লক্ষ লক্ষ ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে নির্বাচনী প্রচারে সেই তথ্য ব্যবহারের অভিযোগে সম্প্রতি কাঠগড়ায় উঠেছে ব্রিটেনের কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা নামে একটি সংস্থা৷ এই খবরপ্রকাশ পেতেই বিশ্ব জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়৷ বর্তমান বিশ্বে ক্রমাগত বেশি বেশি মানুষ ইন্টারনেটে অনলাইন পদ্ধতিতে কেনাকাটা, ব্যাঙ্কের লেনদেন, পড়াশোনা ইত্যাদি কাজেভ্যস্ত হয়ে পড়ছে৷ এইসব কাজের প্রয়োজনে ইন্টারনেটে দিয়ে রাখা তাদের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি যাওয়া মানে একদিকে যেমন তাদের ব্যক্তিগত পরিসর বেআব্রু হয়ে পড়া, তেমনই তথ্যগুলি ব্যবহার করে যে কোনও সময় তাদের বিপদে ফেলে দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হওয়া, অর্থাৎ ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার দফারফা৷ ফলে গোটা বিশ্বেই প্রচারমাধ্যম তথ্য চুরির এই ঘটনাকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করেছিল৷ এ খবর প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল যে ‘অবজার্ভার’ ও ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় সেখানে একটি ‘স্টিং অপারেশন’–এর ঘটনা তুলে ধরা হয়৷ দুই সাংবাদিককে শ্রীলঙ্কার নির্বাচনের প্রার্থী সাজিয়ে ব্রিটেনের ‘চ্যানেল ফোর নিউজ’ চালিয়েছিল সেই অন্তর্তদন্ত৷ একটি ভিডিও ছবিতে প্রথম ধরা পড়ে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার সন্দেহজনক কাজকর্মের খানিকটা হালহদিশ৷ তথ্য ফাঁসের ঘটনা সামনে আসতেই প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়ে ব্রিটেনের দুটি সরকারি সংস্থা ‘তথ্য কমিশন’ ও ‘নির্বাচন কমিশন’ অ্যানালিটিকা এবং ফেসবুক নিয়ে তদন্ত শুরু করে৷ মার্কিন কংগ্রেসও তথ্য ফাঁসের তদন্ত শুরু করে এবং ফেসবুকের মালিক মার্ক জুকেরবার্গকে সাক্ষ্য দিতে ডেকে পাঠায়৷ তাদের উদ্দেশ্য ছিল, কিছুদিন আগে হওয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের যে অভিযোগ উঠেছিল, সে বিষয়ে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কোনও ভূমিকা ছিল কি না তা খতিয়ে দেখা৷ মানুষের ক্ষোভ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, ফেসবুক থেকে তথ্য ফাঁসের জন্য মার্ক জুকেরবার্গ জনসমক্ষে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন৷ স্লোগান ওঠে ‘ফেসবুক বাতিল কর’৷ এই সময় শেয়ার বাজারে ফেসবুকের শেয়ারের দাম পড়ে যায়৷ ভারতের রাজনৈতিক চালচিত্রটিতেও এই ঘটনার অভিঘাত এসে পড়ে৷
কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা–ফেসবুক জুটি কীভাবে কাজ করেছে
