিশকর্তা, সরকারি অফিসাররা পর্যন্ত নিজ নিজ জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকার নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে ব্যগ্র। এই পরিস্থিতিকে যে সরকার এবং তার প্রধানমন্ত্রী লঘু করে দেখাতে চায়, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে তো প্রশ্ন উঠবেই।
সরকার নাকি অনেক ভেবেও দাঙ্গা থামানোর কোনও পথ পাচ্ছে না! পথ তাঁরা পেতে পারতেন, যদি জনমুখী দৃষ্টিভঙ্গি থাকত। রক্তপাত থামাতে এখনই সরকারের পক্ষ থেকে কতগুলি সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি ও পদক্ষেপ নিয়ে বলা দরকার ছিল কুকি, নাগা, মেইতেই সহ কোনও ভারতীয় নাগরিককে যাতে জমি বা বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ না করা হয় তা সরকার দেখবে। দ্বিতীয়ত, জমি, বনাঞ্চল, জলাভূমি ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারের অধিকার থেকে কোনও জনজাতির মানুষ যাতে বঞ্চিত না হন, তা সরকার নিশ্চিত করবে। তৃতীয়ত, ভাষা, সম্প্রদায়, জাতি পরিচয় নির্বিশেষে সব মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষায় সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। চতুর্থত, মন্ত্রী, আমলা, সরকারি কর্মচারী, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে কোনওরকম জাতিগত পক্ষপাতিত্ব যাতে না থাকে তা সরকার নিশ্চিত করবে। এর কোনওটি করতে চান না বলেই কি প্রধানমন্ত্রী সংসদেও আলোচনা এড়িয়ে যাচ্ছেন? এ থেকে একটা সিদ্ধান্তেই আসতে হয়– মণিপুরের দাঙ্গা বন্ধ করতে ইচ্ছুক নয় বিজেপি সরকার। আরও বুঝে নিতে হয়, মানুষে মানুষে এই হানাহানি থেকে তারা কোনও বিশেষ ফয়দা তুলতে চায়!
বাস্তব হল, বিজেপির সংকীর্ণ ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি এবং একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের স্বার্থ রক্ষায় তাদের উদ্যোগ মেইতেই ও কুকিদের মধ্যে দাঙ্গা লাগতে সাহায্য করেছে। এর আগেও গণদাবীর পাতায় আমরা দেখিয়েছি– বিজেপি সরকার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই মণিপুরের পাহাড়ে বসবাসকারী আদিবাসীদের জমি কেড়ে নেওয়ার রাস্তা খুঁজতে শুরু করেছে। এই জন্য তারা মণিপুরের সাধারণ মানুষের মধ্যে বৈরিতার বাতাবরণ চায়। ভারতের সর্বত্রই বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মানুষের মধ্যে একটা নিরাপত্তার অভাববোধ তৈরি করে। সংখ্যাগরিষ্ঠের শত্রু হিসাবে সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মানুষকে দেখায়। বোঝায়, ওদের জন্যই তোমাদের কোনও উন্নতি হতে পারছে না। মণিপুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে তারা ঠিক একই খেলা খেলেছে। তারা মেইতেইদের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট, বেকারত্ব, চাষের দুর্দশা সব কিছুর জন্য কুকি, নাগাদের দায়ী করে প্রচার চালিয়েছে। এমনিতেই মণিপুরের বেশিরভাগ মানুষ খুবই দরিদ্র। মেইতেই থেকে শুরু করে আদিবাসী সকলেই দারিদ্রে জর্জরিত। যে এসটি সংরক্ষণের সুযোগের কথা বলে বিজেপি মেইতেইদের আদিবাসীদের বিরুদ্ধে ক্ষেপাচ্ছে, তা পেলেও কতজনের জীবনের সুরাহা হবে? তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, কোনও গোষ্ঠী এসটি তালিকায় থাকলেও তার থেকে বেশি সুযোগ কারা পায়? যারা তাদের মধ্যে কিছুটা অর্থবান এবং ক্ষমতাশালী তারাই তো! মেইতেইরা এসটি তালিকায় গেলেও কি অলাদা কিছু ঘটবে? সকলের জন্য চাকরি, জীবিকা, শিক্ষার দাবি এইভাবে নানা ডামাডোলে চাপা দেওয়া হচ্ছে।
