সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ৭০টি পিওন পদে চাকরির জন্য বিজ্ঞপ্তি বেরোয়৷ ন্যূনতম যোগ্যতা অষ্টম পাশ৷ প্রায় ১১ হাজার আবেদন জমা পড়ে৷ এদের মধ্যে রয়েছেন গবেষক, বিজ্ঞানে অনার্স, বিটেক, এম টেক ডিগ্রিধারীরা৷ কিছুদিন আগে উত্তরপ্রদেশে সরকারি অফিসে ৩৬৬টি পিওন পদের জন্য আবেদন পড়েছিল ২৩ লক্ষ৷ আবেদনকারীদের মধ্যে ছিলেন ২৫৫ জন পি এইচ ডি, ২ লক্ষ ইঞ্জিনিয়ার৷ মধ্যপ্রদেশের ৯,২৩৫ পাটোয়ারি পদের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল দশম শ্রেণি পাশ৷ কিন্তু আবেদন যাতে কম জমা পড়ে তার জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা বাড়িয়ে করা হল স্নাতক৷ তাতেও ১২ লক্ষের উপর আবেদন জমা পড়ল যার মধ্যে ২০,০০০ পি এইচ ডি৷ ২০০৮–’০৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের স্টাফ সিলেকশন কমিশনের পরীক্ষা দিয়েছিল ১০ লক্ষ বেকার আর ২০১৬–’১৭ সালে এই একই পরীক্ষায় আবেদন পড়েছে দুই কোটি৷ সম্প্রতি রেলের একটি গ্রুপ ডি পদের পরীক্ষায় আবেদন জমা পড়েছে আড়াই কোটিরও বেশি৷
২০১৪–য় লোকসভা নির্বাচনের আগে বছরে ২ কোটি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ বলেছিলেন, ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ কিন্তু বাস্তবের মাটিতে বিকাশের ছিঁটেফোটা প্রতিফলনও দেখা যায়নি৷ কোথায় উন্নয়ন? কোথায় চাকরি? চার বছরে ৮ কোটি চাকরি তো দূর অস্ত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুযায়ী কর্মসংস্থান কমেছে ০.১ শতাংশ৷
আমাদের দেশে বছরে যাদের ১৮৩ দিন কাজ মেলে তারাই শ্রমশক্তি হিসাবে পরিগণিত হয়৷ এই শ্রমশক্তির কতজন বেকার তা হিসাব করা হয় ম্যানুফ্যাকচারিং, ব্যবসা, নির্মাণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আই টি, পরিবহণ, হোটেল–রেস্তোরাঁ এই আটটি ক্ষেত্রে ১০ জনের বেশি কাজ করে এমন সংস্থা বা কারখানা ধরে৷ বাকিটা যেখানে দেশের ৯০ শতাংশ লোক কাজ করে তা থাকে হিসাবের বাইরে৷ প্রতি বছর প্রায় ২ কোটি যুবক বেকার বাহিনীতে নাম লেখাচ্ছে৷ যাদের কাজ ছিল, তাদেরও কাজ চলে যাচ্ছে৷ কারণ শিল্পে মন্দা, কৃষিতে সংকট৷ তথ্যপ্রযুক্তিতে ইতিমধ্যে অনেকের কাজ চলে গেছে৷ একটি বেসরকারি সমীক্ষার মতে কিছুদিনের মধ্যে আরও ৫০ শতাংশ কাজ কমবে৷ ১০০ দিনের কর্মসংস্থান প্রকল্পে কোথাওই সবদিন কাজ জুটছে না, কাজ করলেও শ্রমিকরা টাকা পাচ্ছেন না৷ বছরের বাকি দিনগুলিতে কাজের কোনও নিশ্চয়তা নেই৷ গ্রামে কর্মহীনতা ব্যাপক৷ ন্যূনতম মজুরি পাচ্ছে না গ্রাম–শহরের শ্রমজীবীরা৷
কিন্তু কেন এই অবস্থা? কীভাবে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব? সরকার বেকার সমস্যা সমাধানে আন্তরিক কি? বাস্তবে আমরা দেখছি কোনও সরকারই তা চায় না৷ যদি চাইত তা হলে কেন্দ্র–রাজ্য সরকারের লক্ষ লক্ষ পদ খালি পড়ে থাকত কি? খালি পদ পূরণ তো দূরের কথা সম্প্রতি কেন্দ্র পাঁচ বছর ধরে খালি পড়ে থাকা পদগুলি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এমন একটা সময়ে যখন বেকার সমস্যা ভয়াবহ৷ সম্প্রতি রেলমন্ত্রী সংসদে বলেছেন রেলে ২,২২, ৫০৯ পদ খালি৷ সুরক্ষা দপ্তরে ১, ২৮, ৯৪২ পদ খালি৷ শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের রেল দপ্তরেই যদি এত লক্ষ পদ খালি থাকে তা হলে কেন্দ্র আর সব রাজ্য সরকারের সব দপ্তরের শূন্যপদগুলি যোগ করলে কী বিশাল আকার দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়৷
