গত লোকসভা নির্বাচনের আগে দেশের মানুষ জানতেন না ‘গুজরাট মডেল’টা ঠিক কী জিনিস৷ অতএব রামমন্দির, হিন্দুত্ব ইত্যাদি পুরনো ইস্যুগুলি থাকলেও নরেন্দ্র মোদির সেই অচেনা–জানা গুজরাট মডেলটিই রেকর্ড–ভাঙা প্রাবল্যে ফেরি করা হয়েছিল দেশ জুড়ে৷ অনেকেই ভেবেছিলেন, সংবাদমাধ্যম যখন এত ভাল বলছে, তখন হয়ত বা তা ভাল হবে বিপুল টাকা, বিপুল প্রচার আর প্রশাসনের বিপুল সাহায্যে জিতেছিলেন নরেন্দ্র মোদি৷ কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই জানা গেল গুজরাট মডেল অর্থনীতির একটি ‘রিকেটগ্রস্ত’ চেহারা৷
২০১৯ সালের এপ্রিল–মে মাসে আবার লোকসভা ভোট আসন্ন৷ এবার সযত্নে সেই ‘গুজরাট মডেল’ কথাটি ভুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ কারণ ওই মডেলটি নরেন্দ্র মোদিকে বিড়ম্বনায় ফেলবে৷ গত পাঁচ বছরে দেশে বেকার সমস্যা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, ফসলের দাম না পেয়ে ঋণগ্রস্ত কৃষকরা হাজারে হাজারে আত্মহত্যা করছে, সরকারি ঔদাসীন্যে রাজ্যে রাজ্যে কৃষকরা ক্ষোভে ফুঁসছে৷ জিএসটির ধাক্কায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বিপর্যস্ত, নোট বাতিলের ফরমানের জেরে এখনও জনগণকে ভুগতে হচ্ছে৷ পেট্রল–ডিজেল রান্নার গ্যাসের দামবৃদ্ধি অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছে৷ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা৷ ব্যপম ও রাফালের মতো আর্থিক কেলেঙ্কারি, বৃহৎ ব্যবসায়ী পুঁজিপতিদের ব্যাঙ্কের টাকা লুট করার সুযোগ করে দিয়ে ব্যাঙ্কগুলিকে দেউলিয়া করে দেওয়া প্রভৃতি কাজ করে নরেন্দ্র মোদির সরকার আজ চরম ধিক্কৃত৷ বাকপটুতায় দক্ষ নরেন্দ্র মোদির ভাষণও আজ মানুষকে আর মোহগ্রস্ত তো করছেই না, বরং ব্যঙ্গের আকারে নরেন্দ্র মোদির দিকেই ফিরে যাচ্ছে৷ একচেটিয়া পুঁজিপতি গোষ্ঠীর পায়ে সমর্পিত নরেন্দ্র মোদি সরকারের চরিত্র আজ জনগণের কাছে উদঘাটিত৷ অতএব ক্ষমতায় ফেরার জন্য ‘দাও ফিরে সেই রামমন্দির ইস্যু’৷
সংঘ পরিবার ও বিজেপি নেতাদের রামমন্দির নির্মাণ নিয়ে আবার শোরগোল তোলা এবং সাধুসন্তদের নিয়ে ধর্ম–সংসদ বসানোর তৎপরতাও বুঝিয়ে দিচ্ছে আসন্ন লোকসভা ভোটে জনস্বার্থ তাদের কোনও ইস্যু নয়৷ ১৯৮৯ সাল থেকে দেশের মানুষ দেখেছেন, গত ৩০ বছর ধরে যখনই বিজেপি কোনও সংকটে পড়েছে তখনই বিজেপির রামভক্তি উথলে উঠছে৷ ১৯৮৯ সালে রামশিলা নামক ইট পুজো, ১৯৯০ সালে আদবানির রামরথ চালানো, ১৯৯২ সালে করসেবা ও বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা ইত্যাদিই ছিল বিজেপি–সংঘ পরিবারের কাজ৷ জনজীবনের সমস্যা সমাধানের জন্য কোনওরকম আন্দোলনের পরিবর্তে এই খেলাই সংঘ পরিবার খেলে চলেছে৷ এবার রামমন্দির–বাবরি মসজিদ জমি সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে সর্বোচ্চ আদালতে উত্তরপ্রদেশ সরকার সওয়াল করেছে এই মামলাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য৷ সংঘ পরিবার মনে করছে জনজীবন বিপর্যস্তকারী সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা করার চাইতে পূর্বতন বছরগুলির মতো রামমন্দিরের আবেগ এবং সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি তুলতে পারলে ভোটের বাক্সে ফায়দা তোলা অনেক বেশি সহজ হবে৷ সেই আশাতেই সংঘ পরিবার সাম্প্রদায়িকতার মিশেল দেওয়া রামমন্দিরের জিগির তোলার সেই সহজ পথটিই বেছে নিয়েছে৷ মানুষ না খেতে পেয়ে মরল কি না, বিনা চিকিৎসায় মানুষ ধুঁকছে কি না, বেকারির জ্বালায় যুবকরা ছটফট করছে কি না, নারীপাচার, নারীদেহ নিয়ে ব্যবসা, নারীসমাজের উপর অত্যাচার নিপীড়ন তাদের জীবনকে নিরাপত্তাহীন করে তুলছে কি না, এসব প্রশ্ন মানুষ তুলবে না যদি রামমন্দিরের আবেগ উস্কে দেওয়া যায় –এটাই হচ্ছে বিজেপি সংঘ পরিবারের পরিকল্পনা৷
