দেশজুড়ে ভোটের প্রচারে চলছে প্রতিশ্রুতির বন্যা৷ যে যেমন পারছে জনগণকে ঠকানোর কাজে নেমে পডছে৷ কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী ন্যূনতম আয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন৷ বলেছেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে দেশের পাঁচ কোটি পরিবারকে বছরে ৭২ হাজার টাকা দেবে৷ মনে করিয়ে দিল গত লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির প্রত্যেকটি ভারতবাসীর অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতির কথা৷
রাহুল গান্ধীর কণ্ঠে এই প্রতিশ্রুতি কি তাঁর নিজস্ব মস্তিষ্ক্প্রসূত, নাকি ভারতের পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতেই এটা তাঁর এক অনন্য দাওয়াই৷ আজ পর্যন্ত যত অর্থনৈতিক পলিসি ঘোষণা হয়েছে তা শুধুই শোষক শ্রেণির সুবিধার্থে৷ যদিও সবসময়ই তা জনগণের ভাল করবার মোড়কে পরিবেশন করা হয়৷ তা জিএসটি হোক, নোট বাতিল হোক, আর এফডিআই হোক, মূল কথা হল, কোনও রাজনৈতিক দল অর্থনৈতিক পলিসি ঠিক করে না, তা ঠিক করে বিগ বিজনেস হাউস এবং তাদের পক্ষের অর্থনীতিবিদরা৷ তাই যে জিএসটি বিল নিয়ে বিরোধী থাকাকালীন বিজেপির প্রবল আপত্তি ছিল সেই জিএসটি তাদের আমলে চালু হয়ে গেল৷
যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া হয়, রাহুলজির ঘোষণা অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে অর্থাৎ ভারতের কুড়ি শতাংশ মানুষ যাঁরা প্রান্তিক তাঁরা বছরে ৭২ হাজার টাকা অর্থাৎ মাসিক ৬ হাজার টাকা কোনও রকম পরিশ্রম না করেই পাবেন, তা হলেও এর মধ্যেও রয়েছে একটা অন্য বিশ্লেষণ৷ একটু খেয়াল করলেই স্মরণে আসবে, ১৯২৯ সালে বিশ্ব পুঁজিবাদী দুনিয়ায় যে চরম অর্থনৈতিক মন্দা দেখা গিয়েছিল এবং অত্যাচারিত শোষিত জনগণ এই শোষণ থেকে বাঁচতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছিল ঠিক সেই পরিস্থিতিতে এই পুঁজিবাদী শোষণমূলক ব্যবস্থা অটুট রাখার জন্য এবং মানুষের মধ্যে বিশ্বাস জোগানোর জন্য অর্থনীতিবিদ কেইন্স নিয়ে এলেন এক তত্ত্ব, যাতে তিনি বললেন, সরকার জনগণকে কিছু কিছু কাজ দিক যাতে তাদের হাতে কিছু পয়সা আসে, কিছু জিনিস কিনতে পারে, তাদের ক্ষোভ প্রশমিত হয়৷ এখন পুঁজিবাদের এই কঠিন সময়ে সারা বিশ্বজুডে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য জনগণকে নানা রকম উপঢৌকন দেওয়ার কাজ চলছে৷ এ রাজ্যে কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, সাইকেল দেওয়ার প্রকল্প প্রভৃতি এরই উদাহরণ৷ যাতে জনগণ এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ওপর আস্থা না হারায় এবং সর্বোপরি শোষণ মেনে নেয়৷ তাই এ রাজ্যের প্রকল্প সুইডেনে গিয়ে প্রাইজ নিয়ে আসছে৷ রাহুলজির প্রকল্পও জনগণের ক্ষোভকে সাময়িক স্তিমিত করারই একটি উপায় ছাড়া আর কিছু নয়৷