লন্ডনের কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা রাজনৈতিক পরামর্শদাতা সংস্থা হিসাবে ‘স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশনস ল্যাবরেটরি’ (এসসিএল)–এর একটি শাখা রূপে কাজ শুরু করে ২০১৩ সালে৷ এসসিএল–এর কাজ গোটা বিশ্বে নির্বাচনগুলি পরিচালনা করা৷ প্রধানত উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ভোটের সময় রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের জনসমর্থন বাড়ানোর কাজে এই সংস্থার ডিজিটাল দক্ষতা ব্যবহার করত৷ কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা তৈরির পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হোয়াইট হাউস অ্যাডভাইসার স্টিভ ব্যাননের, যিনি আবার নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির অন্যতম ঘনিষ্ঠ৷ কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ২০১৬ সালে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারে বিরাট ভূমিকা নিয়েছিল৷ নির্বাচনী প্রচারে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার অসাধু কার্যকলাপের ধরনধারণ প্রথম ফাঁস করেন ওই সংস্থারই প্রাক্তন কর্মী ক্রিস্টোফার ওয়াইলি৷ ‘অবজার্ভার’ পত্রিকায় তিনি ফাঁস করে দেন যে এই সংস্থা লক্ষ লক্ষ মার্কিন ভোটারের ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে একটি শক্তিশালী সফটওয়্যার প্রোগ্রাম তৈরি করেছে যার সাহায্যে তাদের নির্বাচনী মতামত আগে থেকে অনুমান করা যায় শুধু নয়, সেই মতকে প্রভাবিতও করা যায়৷ একটি অ্যাপ ব্যবহার করে ভোটারদের তথ্যগুলি সংগ্রহ করা হত৷ এই অ্যাপটি তৈরি করেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির গবেষক আলেকসান্দার কোগান৷ কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কোগানের সংস্থা গ্লোবাল সায়েন্স রিসার্চ (জিএসআর)–এর সঙ্গে একযোগে ৩ লক্ষ ৫ হাজার ফেসবুক ব্যবহারকারীকে অর্থের বিনিময়ে একটি পার্সোনালিটি টেস্ট দিতে এবং তা থেকে পাওয়া তথ্য গবেষণার কাজে লাগাবার অনুমতি দিতে রাজি করায়৷ কিন্তু কার্যত অ্যানালিটিকা ওই ব্যবহারকারীদের ফেসবুক–বন্ধুদের তথ্যও হাতিয়ে নেয়৷ তার দপ্তরে জমা হয় বিনা অনুমতিতে পাওয়া ৮ কোটি ৭০ লক্ষ ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য৷ এই তথ্য থেকে ব্যবহারকারীদের মানসিকতা বুঝে, তাঁদের পছন্দ, অপছন্দ, দুর্বলতা ইত্যাদি জেনে নিয়ে নানা সোস্যাল মিডিয়ার সাহায্য নিয়ে তাঁদের মতামত প্রভাবিত করা হয়৷ সুকৌশলে ও অত্যন্ত গোপনে এই কাজ চলে যা ব্যবহারকারীরা জানতেও পারেন না৷
ব্রিটেনের চ্যানেল ফোর নিউজে প্রচারিত স্টিং অপারেশনে অংশ নেওয়া দুই সাংবাদিকের একজন কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কাজকর্মের অনৈতিক দিকগুলি তুলে ধরেন৷ দেখান, নানা মিথ্যা তথ্য পরিবেশন থেকে শুরু করে বানানো খবর প্রচার করা, নিজেদের মক্কেলের বিরোধী প্রার্থীকে আকর্ষণীয় নানা প্রস্তাব দিয়ে তাঁর সাথে কথাবার্তার ভিডিও রেকর্ডিং তাঁর অনুমতি ছাড়াই প্রচার করে তাঁকে হতমান করা, মহিলাদের ব্যবহার করে বিরোধী প্রার্থীদের ফাঁসিয়ে