হিন্দু হতে গেলে কি মুসলিম কিংবা অন্য ধর্মের মানুষকে ঘৃণা করতে হয়? সাধারণ হিন্দু ঘরের মা-ঠাকুমার কথা জানলে, বলতে হবে—না। তাঁরা ঘরে রাখা লক্ষ্মীর পটে মাথা ঠেকাতে ঠেকাতেই পাশের বাড়ির আসাদুল্লাকে বলতে পারেন—এখানে বোস, না খেয়ে যাবি না। কিন্তু বিজেপি নেতাদের কথা ধরলে? ধর্ম যাঁদের ভোটের হাতিয়ার, ঘৃণা ছাড়া তাঁদের চলবে কেন! তাই দেখা গেল বিজেপি ঘনিষ্ঠ সংস্থা ‘হিন্দুত্ব ওয়াচ’ ২০২৩ সালের প্রথম ছ’মাসে ২৫৫টি মুসলিম বিরোধী ঘৃণা ভাষণ দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর ৩০ শতাংশ ঘটেছে কেবল মহারাষ্ট্রে। এই রাজ্যে ২০২৩ সালে রাতারাতি বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। তারা মিছিলের পর মিছিল করেছে, সমাবেশ করেছে, হাজার হাজার মানুষের সামনে মুসলিম বিরোধী বিষোদগার করেছে। সব মিটিং শেষ হয়েছে একটা স্লোগান দিয়ে, ওদের কাজের উপর তীক্ষ্ম নজর রাখো, হিন্দুর শত্রুদের গৃহহারা কর্মহারা করো।
‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকা এক রিপোর্টে বলেছে, মহারাষ্ট্রের নানা প্রান্তে চার মাসে ৫০টির মতো মিছিল হয়েছে যেখানে লাভ জিহাদের বানানো অভিযোগ তোলা হয়েছে। ‘লাভ জিহাদ’-এর পাল্টা ‘ল্যান্ড জিহাদ’-এর আহ্বান জানানো হয়েছে, যার মূল কথা হল মুসলিমদের ভিটে-মাটি কেড়ে নাও। ২০২৩-এর এপ্রিলে সুপ্রিম কোর্ট এক নির্দেশিকায় বলেছে, এই ধরনের উস্কানিমূলক ভাষণ ভয়ানক অপরাধ। এই অপরাধের ক্ষেত্রে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রশাসনিক কর্তাদের স্বতঃপ্রণোদিতভাবে মামলা করতে হবে, এমনকি কোনও অভিযোগ জমা না পড়লেও। কিন্তু বিজেপি পরিচালিত মহারাষ্ট্র সরকারের পুলিশ এ ক্ষেত্রে কোনও মামলাই করেনি। পুলিশ মুখ্যমন্ত্রীকে জানায় এই জাতীয় কোনও মিছিল ও সমাবেশের কথা তাদের জানা নেই।
মহারাষ্ট্রেরই কোলহাপুরে একটি কলেজে ধর্মীয় বিভেদ সংক্রান্ত এক আলোচনায় একদল ছাত্র বলে মুসলিমরা ধর্ষক এবং তাদের কোনও শাস্তি হয় না। শিক্ষক আপত্তি জানান এবং তথ্য তুলে ধরে দেখান, এ কথা সত্য নয়। পরিণামে উক্ত শিক্ষককে সাসপেন্ড হতে হয়। সংসদে বিজেপি এমপি রমেশ বিধুরী এক মুসলিম এমপির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক কুৎসা রটান। এ কাজের পুরস্কার হিসাবে পার্টি তাকে বিশেষভাবে সম্মান জানিয়ে রাজস্থানে প্রচার টিমের মাথায় বসিয়ে দেয়।
নামে হলেও ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। বিজেপি সরকারের মন্ত্রী-বিধায়ক-সাংসদরা এই ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার শপথ নিয়েই পদে বসেন। কিন্তু তাদের কাজকর্মে ধর্মনিরপেক্ষতার আকাশে সাম্প্রদায়িকতার কালো মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে। আরেকটি লোকসভা নির্বাচন আসন্ন। মানুষকে আজ বুঝতে হবে যে, এই ভাবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর পিছনে শাসক শ্রেণির একটি গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে। তা হল এর মধ্য দিয়ে শোষিত মানুষকে পরস্পরের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে ফেলা। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষকে যদি বোঝানো যায় তার জীবনের সব সমস্যার জন্য দায়ী মুসলমানরা, তা হলে পুঁজিবাদী এই উৎপাদন ব্যবস্থা এবং তার শোষণ প্রক্রিয়াটি আড়ালে থেকে যায়। আর তার মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যা মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি প্রভৃতিকে পিছনে ঠেলে দেওয়া যায় এবং পুঁজিপতি শ্রেণির শোষণ-বঞ্চনাকে আরও তীব্র করা যায়। পুঁজিপতি শ্রেণি এবং তার সেবাদাস সরকারের পক্ষে শোষণের রথটা বিনা প্রতিবাদে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।
(সূত্রঃ ফ্রন্টলাইন, ১২ জানুয়ারি, ‘২৪)