কুকি এবং আদিবাসীরা পাহাড়ে জমি, জঙ্গলের ওপর অধিকার আদায় করেছিলেন ১৯১৭ থেকে ‘১৯ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়ে বহু রক্ত দিয়ে। আবার স্বাধীনতার আগে থেকেই মেইতেই জনগোষ্ঠীর বহু গণতান্ত্রিক বোধসম্পন্ন মানুষ ও ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামীরা অনেকেই পাহাড় এবং উপত্যকার উভয় জনগোষ্ঠীর মানুষের স্বার্থ এক বলে তুলে ধরেছেন। সকলের জন্য সমান ভোটাধিকারের দাবি তুলে মেইতেই রাজশক্তি এবং ব্রিটিশ শাসক উভয়ের হাতেই এই স্বাধীনতা সংগ্রামীরা নির্যাতিত, নির্বাসিত হয়েছেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্রের আইএনএ বাহিনীর পাশেও কুকি এবং মেইতেই উভয় গোষ্ঠীর মানুষই ছিলেন। যদিও স্বাধীনতার পর মণিপুরের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি যখন সমাজের গণতন্ত্রীকরণের কথা ভাবতে শুরু করেছেন, সেই সময় তাঁদের শক্তিবৃদ্ধিতে সাহায্য করা ও ঐক্যমতের ভিত্তিতে ভারতভুক্তির পথে না হেঁটে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার গাজোয়ারির মনোভাব নেয়। ফলে মণিপুরের মানুষের প্রাদেশিক আবেগ ঘা খায়। স্বাধীনতার পর থেকে মণিপুর বারবার প্রাদেশিকতাবাদী, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে রক্তাক্ত হয়েছে। এই রকম একটা রাজ্যে আদিবাসী এবং অন্য জনগোষ্ঠীর মধ্যেকার সম্পর্ক যে কতটা স্পর্শকাতর হতে পারে, তা না বোঝার মতো বোকা কেন্দ্রীয় বা রাজ্যের শাসকরা নন। তাঁরা অশান্তি উস্কে দিতে না চাইলে হাইকোর্টে মেইতেইদের এসটি তালিকাভুক্তির প্রশ্নে নিরপেক্ষ এবং সঠিক অবস্থান নিতেন। তা না করে বিজেপি দল এবং সরকারি কর্তারাও সমগ্র কুকি জনগোষ্ঠীকেই মায়ানমার থেকে আসা অনুপ্রবেশকারী, বেআইনি পোস্ত চাষি, ড্রাগ কারবারি হিসাবে দাগিয়ে দিয়েছে। ঐতিহাসিক কারণেই দীর্ঘকাল ধরে সমতলবাসী শাসকদের সাথে পাহাড়ি জনজাতিদের এক ধরনের দূরত্ব থেকে গেছে। বিজেপি সেই ফাঁকটাকে আরও একটু বিস্তৃত করে মেইতেইদের কুকিদের হাত থেকে বাঁচানোর অবতার সাজতে চেয়েছে। এর জন্য তারা সুপরিকল্পিতভাবে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংকে মেইতেইদের ত্রাতা হিসাবে তুলে ধরে প্রচার চালিয়েছে। তাঁর একপেশে ভূমিকা সরকারের ওপর কুকিদের বিশ্বাস পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছে।