দেওয়া ইত্যাদি সমস্ত রকম অপকৌশলে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা দক্ষ৷ এমনকী বিরোধী প্রার্থী যে ধর্মাবলম্বী, সেই ধর্ম সম্পর্কে জঘন্য অপপ্রচার চালিয়ে তাঁর সম্পর্কে জনমানসে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি করতেও পিছপা নয় ওই সংস্থা৷ তিনি জানান, অ্যানালিটিকা নাইজেরিয়া, ভারত, আর্জেন্টিনা, চেক রিপাবলিক, কেনিয়া সহ বহু দেশে ২০০–র বেশি নির্বাচনে এই ধরনের কাজ করেছে৷ ব্রিটেনে অ্যানালিটিকার পিতৃপ্রতিম সংস্থা এসসিএল গোষ্ঠী কনজারভেটিভ এবং লেবার– দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের হয়েই কাজ করেছে৷
সিএ–র পাশাপাশি ফেসবুকের বিরুদ্ধেও অভিযোগের ঝড় উঠেছে৷ কারণ ৮ লক্ষ ৭০ হাজার ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়ে গেছে জেনেও তাঁদের সেইসব তথ্য উদ্ধার করা ও সেগুলির নিরাপত্তা সুরক্ষিত করার কোনও চেষ্টা করেনি ফেসবুক কর্তৃপক্ষ৷ এমন অভিযোগও উঠেছে যে, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার সঙ্গে আঁতাত করেই ফেসবুক এসব তথ্য ফাঁস হয়ে যেতে দিয়েছে৷ এমনকী কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কাছ থেকে টাকা ঘুষ নেওয়ারও অভিযোগ ওঠে ফেসবুকের বিরুদ্ধে৷
ভারতেও কাজ চালিয়েছে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা
ভিনদেশি প্রচারমাধ্যমে অ্যানালিটিকার অপকীর্তি ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনায় ভারতেও শোরগোল ওঠে৷ জানা যায়, এদেশের ৩৫৫ জন ফেসবুক ব্যবহারকারী কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার পূর্বোল্লেখিত অ্যাপটি ব্যবহার করে, ফলে ৫ লক্ষ ৬২ হাজার ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য চলে যায় ওই সংস্থার হাতে৷ বিজেপি ও কংগ্রেস উভয় দল একে অপরের বিরুদ্ধে অ্যানালিটিকার পরিষেবা নেওয়ার অভিযোগ তুলতে থাকে৷ কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ ফেসবুক ও অ্যানালিটিকার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে ব্যাপক হুমকি দিতে থাকেন৷ যদিও বাস্তবে সেই হুঙ্কার ছিল দেশের মানুষের চোখে ধুলো দেওয়ার অপচেষ্টা৷ কারণ, এই সংস্থা দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ এবং সে কথা বিজেপি নেতা–মন্ত্রীরা ভালই জানেন৷ অ্যানালিটিকার ওয়েবসাইটে দেওয়া এ সংক্রান্ত লেখা থেকেই তা জানা যায়৷ সেখানে আছে – ‘২০১০–এর বিহার বিধানসভা নির্বাচনে নির্বাচনী পরিস্থিতি খুঁটিয়ে পর্যালোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কেমব্রিজ অ্যানালিটিকাকে৷ সেখানে গত ১৫ বছরের শাসনে রাজ্যের অপরিবর্তিত দুর্দশার পরিস্থিতিতে–কোনও নির্দিষ্ট দলের গোঁড়া সমর্থক নন যাঁরা– এমন ভাসমান ভোটারদের নির্বাচন সম্পর্কে বিরূপতা কতখানি, দুই রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনে তা বুঝে নেওয়াই ছিল আসল চ্যালেঞ্জ৷ এর সঙ্গে সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল স্তরে স্তরে যোগাযোগ গড়ে তুলে গ্রামস্তরে মানুষের মধ্যে সমর্থন সৃষ্টি করে দলকে সংগঠিত করার৷ অ্যানালিটিকার টার্গেট করা মোট আসনের ৯০ শতাংশই জিতে নিয়ে আমাদের মক্কেল নির্বাচনে বিপুল জয় পেয়েছিল৷’ এখানে ‘মক্কেল’ বলে যাকে উল্লেখ করা হয়েছে তা স্পষ্টতই বিজেপি, কারণ ২০১০–এর নির্বাচনে বিজেপি–জেডি(ইউ) জোটই জয়লাভ করেছিল৷
ভারতে অ্যানালিটিকার পার্টনার ওভলিন বিজনেস ইন্টেলিজেন্স (ওবিআই)–এর মালিক যে অমরীশ ত্যাগী যিনি জেডি(ইউ)–এর সাধারণ সম্পাদক কে সি ত্যাগীর পুত্র– এ কথা ইতিমধ্যে প্রকাশ্যে এসে গেছে৷ এই ওবিআই–এর কাজ করার পদ্ধতি সম্পর্কে শ্রী ত্যাগী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘বুথভিত্তিক গবেষণা ও নির্বাচনী ইতিহাসের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি একটি নির্দিষ্ট বুথে কতজন ভোটার কোনও বিশেষ মতাদর্শকে সমর্থন করে ভোট দেন৷ … এরপর আমরা ওই বুথের একটি নির্বাচনী চিত্র তৈরি করি’ (দি এশিয়ান এজ, ২২ মার্চ, ২০১৮)৷ অ্যানালিটিকার ওয়েবসাইটে উল্লেখিত ‘কোনও নির্দিষ্ট দলের গোঁড়া সমর্থক নন যাঁরা– এমন ভাসমান ভোটারদের নির্বাচন সম্পর্কে বিরূপতা কতখানি, দুই রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনে তা বুঝে নেওয়াই ছিল আসল চ্যালেঞ্জ’– এই বক্তব্যের সাথে মিলিয়ে নিলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, অনিচ্ছুক বা বিরূপ ভোটারদের মতামত প্রভাবিত করে মক্কেল দলের প্রার্থীর পক্ষে নিয়ে আসা এবং তাঁকে ভোট করানোই হল কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার উদ্দেশ্য৷
অ্যানালিটিকার অনৈতিক কার্যকলাপ সম্পর্কে সরব হয়েছিলেন যিনি সেই ক্রিস্টোফার ওয়াইলি এক টুইটে জানিয়েছেন ভারতের ৬০০ জেলার ৭ লক্ষ গ্রামের তথ্যভান্ডার রয়েছে এসসিএল গোষ্ঠীর কাছে৷ টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘জনসাধারণের মধ্য থেকে বিশেষ গোষ্ঠীকে চিহ্ণিত করে ও তাদের প্রভাবিত করে আমাদের মক্কেলদের আকাঙিক্ষত ফল পেতে সাহায্য করতে আমরা পরিষেবা দিয়ে থাকি৷’ এক্ষেত্রে এই ‘আকাঙিক্ষত ফল’–এর অর্থ হল, অনৈতিক উপায়ে প্রচার চালিয়ে মক্কেল রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের নির্বাচনে জিততে সাহায্য করা৷ এঁর টুইট থেকে আরও জানা যায়, ২০০৯–এর লোকসভা ভোট, উত্তরপ্রদেশের ২০০৭, ’১১ ও ’১২ সালের ভোট, ২০১০ সালের বিহার নির্বাচন, ২০০৭–এর কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ঝাড়খণ্ড ও উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন, ২০০৩–এর মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানের নির্বাচন ইত্যাদিতে এসসিএল–কে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী কারচুপিকে আরও নির্মম ও সূক্ষ্মতর করা হয়েছে৷ গণতন্ত্রের নামে কী প্রহসন!
