মানুষের অবস্থানই তার চেতনা নির্ধারণ করে৷ ক্ষুধার্ত মানুষ খাদ্য চাইবে এটাই স্বাভাবিক৷ তেমনি বেকার চাইবে কাজ৷ এ বারের ভোটে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা কী? কী চাইছেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ? এ বিষয়ে দুটি সমীক্ষা হয়েছে৷ ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ইলেকশন ওয়াচ’ এবং ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রাইটস’ (এ ডি আর) রাজ্যের ৪২টি কেন্দ্রের ২১ হাজার মানুষের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে গ্রাম শহর নির্বিশেষে প্রধান চাহিদা কর্মসংস্থান৷ গ্রামের ক্ষেত্রে চাহিদা বেশি কৃষি ঋণ, কৃষিপণ্যের দাম, সেচের জল, সার–বীজে ভর্তুকি৷ শহরের মানুষের কাছে প্রাধান্য পেয়েছে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সু–পরিবহণ ব্যবস্থা এবং যানজট নিয়ন্ত্রণ৷ ইলেকশন ওয়াচ–এর সভাপতি বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, ভোটারদের প্রত্যাশা যে পুরণ হচ্ছে না, সেটাই দেখা যাচ্ছে সমীক্ষায়৷
সমীক্ষা দেখাচ্ছে, স্বাধীনতার পর ৭২ বছরে লোকসভা, বিধানসভা, পৌরসভা–গ্রামপঞ্চায়েত মিলিয়ে শতাধিক ভোট হয়ে গেলেও মানুষের অতি ন্যূনতম প্রত্যাশাও পূরণ হয়নি৷ কে ছিল না এই পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতায় কংগ্রেস ছিল প্রায় ৩০ বছর, সিপিএম ছিল ৩৪ বছর, তৃণমূল আছে ৮ বছর ধরে৷ কিন্তু জনসাধারণের ন্যূনতম চাহিদাগুলিও কেউ পূরণ করতে পারেনি৷ সুযোগ বুঝে ধূর্ত বিজেপি আওয়াজ তুলছে বরং ‘বিজেপি–লাও’৷ কিন্তু বিজেপি অন্যান্য রাজ্যে যা করেছে, তার সঙ্গে এ রাজ্যের কোনও ফারাক নেই৷ কেন্দ্রে মোদি সরকার যে ফ্যাসিস্ট নীতি নিয়ে চলছে তাতে রাজ্যের মানুষ আশঙ্কিত৷ ইতিমধ্যে নাট্যজগৎ–চলচ্চিত্র জগতের ৬০০ জন ব্যক্তিত্ব, সিনেমা পরিচালকরা, বিজ্ঞানীরা যৌথ বিবৃতি দিয়ে বিজেপির পরাজয় সুনিশ্চিত করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন৷ প্রশ্ন হল, কোনও সংসদীয় দলই মানুষের অতি সাধারণ দাবিগুলি পূরণ করতে পারছে না কেন? সাংসদদের তা হলে কাজটা কী? কী করছেন তাঁরা?
টি ভি চ্যানেলগুলির দৌলতে দেশের মানুষ জানেন, পার্লামেন্ট এখন হল্লাবোলের জায়গা৷ কোনও সুস্থ, চিন্তাসমৃদ্ধ বিতর্ক হতে এখন পার্লামেন্টে কেউ দেখেন না৷ বহু বিল কোনও আলোচনা ছাড়াই পাশ হয়ে যাচ্ছে৷ যে জনবিরোধী বিলগুলি পাশ হয়েছে সেগুলি নিয়েও বিতর্ক বা আলোচনা তেমন একটা হয়নি৷ এই প্রবণতা সংসদীয় গণতন্ত্রের ন্যূনতম শর্তকেই লঙঘন করছে৷ সাংসদদের ৮০ শতাংশের বেশিই কোটিপতি৷ গরিব, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মিলিয়ে জনসমষ্টির যে ৯০ শতাংশ, তাদের স্বার্থ নিয়ে পার্লামেন্টে এই সাংসদরা কি সোচ্চার হতে পারে? বাস্তবে ৯০ শতাংশ সাধারণ মানুষের কোনও প্রতিনিধি সংসদে নেই৷ এ হেন পার্লামেন্ট জনস্বার্থ রক্ষার বা দেখভাল করার ক্ষেত্রে যে কোনও ভূমিকাই পালন করতে পারে না, সেটাই স্বাভাবিক৷
তা হলে সাংসদরা কী করেন? পি আর এস, লেজিসলেটিভ রিসার্চ এবং পরিসংখ্যান ও প্রকল্প রূপায়ণ মন্ত্রক সূত্রে জানা যাচ্ছে এলাকার উন্নয়নের জন্য তহবিল মঞ্জুর হয় ২৫কোটি টাকা, ৬–৭টা বিধানসভা কেন্দ্রের জন্য মাত্র ২৫ কোটি টাকা যে কিছুই না, জনস্বার্থে তহবিল যে বাড়ানো দরকার এ নিয়ে কোনও সাংসদ সোচ্চার হয়েছেন, খবর নেই৷ কিন্তু সাংসদদের ব্যক্তিগত ভাতা–সুযোগ সুবিধা বাড়ানো দরকার না হলেও, এ ক্ষেত্রে বৃদ্ধির জন্য সব সাংসদই অতি মাত্রায় সক্রিয়৷ ২৫ কোটি টাকা দিয়ে কী কাজ করছেন সাংসদরা? সব সাংসদের ধরন মোটামুটি একই৷ যেমন–কিছু রাস্তা, নলকূপ, শৌচাগার, যাত্রী প্রতীক্ষালয় ইত্যাদি নির্মাণ৷ এই কাজগুলি তো বিধায়করা, পৌরসভার কাউন্সিলাররাও করেন, পঞ্চায়েত সদস্যরাও করেন, তা হলে সাংসদ হিসাবে তাঁদের স্বাতন্ত্র্য কোথায়?
