নির্বাচন কেন হয়? লোকসভা কিংবা বিধানসভা থেকে শুরু করে পঞ্চায়েত কিংবা পৌরসভা নির্বাচনে জনগণের কাজ ভোট দিয়ে শাসক বেছে নেওয়া। কিন্তু সেই শাসকরা জিতে কী করে? তাদের জেতা-হারার সাথে কি জনস্বার্থের আদৌ কোনও সম্পর্ক থাকে? যদি থাকে, তাহলে তথাকথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে অবতীর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রচারের সময় কী কী বিষয় তুলে ধরবে? জিতে তারা জনস্বার্থে কী কী করবে, কোন কোন নীতিতে তারা অন্যের থেকে আলাদা– এই কথাগুলি তাদের বলতে হবে তো! কিন্তু দেখা যায় দেশে বা রাজ্যে একটার পর একটা নির্বাচন পেরিয়ে যায়, তাতে যারা জেতে কিংবা যারা তাদের কাছাকাছি প্রতিদ্বন্দ্বী, তাদের প্রচারের মূল বিষয় এখন হয়ে দাঁড়াচ্ছে জাতপাত আর সাম্প্রদায়িক বিভেদমূলক প্রচার। কখনও তা উগ্র, কখনও তা একটু নরম, পার্থক্য এইটুকুই। সারা দেশে মানুষের সমস্যা যখন মূল্যবৃদ্ধি, সমস্যা যখন বেকারত্ব, সমস্যা যখন ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন, সমস্যা যখন কৃষকের ফসলের উপযুক্ত দামের অভাব, সমস্ত সরকারি কাজে স্তরে স্তরে দুর্নীতি ইত্যাদি– তখন দেখা যাচ্ছে এক একটা নির্বাচনে এগুলি মুখ্য বিষয় হয়ে উঠছে না! উদাহরণ হিসেবে দেখা যাক একেবারে সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনের কালে মহারাষ্ট্রের ভোট প্রচারের মঞ্চকে।
মহারাষ্ট্র রাজ্যটি আর্থিক দিক থেকে উন্নত এবং সামাজিকভাবে অগ্রসর বলে ধরা হয়। সেই মহারাষ্ট্রে প্রধান দুটি জোট ভোট ময়দানের প্রতিদ্বন্দ্বী। একটি হল এনডিএ-র মহায্যুতি জোট যার শরিক বিজেপি, শিবসেনা (শিন্ডে) এবং এনসিপি (অজিত পাওয়ার)। অপরটি মহাবিকাশ আগাড়ি বা এমভিএ, যার শরিক হল– এনসিপি (শরদ পাওয়ার), কংগ্রেস এবং শিবসেনা (উদ্ধব বাল ঠাকরে)। সেই ‘অগ্রসর’ রাজ্যে ভোটের আগে দেখা গেল এক বিজেপি নেতা প্রকাশ্য সভায় কংগ্রেসের এক নেতার কন্যার উদ্দেশে নোংরা মন্তব্য করছেন। শ্রোতারাও তা উপভোগ করে প্রবল হাততালি দিচ্ছেন। যথারীতি কংগ্রেস নেতারা এর বিরুদ্ধে সোস্যাল মিডিয়াতে সরব হলেন এবং বিজেপি নেতা ও সমর্থকরা খুঁজতে থাকলেন এর আগে কবে কংগ্রেসের কোন কোন নেতা বিজেপির কোন কোন মহিলা সমর্থকের উদ্দেশে কী কী খারাপ কথা বলেছেন। অবশ্যই তাঁদের বেশি খুঁজতে হয়নি, একই ধরনের বেশ কিছু উদাহরণ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিজেপি নেতারা জোগাড় করে ফেলেছেন। ভুলে গেলে চলবে না, মহারাষ্ট্রে মহিলাদের শ্লীলতাহানী, ধর্ষণের মতো মামলা পুলিশে জমা পড়ে প্রতিদিন গড়ে ১২১টি। আর শিশুদের ওপর এই ধরনের ঘটনার অভিযোগ নথিভুক্ত হয় প্রতিদিন গড়ে ৫৫টি। নথিভুক্ত হয় না এমন ঘটনার সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই আরও বেশি। সম্প্রতি সে রাজ্যের বদলাপুরে স্কুলে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগ চাপা দিতে পুলিশের জঘন্য ভূমিকা নিয়ে সোচ্চার হতে হয়েছে বোম্বে হাইকোর্টকে। এই রাজ্যে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী জোটের নারীদের মর্যাদা নিয়ে এই যখন মনোভাব, তারা কি কেউই নারী