এনডিটিভি একবার রিপোর্ট করেছিল যে, ‘লিঙ্কড ইন’ (ইন্টারনেটে প্রাপ্ত প্রফেশনাল নেটওয়ার্ক)–এ ওবিআই–এর এক বড়কর্তা হিমাংশু শর্মার পেজে তিনি জানিয়েছেন যে তিনি বিজেপি–র হয়ে ৪টি নির্বাচনী প্রচার সফল ভাবে পরিচালনা করেছেন যেগুলিতে টাকার বন্যা বহানো হয়েছিল এবং ২৭২–এর বেশি আসনে জেতার লক্ষ্যে পৌঁছনো গিয়েছিল৷ প্রসঙ্গত, ২০১৪–র নির্বাচনে বিজেপি ‘২৭২ প্লাস’ আসনে জেতার স্লোগানই তুলেছিল৷ বিষয়টি প্রচার হয়ে যাওয়ার পরেই শর্মার লিঙ্কড ইন প্রোফাইল থেকে পেজটি সরিয়ে নেওয়া হয়৷
বাস্তব হল, নির্বাচনী প্রচারে ডিজিটাল প্রযুক্তি ও সোস্যাল মিডিয়ার ব্যাপক সাহায্য নেওয়ার ক্ষেত্রে এদেশের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে বিজেপিই ছিল পথপ্রদর্শক৷ ২০১৪–র লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি–র ব্যাপক কার্যকরী ডিজিটাল প্রচার ব্যবস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং বর্তমানে মোদি সরকারের ডিজিটাল প্রকল্প ‘মাইগভ’–এর বড়কর্তা অরবিন্দ গুপ্তা টুইট করে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার ঢালাও প্রশংসা করেছেন৷ ফলে বিজেপির সঙ্গে এই সংস্থার ঘনিষ্ঠতা কত গভীর তা বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ আবার লন্ডনে অ্যানালিটিকার দপ্তরে কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতীক সহ পোস্টার থাকার ঘটনাও প্রচারমাধ্যমের দৌলতে সামনে এসে গেছে৷
বিজেপি এবং কংগ্রেস, পুঁজিপতি শ্রেণির আশীর্বাদধন্য দুই প্রধান রাজনৈতিক দলই কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা বা তার ভারতীয় দোসরের সঙ্গে যোগাযোগের কথা অস্বীকার করে থাকে৷ যেটুকু তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে তা থেকে পরিষ্কার যে উভয় দলেরই এদের সঙ্গে ওঠাবসা রয়েছে৷ তবে এদেশের নির্বাচনী ক্রিয়াকলাপের কতটা গভীর পর্যন্ত অ্যানালিটিকার হাত পৌঁছেছে তা এখনও অস্পষ্ট৷ সংগৃহীত তথ্য কীভাবে অপব্যবহার করা যায় এবং গণতান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপে বাইরের শক্তি কেমন করে প্রভাব বিস্তার করে এই সংক্রান্ত ঘটনায় তা সামনে এসে গেল৷
তথ্য নিয়ে এইসব বেআইনি কার্যকলাপে ব্যক্তির গোপনীয়তা এবং তার ব্যক্তিগত বিষয়গুলির নিরাপত্তা বিরাট প্রশ্নের মুখে পড়েছে৷ শুধু নির্বাচনে ছাপ ফেলাই নয়, এর প্রভাব আরও বহু দূর বিস্তৃত৷ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সহ বিভিন্ন পরিষেবার সঙ্গে বাধ্যতামূলক ভাবে আধার নম্বর যুক্ত করার জন্য বিজেপি সরকার দেশের মানুষের উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে চলেছে৷ এতে দেশের প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য– যেমন তার আর্থিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক পছন্দ–পছন্দ, তার চলাফেরা সমস্ত কিছুই সরকারের নখদর্পণে চলে আসবে যা ভয়ঙ্কর রকম বিপজ্জনক পরিস্থিতির জন্ম দেবে৷ প্রধানমন্ত্রীর ‘নমো অ্যাপ’–এর মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সরকারের হাতে চলে গেছে৷ সম্প্রতি আধারের তথ্য এবং ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনা মানুষের মধ্যে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে কারণ আমাদের দেশে তথ্য সুরক্ষা সংক্রান্ত উপযুক্ত আইন নেই৷ এর উপর রাজনৈতিক দলগুলির বিদেশ থেকে অর্থসাহায্য পাওয়া সহজ করে দিতে প্রচলিত আইনের যে সংশোধন করা হয়েছে তার ফলে বিদেশি অসাধু ডিজিটাল সংস্থাগুলি খুব সহজেই এ দেশের গণতান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপে নাক গলাতে পারবে৷
