পঞ্চায়েত নির্বাচন প্রক্রিয়া চলাকালীন ৫৪ জনের বেশি মানুষ খুন হয়ে গেলেন। হাত-পা ভাঙল, মাথা ফাটল, গুলিবিদ্ধ হলেন আরও বহু মানুষ। ঘরছাড়া হতে হল অনেককে। এই মানুষগুলি কারা? বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ, সাধারণ যুবক। এঁদের হাতে বন্দুক, পিস্তল, রড, উইকেট ধরিয়ে দিয়ে এই মৃত্যুপথে ঠেলে দিল কারা? কারা এদের পাঠাল তারই মতো আর একজন সাধারণ মানুষকে খুন করতে, মাথা ফাটাতে, ঘর জ্বালিয়ে দিতে? ভোট রাজনীতির অংশীদার যুযুধান রাজনৈতিক দলগুলির নেতারাই হলেন এর হোতা। স্বজনহারা বহু মানুষের চোখের জল দেখে অনেকেরই চোখ সজল হয়ে উঠেছে। কিন্তু সে-সবই বিজয় মিছিলের আবীরের রঙে আর উদ্দাম ডিজের কান ফাটানো আওয়াজে আড়ালেই থেকে গেছে। রাজনীতিতে কেন এই গুন্ডাতন্তে্রর উদ্ভব?
রাজনৈতিক দল মানে তো দেশের অভিভাবক। তাঁরা দেশকে যেমন করে পরিচালনা করেন দেশ তেমন চলে। নেতারা যে পথ দেখান, সেই পথেই চলে দেশের মানুষ, বিশেষত দেশের ছাত্র-যুব সমাজ। রাজনৈতিক দলের নেতারাই তো দেশের নীতি নির্ধারণ করেন, সেই নীতি সমাজে, অর্থনীতিতে, শিক্ষানীতিতে, সমাজনীতিতে কার্যকর হয়। তাই দল সঠিক হলে, তার নেতারা সৎ, নীতিনিষ্ঠ হলে সমাজও ঠিক পথে চলে, আর দলের লক্ষ্য যদি জনগণের মঙ্গল না হয়, নেতারা যদি অসৎ হন, অসচ্চরিত্র হন, লোভী, স্বার্থপর হন, তবে সমাজে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। তখন সমাজটাও আর ঠিক থাকে না, ছাত্র-যুবরাও বিপথগামী হয়। বলেছেন, এ যুগের বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক, এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর প্রতিষ্ঠাতা শিবদাস ঘোষ। গত শতকের ছয়ের দশকে বলা তাঁর এই বক্তব্য কত বড় সত্য, ঘটনা পরম্পরা দেখিয়ে দিচ্ছে। এই অপরাজনীতির বিরুদ্ধে তিনি তুলে ধরেছেন রাজনীতি সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁর কথায়, রাজনীতি একটি উচ্চ হৃদয়বৃত্তি। যে হৃদয়বৃত্তি স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রবল ভাবে কাজ করেছিল। পরবর্তীকালে বামপন্থী আন্দোলনেও সঠিক সংগ্রামী ঝান্ডা নিয়ে যাঁরা চলেছেন তাঁদের মধ্যেও তা কাজ করেছে এবং আজও কাজ করে চলেছে। সেই হৃদয়বৃত্তি কোথায় এই ভোটসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে?
আজ ভোট-সর্বস্ব দলগুলির এই সব নেতারা কোন পথে নিয়ে যাচ্ছেন দেশের ছাত্র-যুব সমাজকে? এই যে যুবকদের বিরাট এক অংশের হাতে তারা অস্ত্র তুলে দিলেন ভোট রাজনীতিতে ফয়দা তোলার জন্য এবং যুবকরা সে উদ্দেশ্য হাসিল করে এলেন, তাদের এই ভূমিকা কি নির্বাচনী প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে যাবে? না, যাবে না। এই নেতারা কেউ ক্ষমতা ধরে রাখতে, কেউ ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে অর্থাৎ তাঁদের সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থে, ব্যক্তিগত স্বার্থে যুবসমাজকে যে অগণতান্ত্রিক, অনৈতিক রাস্তায় ঠেলে দিলেন, সে-রাস্তা এখানেই শেষ হবে না। সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তা অনৈতিকতার, বিদ্বেষের বিষ ছড়াতে থাকবে। সত্য, ন্যায়, গণতন্ত্র তাদের হাতে প্রতি মুহূর্তে মার খেতে থাকবে। আর সেই পরিণতি দেখে সমাজের একটি বড় অংশের সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হবেন, বিরক্তি প্রকাশ করবেন, কপাল চাপড়াতে থাকবেন, আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবেন, সমাজটা রসাতলে গেল, সততার, ন্যায়ের কোনও মূল্য নেই– জোর যার মুলুক তার। ইতিমধ্যেই যা বলতে শুরু করেছেন কেউ কেউ। কিন্তু এই বলেও শেষ পর্যন্ত যদি তাঁরা এই দলগুলির কোনও না কোনও একটির পিছনে গিয়ে দাঁড়ান, এ-কথা ও-কথা বলে তাদেরই সমর্থন করেন, তবে তো এই প্রতারণার রাজনীতি, ভণ্ড রাজনীতি, জনস্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করা রাজনীতিই সমাজজুড়ে জাঁকিয়ে বসে থাকবে এবং সাধারণ মানুষও এই দুষ্টচক্র থেকে কোনও দিনই বের হতে পারবে না।