নির্যাতন বন্ধ করতে পারবে? মহারাষ্ট্রের বিজেপি জোট সরকারের বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ আছে। এদিকে কংগ্রেস এনসিপি-র বিরুদ্ধেও তা কম নেই। কংগ্রেস-এনসিপি-র একাধিক নেতা দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হয়েই বিজেপিতে নাম লিখিয়ে সাংসদ পদ থেকে মন্ত্রিত্ব পেয়ে গেছেন। ফলে দু-জনের কারও পক্ষেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনও কথা বলা অসম্ভব।
অবশ্য এ নিয়ে দুই জোটেরই মাথাব্যথা বিশেষ নেই। উভয়েরই এখন প্রধান ইস্যু হল জাতপাত এবং হিন্দুত্ব। সমস্ত কিছুকে পিছনে ঠেলে দিয়ে এখন ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিসরে জাত নিয়ে লড়াই মহারাষ্ট্রে যেন প্রধান হয়ে উঠছে। এই মহারাষ্টে্রর বুকে একদিন জ্যোতিবা ফুলে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন জাতপাতের বিভেদ দূর করার জন্য। আধুনিক মনন গড়ে তোলা, ধর্মীয় ও জাতভিত্তিক সংকীর্ণতা ভেঙে আধুনিক মনন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ছিল তাঁর লড়াই। সেই মহারাষ্ট্রে জাতপাত ভিত্তিক উগ্র আবেগ জনমানসে তীব্র করে তুলতে সচেষ্ট সমস্ত ভোটবাজ দলই। নিজ নিজ ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির স্বার্থে তারা যা করছে তাতে সাধারণ মানুষের মধ্যেকার স্বাভাবিক ঐক্য ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে। এবারের ভোটে নতুন করে মারাঠা পরিচিতির সাথে ওবিসি পরিচিতির দ্বন্দ্ব তীব্র এবং তিক্ত জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছে বিজেপি এবং কংগ্রেস উভয়েই। মারাঠা আত্মপরিচয় এবং উগ্র হিন্দুত্ববাদের জিগির তুলে মহারাষ্টে্র দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করেছে শিবসেনা। এতে মদত দিয়েছে বিজেপি এবং নানা সময়ে কংগ্রেস ও তার থেকে ভেঙে আসা এনসিপি। এখন গদির দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে শিবসেনা ভেঙে দুই ভাগ হয়েছে। এনসিপিও দুই টুকরো। তারা সকলে এমন জাতপাতের জটিল সমীকরণ তুলছে যে, এই দ্বন্দ্বের সুফল নিতে গিয়ে সব দলগুলোই বিপাকে পড়ছে। তারা এক এক সময় এক একটি গোষ্ঠীকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে তাদের কখনও এসসি কখনও এসটি তালিকায় জায়গা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এক একটি রাজনৈতিক দল এক একটি গোষ্ঠীর দাবিকে সমর্থন করে ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করতে চায়। ফলে এক গোষ্ঠীকে যখন কোনও দল সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে উস্কানি দেয়, আর এক দল ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্য গোষ্ঠীকে তার বিরোধিতায় নামাতে। যেমন এখন ধাঙড় বলে পরিচিত জনগোষ্ঠী আদিবাসী (এসটি) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে চাইলে তার বিরুদ্ধে অন্যান্য কিছু গোষ্ঠী জোর প্রতিবাদ জানিয়েছে। এতে বিপাকে পড়ে কংগ্রেস তুলছে ‘জাত গণনার’ দাবি, ওবিসি-এসসি-এসটি তালিকার পরিসর বাড়ানোর দাবি। আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সব