বুর্জোয়া নির্বাচন আজ প্রহসন ছাড়া কিছু নয়
কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের কার্যকলাপ থেকে স্পষ্ট যে, সংকটগ্রস্ত মুমূর্ষু পুঁজিবাদের এই যুগে বুর্জোয়া সংসদীয় নির্বাচনগুলি নিছক প্রহসনে পরিণত হয়েছে৷ বিকাশমান শক্তি হিসাবে পুঁজিবাদ যখন সামন্তী স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে রত ছিল তখন তা সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিল, জয়গান গেয়েছিল গণতন্ত্রের৷ গণতন্ত্রের এই বুর্জোয়া ধারণার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল সংসদীয় ব্যবস্থা৷ ঘোষিত হয়েছিল, অবাধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের ইচ্ছা প্রতিফলিত হবে৷ নির্বাচনের প্রার্থীরা নানা বিষয়ে নিজস্ব মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করবেন৷ জনসাধারণ নিজস্ব যুক্তি–বুদ্ধি প্রয়োগ করে প্রার্থীদের বক্তব্যের সত্যাসত্য বিচার করবেন এবং যে প্রার্থী সত্যকে প্রতিফলিত করছেন, তাঁকে নির্বাচিত করবে৷ প্রচারমাধ্যম জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে প্রকৃত সত্য প্রচার করবে এবং শাসকদের ক্ষমতার অপব্যবহারের উপর লাগাম পরাবে৷ কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সংকটে নিমজ্জিত হওয়ার পর থেকেই গণতন্ত্রের উচ্চ আদর্শ শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছে৷ সর্বোচ্চ মুনাফা লুঠের উদ্দেশ্যে পরিচালিত পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা আজ অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সহ সর্বাত্মক সংকটে পড়েছে৷ সংকট থেকে রেহাই পাওয়ার মরিয়া চেষ্টায় বুর্জোয়া ব্যবস্থা আজ সমস্ত ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে আপস করছে৷ গণতন্ত্রের বুলির আড়ালে ফ্যাসিবাদ আনার অপচেষ্টা চলছে৷ সমস্ত পুঁজিবাদী দেশেই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারিত হয় অর্থের শক্তি, পেশিশক্তি আর কর্পোরেট পুঁজি পরিচালিত প্রচারমাধ্যমের দৌলতে জনমতকে প্রভাবিত করে৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান, উভয় দলের প্রার্থীর মনোনয়নের ক্ষেত্রে, কে কত বেশি টাকা ঢালতে পারবেন, খোলাখুলি তাই নিয়ে আলোচনা হয়েছে৷
ফেসবুক, কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার মতো এই ধরনের আধুনিক সংস্থাগুলি গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে৷ সত্য খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে জনসাধারণকে যুক্তিবোধ দ্বারা পরিচালিত করার চেষ্টা দূর অস্ত্, এরা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের দুর্বলতা খুঁজে বের করছে এবং অনৈতিক উপায়ে তাদের মতামত প্রভাবিত করছে৷ নিজের মক্কেল রাজনৈতিক দলের প্রার্থীকে জেতাতে বিপক্ষ দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে যেকোনও রকম নোংরা কৌশল প্রয়োগ করতে এরা ভাড়া খাটছে৷ যে তাদের বেশি টাকা দেবে, তার জন্য নীতিবর্জিত কার্যকলাপে তাদের আপত্তি নেই৷ ফলে চরম প্রতিক্রিয়াশীল একটি রাজনৈতিক দল যদি তাদের বেশি টাকা দেয়, তাহলে তার জন্য কাজ করতে একপায়ে খাড়া থাকে এরা৷ এই পথেই গণতন্ত্রের প্রাণসত্তাকে ধ্বংস করা হচ্ছে৷
(তথ্যসূত্র : প্রোলেটারিয়ান এরা, ১৫ এপ্রিল ২০১৮)
(৭০ বর্ষ ৪০ সংখ্যা ২৫ মে, ২০১৮)