সারা দেশেই জমি, জলাভূমি, জঙ্গল থেকে জনজাতিদের উচ্ছেদ করার পিছনে এ দেশের একচেটিয়া মালিকদের বড় স্বার্থ আছে। মণিপুরেও তাই। পাহাড়ের মালিকানায় জমি দখল না করলে তারা মণিপুরের সাথে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার লাভজনক ব্যবসার রাস্তাকে নিরঙ্কুশ করতে পারছে না। ওই পাহাড়ের খনিজ এবং বনজ সম্পদের দখলও পাচ্ছে না। একসময় কংগ্রেস সরকার এই কাজটি করার চেষ্টা করেছিল। এখন বিজেপি অতি তীব্র গতিতে এই কাজে নেমেছে। বিজেপি রব তুলেছে, মণিপুরের পাহাড় অনুপ্রবেশকারীতে ছেয়ে গেছে। অথচ সম্প্রতি মেইতেইদের স্বার্থ রক্ষাকারী সংগঠন ‘কোকোমি’র মুখপাত্র ফ্রন্টলাইন পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কোনও নথি পরীক্ষা ছাড়াই কেবলমাত্র মৌখিক জিজ্ঞাসার ভিত্তিতে ২১০৭ জনকে অনুপ্রবেশকারী হিসাবে সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে। কেবলমাত্র মৌখিক জিজ্ঞাসা কী করে একজনের নাগরিকত্ব প্রমাণের ভিত্তি হয়, সে প্রশ্ন সরিয়ে রাখলেও দেখা যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ নয়, সরকারের উদ্যোগে মাত্র ২ হাজার লোককে বহিরাগত বলে চিহ্নিত করা গেছে। অনুপ্রবেশ রোখা, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে নিরস্ত্র করা, ড্রাগ চোরাচালান রোখা এইগুলো কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারেরই দায়িত্ব। অথচ এইগুলির জন্য স্থানীয় কুকি-জো জনগোষ্ঠীকে সামগ্রিকভাবে দায়ী করে চলেছে বিজেপি সরকার। ভারতীয় নাগরিক কিংবা নাগরিক নয় এই বিচারের বদলে এখন অদ্ভূত একটা শব্দ আমদানি করা হয়েছে– ‘ওল্ড কুকি’ এবং ‘নিউ কুকি’। বলা হচ্ছে যারা ব্রিটিশদের এবং মেইতেই রাজাদের অনুমতিতে মণিপুরে এসেছিল, তারা ‘ওল্ড কুকি’। আর ১৯৬১-র পরে আসা ‘নিউ কুকি’দের মণিপুর ছাড়তে হবে। তার ভিত্তি কী, কেন ১৯৬১-ই ভিত্তিবর্ষ? এর কোনও সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই। এই কাজ করতে গিয়ে বিজেপি এবং তার সহযোগীরা উপত্যকাবাসী মেইতেইদের মধ্যে যে তীব্র ঘৃণা এবং সশস্ত্র আক্রমণের মনোভাব তৈরি করেছে তার বিষময় ফল সবচেয়ে বেশি ভোগ করছেন সাধারণ ঘরের মেইতেই যুবকরা। নানা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী মেইতেই এবং কুকি উভয় পক্ষকেই বিপুল অস্ত্র সরবরাহ করে চলেছে। তাতে মণিপুরের সাধারণ মানুষের মধ্যে ঐক্য পুরোপুরি বিনষ্ট হতে বসেছে। এই উস্কানির রাজনীতি যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে তা ক্রমাগত হাতের বাইরে যাচ্ছে। দাঙ্গার শুরু থেকে কোনও পদক্ষেপ না করে সরকার পরিস্থিতিকে জটিল থেকে জটিলতর হতে দিয়েছে।
মণিপুরের বর্তমান জটিল সমস্যা সমাধানে কুকি কিংবা মেইতেই সহ সমস্ত খেটেখাওয়া মানুষকে বুঝতে হবে, একদল খেটেখাওয়া মানুষের শত্রু অপর অংশের খেটেখাওয়া মানুষ হতে পারে না। মেইতেই এবং কুকি সহ সমস্ত মেহনতি মানুষের জীবন-জীবিকার সমস্যা কার্যত এক। এই সমস্ত সমস্যা নিয়ে একযোগে শাসক শ্রেণির শোষণ-বঞ্চনার রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়তে পারলেই একমাত্র সকলের সমস্যার সমাধানের রাস্তা মিলতে পারে। না হলে বৃথা রক্তপাত আর স্বজন হারানোই ভবিতব্য। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা এই সত্যটা জানেন বলেই চুপ করে থেকে মানুষকে লড়তে দিচ্ছেন পরস্পরের বিরুদ্ধে। এতে শাসক বুর্জোয়া শ্রেণির লাভ, সাধারণ মানুষের সর্বনাশ।