বছরের পর বছর দেশের মধ্যে খরা কবলিত রাজ্য হিসাবে সর্বোচ্চ স্থান দখল করে রেখেছে কর্ণাটক৷ পরিস্থিতি এতটাই ভয়ঙ্কর যে, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনে সমস্ত প্রধান বুর্জোয়া দলগুলি তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে কৃষকদের এই সমস্যা সমাধান করার প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয়েছিল, যদিও তা ছিল নিছক নির্বাচনী স্বার্থে৷ ক্ষমতায় আসার পরে জেডি (এস)–কংগ্রেস জোট কৃষকদের বৃহৎ পরিমাণ ঋণ মকুব করার ঘোষণা করে৷ কিন্তু রাজ্যে বিপুল সংখ্যক কৃষক এবং তাদের চূড়ান্ত দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় ঋণ মকুব এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারেনি৷ আর এক হতাশাজনক ঘটনা হল, ঋণ মকুবের সুযোগও কৃষকের কাছে পৌঁছয়নি বহু ক্ষেত্রে৷ এই রকম একটা পরিস্থিতিতে সাম্প্রতিক খরা সংকটে জর্জরিত কৃষকদের সমস্যার আগল আরও খুলে গেল৷
কৃষকদের এই সমস্ত সমস্যার সমাধান করার পরিবর্তে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ‘অন্যেরা অবহেলা করছে’ বলে পরস্পর কাদা ছোড়াছুড়িতে নেমে পড়ল৷ রাজ্য সরকার যখন কেন্দ্রকে নিশানা করে কৃষক সমস্যার সমাধানে অবহেলার জন্য তাদের দোষারোপ করছে, সেই সময় বিজেপিও ‘কর্ণাটক সরকার কিছুই করেনি’ এই অভিযোগ আনার সুযোগ ছাড়েনি৷ অবশ্য এরও বাস্তবতা রয়েছে যে, বিজেপি শাসিত রাজ্য যেমন মহারাষ্ট্র, অ–বিজেপি শাসিত রাজ্য কর্ণাটকের প্রতি ক্ষমাহীন জঘন্য বৈষম্যমূলক রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে৷
রাজ্যের ৪৭টি শহর এবং ৬২৫টি গ্রামের বাসিন্দা কাবেরী নদীর উপর নির্ভরশীল তাদের নিত্যব্যবহার্য জলের জন্য৷ কারণ, রিজার্ভারে জলের মাত্রা প্রয়োজনের তুলনায় কম৷ কর্ণাটক স্টেট ন্যাচারাল ডিজাস্টার মনিটরিং সেন্টারের ডিরেক্টর সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘বাঁধগুলিতে প্রায় ৪১ টিএমসি (থাউস্যান্ড মিলিয়ন কিউবিক) জল রয়েছে, বর্তমানে পানের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণে জল রয়েছে৷ সরকার সমস্ত বাঁধ কর্তৃপক্ষকে পানীয় জল মজুত করার নির্দেশ দিয়েছে৷ এর পরেও বাড়তি জল থাকলে তবে তা সেচের জন্য খরচ করার কথা’৷ তিনি বলেন, ২০১৮ সালের সেপ্ঢেম্বর পর্যন্ত বৃষ্টি কম হওয়ার ফলে বেঙ্গালুরু, মহীশূর এবং অন্য ৪৭টি শহর ও ৬২৫টি গ্রামে রিজার্ভারে জল ছিল না৷ তারা কাবেরী নদীর উপর নির্ভরশীল ছিল৷ ২০১৭ সালে কর্ণাটকের ১২টি বাঁধের ৯টি বাঁধে ২০ শতাংশের কম জল থাকায় অনুরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল৷ উত্তর কর্ণাটকের অবস্থা আরও ভয়াবহ৷
গত দু’বছরে বর্ষার পরে ও আগে একই ঘটনা ঘটছে৷ কৃষকরা রাষ্ট্রায়ত্ত ও কো–পারেটিভ ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিতে বাধ্য হয়, যা পরে বিশাল ঋণে পর্যবসিত হয়৷ রাজ্য সরকার কম পরিমাণে ঋণ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকে, যা শুধুমাত্র কো–পারেটিভ ব্যাঙ্কেই পাওয়া যায়৷ সরকার প্রয়োজনীয় সংখ্যক গোশালা তৈরি এবং পশুখাদ্য ও জল দিতে ব্যর্থ৷ উপরন্তু, সরকার এমরেগা প্রকল্পে ১৮০ দিনের কাজ দিতে পারেনি শুধু তাই নয়, ২–৩ মাসের বকেয়া মাইনেও দেওয়া হয়নি প্রকল্পের কর্মীদের৷ পানীয় জলের চূড়ান্ত অভাবে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যায়৷ সে কারণে হাজার হাজার কৃষক আত্মীয়–পরিজন নিয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে পাগলের মতো কাজ খুঁজে বেড়াতে বাধ্য হন৷ ভারতীয় আবহবিদ্যা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে ১–১২ জুন মোট বৃষ্টিপাত কমেছে ২ শতাংশ৷ উপকূলবর্তী এলাকায় স্বাভাবিকের তুলনায় ৩ শতাংশ, দক্ষিণের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাভাবিকের তুলনায় ৭ শতাংশ, উত্তরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ২৬ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে৷
