করোনা অতিমারিতে যখন প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছেন, চিকিৎসা ও অক্সিজেনের অভাবে হাজার হাজার মানুষ তিল তিল করে এগিয়ে চলেছেন মৃত্যুর দিকে, তখন বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই পরিস্থিতি অনেকখানি সামাল দিতে পারত ভ্যাক্সিন। এই অবস্থায় যখন জরুরি প্রয়োজন ছিল সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং পূর্ণ দায়িত্বে রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন সংস্থা, এমনকি বেসরকারি নানা ফার্মা কোম্পানির সাথে চুক্তি করে তাদের অর্থসাহায্য দিয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় পরিমাণে ভ্যাক্সিন উৎপাদন করা, তখন তা না করে প্রধানত একটি বেসরকারি কোম্পানিকেই উৎপাদনের দায়িত্ব দিয়ে সরকার চুপচাপ বসে থাকল। প্রয়োজন ছিল ভ্যাক্সিন উৎপাদন প্রক্রিয়াকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখা, যাতে কালোবাজারি না হয়। সেগুলির কোনওটাই সরকার করল না। এমনকি দেশের মাত্র তিন শতাংশ মানুষ ভ্যাক্সিন পেলেও বাকিটা বিদেশে রপ্তানি করে দিতে দ্বিধা করল না কেন্দ্রের বিজেপি সরকার।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম নিয়ামক সংস্থা অনুমোদিত ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর)-এর ১৫৯টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে দেশে। রয়েছে ভ্যাক্সিন উৎপাদক সাতটি বড় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা— হিমাচল প্রদেশের দ্য সেন্ট্রাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, তামিলনাড়ুর বিসিজি ভ্যাক্সিন ল্যাবরেটরি, পাস্তুর ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া, আর এইচ এল এল বায়োটেক, উত্তরপ্রদেশের ভারত ইমিউনোলজিক্যাল অ্যান্ড বায়োলজিক্যাল কর্পোরেশন লিমিটেড, মহারাষ্ট্রের হ্যাফকিন বায়োফার্মাসিউটিকালস এবং তেলেঙ্গানার হিউম্যানস বায়োলজিক্যাল ইনস্টিটিউট। এগুলিকে গত কয়েক বছর ধরে নিক্রিয় করে রাখা হয়েছে। সদিচ্ছা থাকলে এই সংস্থাগুলিকে উজ্জীবিত করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভ্যাক্সিন সরকার উৎপাদন করতে পারত। ভারত বায়োটেকের মতো বহুদিনের বেসরকারি সংস্থা রয়েছে। আইসিএমআর-এর সাথে ভারত বায়োটেকের যৌথ উদ্যোগে কো-ভ্যাক্সিন উৎপন্ন হয়েছে, তার প্রয়োগও হয়েছে সফলতার সাথে। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সেই ভ্যাক্সিন উধাও। অতিমারিতে মানুষকে বিনামূল্যে ভ্যাক্সিন জোগাতে চাইলে সরকার এই সমস্ত সংস্থাকে দিয়ে ভ্যাক্সিন উৎপাদন করাতে পারত। তাদের আর্থিক সাহায্য করতে পারত। তা না করে বেসরকারি সংস্থা আদার পুনেওয়ালার সিরাম ইনস্টিটিউটকে ভ্যাক্সিন তৈরির একচ্ছত্র ক্ষমতা তুলে দিল সরকার। যার সুযোগ নিয়ে এই কোম্পানি ভ্যাক্সিন নিয়ে ব্যাপক মুনাফা শিকারে নেমে পড়েছে।
গত বছর করোনার প্রথম ঢেউয়ের পর হাতে বেশ কয়েক মাস সময় পেয়েও সরকার স্বাস্থ্য পরিষেবাকে ঢেলে সাজানোর কোনও ব্যবস্থাই করেনি। বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো, চিকিৎসা-স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ, উপযুক্ত পরিমাণে চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা, অক্সিজেনের উৎপাদন বাড়ানো, সকলের টিকাকরণের ব্যবস্থা করা, আন্তর্জাতিক টিকা উৎপাদনকারী সংস্থাগুলি থেকে টিকা কেনা ইত্যাদি কিছুই করেনি। এখন দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশ যখন টালমাটাল, তখন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে কার্যত পাশ কাটিয়ে বেসরকারি সংস্থার মালিক ধনকুবেরদের বিপুল মুনাফা করার সুযোগ করে দিল সরকার। ভ্যাক্সিনের অর্ডার দেওয়ার ক্ষেত্রেও সরকারের এই বৈষম্য নীতি বারে বারে সামনে