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদ–রামমন্দির মামলাটি অগ্রাধিকারের তালিকায় না রেখে বলেছে আদালতের নিজস্ব অগ্রাধিকার আছে৷ কথাটা অবশ্যই শুনতে ভাল৷ কিন্তু এর আগে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তার রায়ে অযোধ্যার এই জমি তিনভাগ করে দুইভাগ হিন্দু শিবিরকে এবং একভাগ মুসলিমদের মধ্যে ভাগ করে দিতে বলেছিল৷ সেই রায় হিন্দুত্ববাদী শিবিরকে প্রবল উল্লসিত করে তুলেছিল এবং পুরো জমি পেতে তারা সর্বোচ্চ আদালতে আর্জি জানিয়েছিল৷ ফলে বিচারব্যবস্থাও এমনই রায় দিচ্ছে, যাতে হিন্দুত্ববাদী শিবির বা সংঘ পরিবার নতুন করে উগ্র হিন্দুত্বের অস্ত্রে শান দিতে পারে৷ আজ যখন সর্বোচ্চ আদালত মামলাটি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে শুনানি করতে নারাজ তখন সংঘ পরিবারের নেতারা একদিকে বিচার ব্যবস্থার প্রতি হুঙ্কার ছাড়ছে, অন্যদিকে তাদের পরিচালিত সরকারের কাছে অর্ডিন্যান্স জারি করে মন্দির করার দাবি জানাচ্ছে৷
কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হয়ত ভাবছেন এবং সংবাদমাধ্যমও এমন প্রচার করছে যে, সর্বোচ্চ আদালতের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এই মামলা না শোনার সিদ্ধান্তের ফলে বিজেপির বাড়া ভাতে বোধহয় ছাই পড়ল বা বিজেপির অসুবিধা হল৷ কিন্তু সাধুসন্ত জড়ো করে ধর্মসংসদ ডেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করার চেষ্টা এর আগেও যেমন দেখা গিয়েছে এবারও তারা সেই চেষ্টা করবে না তা বলা যায় না৷ তাই এবার যখন একদিকে সামনে পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোট এবং কয়েক মাস পর সারা দেশে লোকসভা ভোট, অন্যদিকে মোদির ভাবমূর্তি তলানিতে এবং ‘গুজরাট মডেল’–এর মতো কোনও টোপ বা খুড়োর কলও সামনে ঝোলানো যাচ্ছে না, তখন রামমন্দিরের উপর ভরসা করা ছাড়া বিজেপি আর কী–ই বা করতে পারে তাই যে সব সংগঠনগুলি ১৯৯২ সালে ঐতিহাসিক সৌধ বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে চরম অন্যায় করেছে, যাদের সেই অপরাধের জন্য শাস্তি হওয়ার কথা, যারা বিচারব্যবস্থাকে চরম উপেক্ষা করেই বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছে, সেই অভিযুক্ত সংগঠনগুলিই বিচারব্যবস্থার কাছে দাবি করছে – রামমন্দিরের জন্য সেই জমি তাদের দিতে হবে!
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যিনি নেতাজির কোনও নীতিই কোনও দিন মানেননি, তিনিই হঠাৎ প্রবল নেতাজিভক্ত সেজে বলেছেন, নেতাজির আদর্শ দেশবাসীর কাছে তাঁর সরকার তুলে ধরবে৷
নেতাজি বলেছিলেন – ‘‘… হিন্দুরা ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে ‘হিন্দুরাজের’ ধ্বনি শোনা যায় এগুলি সর্বৈব অলস চিন্তা৷ … শ্রমসিক্ত জনসাধারণ যে সব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন, সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি তার কোনওটির সমাধান করতে পারবে কি? কীভাবে বেকারত্ব, নিরক্ষরতা, দারিদ্র প্রভৃতি সমস্যার সমাধান হবে সে সম্বন্ধে তাহারা কোনও পথনির্দেশ করিয়াছে কি?’’ অথচ নরেন্দ্র মোদির বিজেপি ঠিক উল্টো কাজটিই করছে৷
মোদি সরকার আজ যখন আদানি–আম্বানিদের তল্পিবাহক ছাড়া আর কিছু নয়, তখন মানুষের মধ্যে বিভাজন আনতে তারা হিন্দু–মুসলিম দ্বন্দ্ব লাগানোর ইস্যুটিকেই যে কাজে লাগাবে তা আজ দেশের সমস্ত স্তরের মানুষকে উপলব্ধি করতে হবে এবং রামমন্দিরের নামে তাদের সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং তাকে ভিত্তি করে ভোটে ফায়দা তোলার পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করতে এগিয়ে আসতে হবে৷
(৭১ বর্ষ ১৩ সংখ্যা ৯ – ১৫ নভেম্বর, ২০১৮)