২০১৮–’১৯ এর খরিফ ও রবি শস্যের সময় কম বৃষ্টিপাতের কারণে মারাত্মক জলসংকট দেখা দেওয়ায় কৃষকদের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে ওঠে৷ ১৭৬টি তালুকের মধ্যে ১৫৬টিতে এই পরিস্থিতি হওয়ায় সরকার এগুলিতে ‘ভয়ঙ্কর ও বিধ্বংসী’ খরাপ্রবণ বলে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়৷ রাজ্য মন্ত্রীসভার ৯ সদস্যের এক টিম ১৪টি জেলা পরিদর্শন করে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি এবং অবিলম্বে কেন্দ্রের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফান্ড (এনডিআরএফ) থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের বিষয় নিয়ে রিভিউ মিটিং করে৷ খরিফ ও রবি শস্য চাষের সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন– বন্যা, ভূমিধস, খরায় প্রায় ৩২ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে৷ কিন্তু এখনও পর্যন্ত মাত্র ৯৪৯.৪৯ কোটি টাকা ধার্য হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই সামান্য৷ এমনকী এনডিআরএফের নিয়ম অনুযায়ীও ৪৪৬০ কোটি টাকা পাওয়ার কথা৷
কেন্দ্রীয় সরকার নিজেদের দায়িত্ব অস্বীকার করতে নতুন ও সন্দেহজনক পন্থা খুঁজে বের করে এবং কৃষকদের প্রতারিত করে৷ তারা খরা কবলিত এলাকাগুলির শ্রেণিবিন্যাস করতে নতুন নিয়ম তৈরি করে৷ কফিনে শেষ পেরেকটি পোঁতা হয় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে– যখন ইউনিয়ন মিনিস্ট্রি অফ এগ্রিকালচারাল এবং ফার্মারস ওয়েলফেয়ার নতুন মাপকাঠি ঠিক করে দেয়, যাতে অত্যন্ত খরাকবলিত এলাকাও কেন্দ্রীয় এই তালিকার অর্ন্তভুক্ত না হয়৷
এতে স্বাভাবিকভাবেই অল্প খরাপ্রবণ এলাকা কেন্দ্রের রিলিফ ফান্ডের জন্য যোগ্য বিবেচিত হবে না৷ স্পষ্টত, একমাত্র মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগে রাজ্য সরকার ‘ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফান্ড’–এর কাছে আর্থিক ক্ষতিপূরণের দাবি জানালে কিছু পাওয়া যেতে পারে৷ এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ এক দশক বা দু’দশকে একবারই ঘটে৷ অল্প খরাপ্রবণ হলে রাজ্যকে নিজস্ব ফান্ড থেকে খরচ করতে হবে৷
ভারতের ৬৮ শতাংশ এলাকা খরায় ক্ষতিগ্রস্ত৷ এর মধ্যে ৩৩ শতাংশে মোট বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৭৫০ মিলিমিটার কম হওয়ায় ‘দীর্ঘ খরা কবলিত’ বলে পরিচিত৷ এছাড়া ৩৫ শতাংশ এলাকায় গড় বৃষ্টিপাত ৭৫০–১,১২৫ মিলিমিটার হওয়ায় ‘খরা কবলিত’ হিসাবে চিহ্ণিত হয়৷ উপদ্বীপ অঞ্চলের এবং পশ্চিম ভারতের শুষ্ক, আধা–শুষ্ক এবং আধা–স্যাঁতসেঁতে এলাকাই প্রাথমিকভাবে খরাপ্রবণ৷ এই রাজ্যগুলির খরার প্রকোপ এবং খরাপ্রবণ হিসাবে চিহ্ণিতকরণের নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে৷ নতুন মাপকাঠি অনুযায়ী, রাজ্য সরকারের চারটির মধ্যে অন্তত তিনটি প্রমাণ নির্দয়ভাবে লঙঘনের ঘটনা ঘটলে তবেই ভয়ঙ্কর খরার জন্য কেন্দ্রীয় সাহায্য পাওয়ার যোগ্য হবে৷
এটা কোনও গোপন বিষয় নয় যে, প্রকৃতি ও আবহাওয়ার পরিবর্তন অনেকাংশে খরার প্রকোপ বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়৷ সরকারের থেকে কৃষক এবং কৃষি ক্ষেত্রে সহায়তার প্রয়োজন জরুরি৷ কেন্দ্র সরকার নির্লজ্জভাবে চালাকির সাথে নিজের দায়িত্ব রাজ্যগুলির ঘাড়ে চাপিয়ে কৃষকদের ভয়ঙ্কর দুর্দশার মুখে ঠেলে দিচ্ছে৷ রাজ্য সরকারের করুণার তোয়াক্কা না করে অবশেষে কৃষকরা বারেবারে ঘটে চলা খরার প্রতিকারে রাস্তায় নেমেছেন৷