এই শূন্যপদের সংখ্যা কত তা দেশবাসীকে জানায় না৷ সব পদে চাকরি তো দূরের কথা এখন তিনটি পদ শূন্য হলে একটি পদে নিয়োগ হয়৷ তাও ঠিকা ভিত্তিতে৷ ভোটের আগে যতই চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হোক, ভোট পেরোলেই সব শাসকের এক রা– রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, তেলেভাজা বেচো– প্রধানমন্ত্রী বলেন পকোড়া৷
এতেই শেষ নয়, যতটুকু সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তি বের হয়, বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হয় না৷ এখানে কেন্দ্র হোক বা রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গ বা মধ্যপ্রদেশ সব সরকারই এক৷ ২০১২ সালে স্কুল সার্ভিস পরীক্ষা, আপার প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া, ২০১৫–তে এল ডি সি, এল ডি এ, কে পি এস পদে নিয়োগের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা ২০১৮–তেও শেষ হয়নি৷ ৭ জুন ২০১০ বিহার সরকার বিহার কর্মচারী চয়ন আয়োগকে ২০৩০ জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার পদে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরুর নির্দেশ দেয়৷ ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১২–তে পরীক্ষা হয়৷ শুধুমাত্র পরীক্ষা নিতেই লেগে গেল ২ বছর ৯ মাস৷ পরে কিন্তু অভিযোগের কারণে পরীক্ষা বাতিল হয়৷ তারপর আর পরীক্ষা নেওয়া হয়নি৷
ভারতে সংগঠিত ক্ষেত্রের মতো বেসরকারি ক্ষেত্রেও নিয়োগ ক্রমাগত কমছে৷ বেসরকারি সংস্থায় চলছে অটোমেশন৷ অটোমেশনের মানে কর্মী ছাঁটাই, শ্রমঘন্টা (সময়) বৃদ্ধি৷ কেন শ্রমিক ছাঁটাই হবে? কেন কমবে না এই শ্রম ঘন্টা? শ্রম ঘন্টা কমলে তো শিফট বাড়বে৷ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে৷ মানুষের আয় বাড়বে৷ বাজার সংকট কমবে৷ গড়ে উঠবে আরও শিল্প৷ আরও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে৷ এ ভাবেই ভারতের বিপুল মানব সম্পদ অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে৷ অথচ যারা কাজ করে তাদের অবস্থা দুর্বিষহ৷ স্থায়ী শ্রমিক ক্রমাগত কমছে৷ সর্বত্র ঠিকা প্রথা৷ যে কোনও সুস্থ সভ্য সমাজে যে রক্ষাকবচগুলি প্রাথমিক বা ন্যূনতম বলে স্বীকৃত ও ব্যবহূত, এ দেশে অসংগঠিত এমনকী অনেক সময় সংগঠিত ক্ষেত্রেও সেগুলি কল্পনাবিলাস৷ সুরক্ষা বিধি আছে কিন্তু চতুর ঠিকাদার, মুনাফালোভী নিয়োগ কর্তা, উদাসীন সরকার শ্রমিকদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করছে৷ তাই তাদের জীবনের সুরক্ষা নেই, সামাজিক সুরক্ষাও নেই৷
এই অবস্থায় মানুষের সামনে একটিই পথ খোলা আছে৷ তা হল চাকরির ন্যায্য দাবিতে, সমস্ত সরকারি শূন্যপদ পূরণের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা৷
(৭০ বর্ষ ৪০ সংখ্যা ২৫ মে, ২০১৮)