এসেছে। ভারত বায়োটেক এবং আইসিএমআর যৌথভাবে দেশের মানুষকে চিকিৎসা সরঞ্জাম জোগানোর প্রাণপণ চেষ্টায় যখন বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির কাছে সাহায্য চাইতে বাধ্য হচ্ছে, তখন সরকার সাহায্য করা তো দূরের কথা, দুয়োরানির মতো মার্চ মাসে তাদের মাত্র ৪০ মিলিয়ন এবং পরে আর ৫০ মিলিয়ন ভ্যাক্সিনের অর্ডার দিয়েছে। কিন্তু সিরাম ইনস্টিটিউটকে ২৬০ মিলিয়ন ভ্যাক্সিন তৈরির বরাত দিয়েছে। শুধু তাই নয়, পুরো ভ্যাক্সিন উৎপাদনকে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রক্রিয়ায় ছেড়ে দিয়েছে। তার সুযোগ নিয়ে সিরাম ইনস্টিটিউট ৯০ শতাংশ ভ্যাক্সিন (কোভিশিল্ড) তৈরি করে বাজারে ফাটকা খেলতে নেমে পড়েছে। এর শিকার হচ্ছেন দেশের আপামর জনসাধারণ। যে জীবনদায়ী ভ্যাক্সিন বিনামূল্যে দেওয়ার কথা, তা সরকারের অপদার্থতায় বেসরকারি মালিকের মুনাফার পণ্যে পরিণত হয়েছে। এমনিতেই সিরাম ইনস্টিটিউট কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য ১৫০ টাকা, রাজ্য সরকারের জন্য ৩০০ টাকা এবং বেসরকারি হাসপাতালের জন্য ৬০০ টাকা দাম ধার্য করেছে। এখন উৎপাদনের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে রাজ্য সরকারগুলিকে প্রতি ডোজ ৬০০ টাকায় এবং বেসরকারি হাসপাতালকে ১২০০ টাকায় কিনতে বাধ্য করছে সিরাম ইনস্টিটিউট। ৪৫ বছরের বেশি বয়সীরা অনেকেই প্রথম ডোজ নেওয়ার পর চাতকের মতো দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষায় রয়েছে। ইতিমধ্যেই সরকার ঘোষণা করে দিয়েছে তিন থেকে চার মাসের আগে কোভিশিল্ডের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে না। ফলে তাদের ভ্যাক্সিন পেতে পেতে হয়ত বছর ঘুরে যাবে, যখন করোনার প্রকোপে সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করবে। | এ ছাড়া সরকার ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সীদের ভ্যাক্সিন দেওয়ার দায় থেকে পুরোপুরি হাত গুটিয়ে নেওয়ায় যুব প্রজন্মের কোনও সুরক্ষাই রইল না।
সরকার কি জানত না বেসরকারি মালিকরা, ধনকুবেররা ভ্যাক্সিন নিয়ে ব্যবসা করবে, মুনাফার পাহাড় বাড়াতে মানুষের জীবনকে পুঁজি করবে? তা সত্ত্বেও তাদের হাতে তুলে দিল কেন ১৩৮ কোটি মানুষের ভবিষ্যত? কেন বেসরকারি কোম্পানির দিকেই হা-পিত্যেশ করে তাকিয়ে | থাকতে হবে দেশবাসীকে? যেখানে প্রয়োজন ছিল সরকারি উদ্যোগে দ্রুত সব মানুষের কাছে ভ্যাক্সিন পৌছে দেওয়া সেখানে শুধুমাত্র একটি বেসরকারি সংস্থার উপর সবটা ছেড়ে দিয়ে আসলে প্রধানমন্ত্রী একটি কোম্পানিকেই বিপুল মুনাফা লোটার সুযোগ করে দিয়েছেন। যেভাবে নানা ক্ষেত্রে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের মদত দেওয়ার নীতি নিয়ে চলেছে, আম্বানি-আদানিদের মতো সিরামও তেমন একটি কোম্পানি। এইভাবেই একচেটিয়া পুঁজির পছন্দের নেতা, পছন্দের দল এবং পছন্দের সরকার হিসাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায় নরেন্দ্র মোদি এবং তার দল বিজেপি।
পুঁজিবাদী সভ্যতা কতটা নিচে নামতে পারলে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর সময়ও জীবনদায়ী ভ্যাক্সিন নিয়ে কালোবাজারি করতে পারে, তাকে মুনাফার পণ্যে পরিণত করতে পারে বর্তমান করোনা মহামারি তা দেখিয়ে দিল। কিন্তু জনসাধারণ কি নীরব দর্শক হয়ে লাশের সংখ্যা গুনবে, আর হা-হুতাশ করবে? নাকি এই নিঃসীম অন্ধকারের মধ্যে আলোর ভোরের সন্ধান করবে? বিনামূল্যে সকলের জন্য অক্সিজেন, টিকা ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের দাবিকে জোরদার করাই আশু কর্তব্য। প্রতিটি মানুষের দাবি তুলতে হবে দেশের সমস্ত মানুষের বেঁচে থাকার দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই। মানুষের মৃত্যু রুখতে মানুষের পাশে দাঁড়াতে মানুষের মতো আচরণ করতে হবে।