মজফফরপুর যেন মৃত্যু উপত্যকা, হেলদোল নেই সরকারের
আবারও সন্তানহারা মায়ের বুক ভাঙা কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে বিহারের মজফফরপুরের আকাশ–বাতাস৷ অ্যাকিউট এনসেফেলাইটিস সিনড্রোম রোগে আক্রান্ত হয়ে সে রাজ্যে ২০ জুন পর্যন্ত ১৫৬টি শিশুর অকালমৃত্যু ঘটেছে৷ এর মধ্যে শুধু মজফফরপুর জেলাতেই মারা গেছে ১২২ জন৷ যদিও বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন এত শিশুর মৃত্যুর প্রধান কারণ সীমাহীন দারিদ্র এবং তার ফলে অপুষ্টি, রোগ নয়৷ প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যু সংখ্যা৷ মানুষ আতঙ্কিত, কোথায় গিয়ে থামবে এই মৃত্যু মিছিল ইতিমধ্যে রাজ্যের ১৬টি জেলা এই রোগে আক্রান্ত৷ দেড় শতাধিক শিশুর মৃত্যুতেও রাজ্যে ক্ষমতাসীন জেডিইউ–বিজেপি জোট সরকারের বিশেষ হেলদোল আছে বলে বোঝা যাচ্ছে না৷ বস্তুত দেখে মনে হয়, সরকারই যেন রোগাক্রান্ত হয়ে পঙ্গু, অথর্ব হয়ে পড়েছে!
এনসেফেলাইটিসের আক্রমণ বিহারে নতুন নয়৷ গত কয়েক বছর ধরে এই রোগের জেরে বিহারে শিশুমৃত্যু লেগেই রয়েছে৷ এই রোগ প্রতিরোধে সরকার কী ভূমিকা নিয়েছে? ১৫৬টি শিশু প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করল সরকার কিছুই করেনি৷ মজফফরপুরে ১০৩টি হেলথ সেন্টারের ৯৮টিতেই কোনও ডাক্তার নেই, অনেকগুলিতে নার্সও নেই৷ একটি মাত্র কমিউনিটি হেলথ সেন্টার, সেখানেও ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী হাতে গোনা৷ জেলা হাসপাতালে আইসিসিইউ নামে যে ওয়ার্ডটি আছে সেখানে আদৌ কোনও শিশু বিশেষজ্ঞ পর্যন্ত নেই, বেশিরভাগ সময় অক্সিজেনের সরবরাহটুকুও থাকে না৷ ৪৫ডিগ্রি গরমে ওয়ার্ডগুলিতে সামান্য একটা সিলিং ফ্যানেরও অভাব৷ রোগীর পরিজনদের ওষুধ থেকে শুরু করে অক্সিজেনের সিলিন্ডার সবই কিনে আনতে হচ্ছে৷ জলের অভাব ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছে৷ একে নরক ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় কি এর সাথে যুক্ত হয়েছে তোলাবাজি, মৃতদেহের ময়না তদন্তের পর ২৫০০ টাকা করে চাওয়া হচ্ছে৷
প্রশ্ন ওঠে, মজফফরপুর জেলাতেই মৃত্যুর সংখ্যা এত বেশি কেন? এর কারণ ভয়াবহ দারিদ্র৷ দু’বছর আগে উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুরে যত শিশু এনসেফেলাইটিসে মারা গিয়েছিল, সকলেই ছিল অতি দরিদ্র পরিবারের৷ মজফফরপুরেও তাই৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, পুষ্টির নিরিখে মজফফরপুরের অবস্থা আফ্রিকার বহু দেশের তুলনায় খারাপ৷ এই অঞ্চলে ৬ মাস থেকে ২ বছর বয়সী শিশুদের ৯২ শতাংশের পুষ্টি জোটে না৷ ৪০ শতাংশের বেশি শিশুর ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় কম৷ ৫৬ শতাংশ শিশু রক্তাল্পতার শিকার৷ মৃত শিশুদের বেশিরভাগই রাতে কিছু না খেয়েই শুতে গিয়েছিল৷ কারণ বাড়িতে এই দুধের শিশুগুলিকে দেওয়ার মতো একটা রুটির টুকরোও তাদের বাবা–মায়ের কাছে ছিল না৷ বিহার সরকারের সোস্যাল অডিটেই দেখা যাচ্ছে এই পরিবারগুলির বেশিরভাগের মাসিক আয় যৎসামান্য৷ কোনও কোনও পরিবারের আয় মাসে মাত্র ৮৫০ টাকা৷ আর অধিকাংশের পারিবারিক আয় মাসে ৪৫০০টাকার মধ্যে৷ ফলে এই দুর্মূল্যের বাজারে শিশুসন্তানকেও দুবেলা পেটপুরে খেতে দিতে অপারগ এইসব দরিদ্র পরিবার (টাইমস অফ ইন্ডিয়া ২৪ জুন, ২০১৯)৷ মজফফরপুরে বিপুল পরিমাণে লিচু চাষ হয়৷ দরিদ্র পরিবারের শিশুরা গাছ থেকে কখনও কাঁচা, কখনও আধপাকা লিচু খেয়ে দিন কাটায়৷ চিকিৎসকদের মতে, লিচুতে এমন একটি রাসায়নিক থাকে যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমিয়ে দেয়৷ অভুক্ত শিশুদের যকৃতে সঞ্চিত গ্লাইকোজেন প্রায় ছিলই না৷ ফলে লিচুর রাসায়নিকের প্রভাবে তাদের শরীরে এমন একটি বিষাক্ত ‘নিউরোটক্সিন’ তৈরি হয় যা মস্তিস্কের ক্ষতি করে৷ ফলে দৃশ্যত মৃত্যুর কারণ এনসেফেলাইটিস হলেও প্রকৃত কারণ অপুষ্টি, যার দায় সম্পূর্ণ রূপে বর্তায় স্বাধীনতার ৭৫ বছরের উৎসব করতে চলা তথাকথিত প্রজাতান্ত্রিক ভারত রাষ্ট্রের কর্ণধারদের উপরেই৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার শুনতে পাচ্ছেন কি?
কিন্তু এতদসত্ত্বেও এই মৃত্যু কি অনিবার্য ছিল? চিকিৎসকরা বলছেন, একেবারেই নয়৷ রোগের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত শরীরে গ্লুকোজের জোগান দিতে পারলেই বাঁচানো যেত শিশুদের অধিকাংশকে৷ কিন্তু স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে জেলা হাসপাতাল কোথাও গ্লুকোজ, ওআরএস, স্যালাইনের পর্যাপ্ত জোগান ছিল না৷ এ তথ্য আবার প্রমাণ করে সরকারি নেতা–মন্ত্রী আর আমলাদের অপরাধমূলক ঔদাসীন্যের বলি হয়েছে এতগুলি শিশু৷ এই সব অপরাধীদের শাস্তি হবে না কেন? শিশুহত্যাকারী এই অমানবিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন তাই দেশ জুড়ে ফেটে পড়া দরকার৷