কিছু ছেড়ে মহারাষ্টে্র গিয়ে এই ওবিসি তাস নিয়েই হামলে পড়ছেন। এই ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির জোরেই বিজেপি জোট সরকারের তত্ত্বাবধানে একের পর এক জাতভিত্তিক কর্পোরেশন গঠিত হয়েছে। এমনকি ব্রাহ্মণদের নামেও একটি এমন কর্পোরেশন হয়েছে। কিন্তু তাতে বিপদ বেড়েছে বই কমেনি, বিজেপি জোট সরকার কোনও গোষ্ঠীর জন্যই কর্মসংস্থান, বিশেষ সরকারি সুবিধা, উচ্চশিক্ষার সুযোগের অভাব, বাসস্থান, পানীয় জল ইত্যাদির সমস্যা মেটাতে পারেনি। হিন্দুত্ববাদের ছাতার তলায় এই সব গোষ্ঠীকে আনার কর্মসূচিতে নেতাদের হিমসিম খেতে হচ্ছে সকলকে খুশি রাখার চেষ্টায়। সে জন্যই মহারাষ্ট্রে ভোট প্রচারে গিয়ে নরেন্দ্র মোদিকে সে রাজ্যের সমস্যা শিকেয় তুলে রেখে বলতে হচ্ছে কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা নিয়ে। বলতে হচ্ছে কংগ্রেস ওবিসিদের ভাগ করতে চাইছে, আমরা তাদের এক করব। বিজেপি জোট সরকারের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিভেদ এবং জাতপাতের বিভেদ দুই পক্ষের কাছেই ভোটের হাতিয়ার। কিন্তু এ অনেকটা বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়ার মতো– উঠলে নামা মুশকিল, নামলেই সেই বাঘেই খাবে আরোহীকে।
কিন্তু পেট যে বড় বালাই– এ সত্য বড় নির্মম। তাই এখন সাধারণ মানুষকে কিছু সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে যেন নিলামের খেলায় নেমেছে দুই পক্ষ। মহাবিকাশ আগাড়ির বিরুদ্ধে মহায্যুতি জোটের অভিযোগ তারা ওদের কর্মসূচি চুরি করেছে! দুই পক্ষে লড়াই চলেছে ‘লড়কি বহিন যোজনা’ নিয়ে। মহায্যুতি জোট সরকার পশ্চিমবঙ্গের ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে’র মতো ‘লড়কি বহিন যোজনা’য় মাসে দেড় হাজার টাকা করে দেবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী তার পাল্টা বলে এসেছেন আমরা জিতলে মাসে তিন হাজার টাকা করে দেব।
মহায্যুতি জোট বলেছে শিবাজির মূর্তি গড়ব, পাল্টা মহাবিকাশ আগাড়ি বলেছে আমরা সব জেলায় শিবাজির মূর্তি ও মন্দির করে দেব। এরা যেন জানেই না, এই মহারাষ্টে্রই কৃষক আত্মহত্যা সারা ভারতে সর্বাধিক! মুম্বাইয়ের বস্তির মানুষের কষ্ট, বস্তিগুলোর জমি কর্পোরেট পুঁজির কবলে চলে যাওয়ার ফলে উচ্ছেদের সমস্যা, শহরে মাথা গোঁজার স্থান না পাওয়া মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তদের লোকাল ট্রেনের অসহনীয় ভিড়ের যাত্রা– এ সব কোনও কিছুই যেন ওরা কেউই জানে না! ওরা বোধহয় জানেই না, কী ভাবে খরায় ফুটিফাটা মাটির সামনে বসে মহারাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ অংশের কৃষকরা চোখের জল ফেলে প্রতি বছর। জানে না, মহারাষ্টে্রর বিস্তীর্ণ অংশে সামান্য পানীয় জলের অভাবে মহিলাদের জীবন কতটা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে! মানুষের জীবনের এমন সব জ্বলন্ত সমস্যাগুলোর কোনও অস্তিত্বই নেই এই সমস্ত দলগুলোর ভোট প্রচারে। এ লড়াই যতই জমজমাট হোক, সাধারণ মানুষের জন্য তা পুরো অর্থহীন। পুরোটাই পরিচালিত জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার লক্ষ্যে।