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য চাই কাজ আর কাজ দিতে পারে কারখানা৷ পুঁজিবাদী নীতিরই ফল হিসাবে বাজার সংকটের দরুন কারখানার উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাই পুঁজিপতিরা কারখানা তৈরি করতে রাজি নয়৷ তাদের জমে থাকা পুঁজি লাভজনক ক্ষেত্রগুলোতে বিনিয়োগ করার ব্যবস্থা আজ সরকারকেই করে দিতে হচ্ছে৷ জনগণের টাকায় সরকার তাদের পছন্দ মতো ক্রেতা হয়ে উঠছে৷ তাই যুদ্ধাস্ত্র, ঝাঁ চকচকে রাস্তা, ব্রিজ, বিল্ডিং তৈরি, সাইকেল বিলি সমস্ত কিছু আঞ্চলিক, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পুজির স্বার্থে নানা রকমের পদক্ষেপ এবং তাদের পুঁজি বিনিয়োগের ব্যবস্থা অর্থাৎ মুনাফা লোটার ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছুই নয়৷ আর আপনি আমি সকলেই তাদের এই মুনাফা সৃষ্টির যাঁতাকলে পিষে চলেছি এবং ঝাঁ চকচকে রাস্তা দেখে বাহবা দিয়ে বলছি, এর আগে তো কখনও দেখিনি৷ এই পরিস্থিতিতে দাঁডিয়ে রাহুলজির ঘোষণা মানুষের কী সুরাহা করবে জানি না তবে একটি কথা বলতেই হয় মাসিক ৬০০০ টাকা পেলেও তাদের জীবনযাত্রার কোনও পরিবর্তন ঘটবে না বরং আগের থেকেও আরও বেশি পরিশ্রম করতে হবে বর্তমান জীবনযাত্রা বজায় রাখবার জন্য৷ কারণ অর্থনীতিতে আর্থিক আয় বৃদ্ধি মানুষের ভাল থাকার কোনও নিদর্শন হতে পারে না, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অর্থাৎ তার প্রকৃত আয় বাড়ল কি না তার উপরই নির্ভর করে মানুষ কতটা ভাল আছে৷ মানুষের আর্থিক আয় বাড়লেও যদি জিনিসপত্রের দাম তার থেকেও বেশি হারে বাড়ে তা হলে তার জীবনযাত্রার মান আরও নামতে থাকে৷
একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে৷ ধরা যাক এক ব্যক্তির আয় মাসিক ১০০ টাকা এবং চালের বাজার মূল্য ১০ টাকা৷ তা হলে সেই ব্যক্তি বাজার থেকে ১০ কেজি চাল কিনতে সক্ষম অর্থাৎ তার প্রকৃত আয় ১০ কেজি চালের দামের সঙ্গে সমান৷ এবার যদি সেই ব্যক্তির আয় দ্বিগুণ হয় অর্থাৎ ২০০ টাকা হয় এবং বাজারে চালের বাজার মূল্য যদি ২৫ টাকা হয় তা হলে দেখা যাবে সেই ব্যক্তি মাত্র ৮ কেজি চাল কিনতে সক্ষম হল৷ তা হলে দেখা গেল আর্থিক আয় দ্বিগুণ হওয়া সত্ত্বেও সে আগের তুলনায় কম পরিমাণ জিনিস কিনতে সক্ষম হল অর্থাৎ তার প্রকৃত আয় কমে গেল৷ আমাদের দেশে উৎপাদনের সমস্ত উপাদান মজুদ রয়েছে, প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, মূলধনও প্রচুর, শ্রমের অভাব নেই তবুও কেন কারখানা গডে ওঠে না, মানুষ কাজ পায় না৷ কারণ এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তির মুনাফা অর্জনের যাঁতাকল থেকে উৎপাদনকে রক্ষা করতে হবে, না পারলে এ দেশে মানুষের উন্নয়ন সহায়ক উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয় এবং স্বল্পমূল্যে উৎপাদিত দ্রব্য মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়৷ অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি আটকানো সম্ভব নয়৷ এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল ভারতে তার জনগণকে এক অর্থে বঞ্চিত করেই প্রতি বছর প্রচুর খাদ্য সামগ্রী নষ্ট করে দেওয়া হয় এবং এই নষ্ট করবার জন্য রাজকোষ থেকে অর্থ ব্যয় করা হয়৷ শুনলে অবাক হবেন এই কাজে আমাদের দেশ পৃথিবীতে সপ্তম স্থানে রয়েছে৷ যতদিন এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা চলবে ততদিন ভোট আসবে মানুষ নতুন নতুন প্রতিশ্রুতি শুনবে এবং ঠকবে৷ জিতবে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যথার্থ ম্যানেজারের ভূমিকা পালনকারী এই সব রাজনৈতিক দলগুলি৷
গৌতম দাস, মালদা