সাংসদের কাজ হওয়া উচিত ছিল পার্লামেন্টে তার ভোটারদের যথার্থ দাবিগুলি তুলে ধরা এবং সেই অনুযায়ী নানা জনমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও রূপায়ণ৷ প্রধানমন্ত্রীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ আহ্বান নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে রেকর্ড করলেও কেন একটাও শিল্প হল না, পার্লামেন্টে তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক হওয়া দরকার ছিল৷ এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অনেকগুলি শিল্প সম্মেলন করলেও একটাও শিল্প যে করতে পারলেন না, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কের দাবি রাখে৷ মানুষের মূল চাহিদা যে কর্মসংস্থান, তা শিল্পায়ন ছাড়া কীভাবে সম্ভব হবে? এ ক্ষেত্রে প্রতিটি সরকারের শুধু প্রতিশ্রুতি বিতরণ ছাড়া আর কী আছে?
কৃষকদের দাবি সরকার সার–বীজে ভর্তুকি দিয়ে এগুলির দাম কম রাখুক৷ কিন্তু পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের নীতি মেনে পূর্বতন কংগ্রেস সরকার, বর্তমানের বিজেপি সরকার কৃষিক্ষেত্রে একদিকে সরকারি বরাদ্দ কমাচ্ছে, অন্যদিকে এই সব কিছু নিয়ে মুনাফা করার অধিকার তুলে দিয়েছে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের হাতে৷ ফসলের ন্যায্য দাম নির্ধারণ করতে হলে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে, কিন্তু সরকার বৃহৎ কৃষি ব্যবসায়ী, ফড়ে–পাইকারদের স্বার্থে এ কাজ করছে না৷ মানুষের দাবি সরকার গ্রাম শহর সর্বত্র পর্যাপ্ত পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহ করুক৷ কিন্তু জলব্যবসায়ীদের স্বার্থে সরকার তা করছে না৷ মানুষের প্রত্যাশা সরকার বিনামূল্যে গুণগত শিক্ষার ব্যবস্থা করুক, বাস্তবে সরকার সরকারি শিক্ষাকে প্রহসনে পরিণত করছে, যাতে বেসরকারি মালিকরা শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করে বিপুল মুনাফা করতে পারে৷
মানুষের প্রত্যাশা সরকার বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করুক৷ সরকার এর বিপরীতে হেঁটে চিকিৎসা ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ ঘটিয়ে করছে বিমা নির্ভর৷ মানুষের প্রত্যাশা সুস্থ সমাজের জন্য মদ নিষিদ্ধ করা হোক, সরকার উল্টো পথে হেঁটে রাজস্ব বাড়ানোর নামে মদের ঢালাও লাইসেন্স দিচ্ছে৷ এমন প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকারগুলি জনগণের প্রত্যাশার বিরুদ্ধে কাজ করছে৷ সেই কারণে বারবার ভোটে বারবার সরকার পাল্টানো বা স্থায়ী সরকার গঠন হলেও জনগণের ন্যূনতম চাহিদাগুলি পূরণ হয় না৷
তা হলে এমএলএ, এমপি–দের কাজ কী? সরকার কী ও কার জন্য? সরকার দেশের সম্পদশালী শ্রেণির অর্থাৎ পুঁজিপতি শ্রেণির রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান৷ যার কাজ পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থ সর্বোচ্চ পরিমাণে সুনিশ্চিত করা৷ আর সরকারের মন্ত্রীরা হল পুঁজিপতি শ্রেণির রাজনৈতিক ম্যানেজার৷ আর এই ম্যানেজাররাই মানুষের সামনে থাকে, মানুষ এদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে পুঁজিপতিরা ভোটের মধ্য দিয়ে এই মা্যনেজারদের বদলে দেয়৷ রাষ্ট্র বিজ্ঞানের বইয়ে বলা আছে, সরকার হল জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের প্রতিষ্ঠান৷ কথাটি উচ্চ শিক্ষিতকেও বোকা বানানোর মোক্ষম অস্ত্র৷ শ্রেণি বিভক্ত সমাজে ধনিক–ক্ষমতাধর শ্রেণির স্বার্থ রক্ষাই সরকারের কাজ৷ সেই জন্যই পুঁজিবাদী সমাজে জনস্বার্থ এত উপেক্ষিত৷ সেই কারণে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার অতি সাধারণ দাবিগুলিও পূরণ করতে সক্রিয় হন না কোনও সাংসদ৷
তাই দেশের মোট জনসংখ্যার ৯৯ শতাংশ বঞ্চিত মানুষকেই সংঘবদ্ধ হয়ে তাঁদের দাবি আদায় করতে হবে৷