আর যে নেতারা যুবকদের নিরুপায় বেকার জীবনকে কাজে লাগিয়ে টাকার বিনিময়ে, চাকরির লোভ দেখিয়ে অনৈতিকতার পথে ঠেলে দিলেন, তাঁরা কি আদৌ অভিভাবকের কাজ করলেন? কমরেড শিবদাস ঘোষ বহু দিন আগেই বলেছিলেন, শাসক পলিটিক্যাল পার্টিগুলো আজ এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। পয়সার বিনিময়ে নেতারা এইসব যুবকদের দিয়ে পার্টির কাজ করাচ্ছে। তাদের দিয়ে পোস্টার মারাচ্ছে। জাল ভোট, ছাপ্পা ভোট দেওয়াচ্ছে, বুথ দখল, বিরোধীদের উপর সন্ত্রাস চালাতে যত রকম উপায় আছে সে-সব কিছুই তাদের দিয়ে করাচ্ছে।
এই যুবকরা কি আদৌ রাজনৈতিক কর্মী? রাজনৈতিক কর্মী মানে তো সমাজকর্মী– যারা সমাজের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করে, শোষণ বঞ্চনা নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, এ-সবের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করে। কোথায় তাদের সেই ভূমিকা? সমাজকর্মী হিসাবে গড়ে তোলার পরিবর্তে এই নেতারা তো তাদের সমাজবিরোধী হিসাবে গড়ে তুলছেন। ভোট-সর্বস্ব দলগুলি ডান-বাম নির্বিশেষে যে যখন ক্ষমতায় থেকেছে এই রাজনীতিরই চর্চা করে চলেছে। গত পঞ্চাশ বছরের ভোট রাজনীতির ইতিহাস দেখলে কংগ্রেস-সিপিএম সব আমলেই এই রাজনীতির পুনরাবৃত্তি দেখতে পাওয়া যাবে।
আজ দেশ তথা সমাজের যে বিষময় পরিণতি, তা কি এই সব নেতাদের নীতিহীন, লোভী, স্বার্থপর আচরণের জন্যই নয়? এদের হাতে দেশের ভবিষ্যতের ভার ছেড়ে দিয়ে জনগণ কি আদৌ নিশ্চিন্ত থাকতে পারে? সেই ভবিষ্যতে তবে আশা করার কিছু থাকে কি? সমাজসচেতন প্রতিটি মানুষকে আজ এগুলি ভেবে দেখতে হবে।
আজ যে-সব যুবক এই সব নেতাদের হাতে এ ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছেন, তাঁদেরও কথাগুলি গভীর ভাবে ভেবে দেখতে হবে যে, তাঁরা এ ভাবে এই নীতিহীন অসৎ নেতাদের হাতের পুতুল হিসাবে ব্যবহৃত হবেন, নাকি প্রকৃত যুবকের মতো মর্যাদার জীবন বেছে নেবেন! টাকার বিনিময়ে অন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াবেন, অন্যায় করবেন, নাকি সাহসের সাথে অন্যায়ের মোকাবিলা করবেন! মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছেন, প্রকৃত যুবক আমরা তাকেই বলি, যার মর্যদাবোধ আছে, লড়বার তেজ আছে এবং যে অন্যায়ের মোকাবিলা করার সাহস রাখে।
যুব সমাজের পাশাপাশি সমাজের সমস্ত স্তরের সাধারণ মানুষকেও আজ ভাবতে হবে, এই দলগুলিরই একটির বদলে আর একটিকে ক্ষমতায় বসিয়ে এই ভয়ঙ্কর দুরবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। তার কারণ, এই দলগুলি আজ যে রাজনীতির চর্চা করে সেই বুর্জোয়া রাজনীতি আজ আদর্শ হিসাবে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে গেছে, পচে গেছে। এই রাজনীতি আজ আর দেশের ছাত্র-যুব সমাজকে আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে পারে না, মর্যাদাবোধ দিতে পারে না, সমাজের, মানুষের মুক্তির জন্য লড়াইতে এগিয়ে দিতে পারে না। তাই এই রাজনীতি আজ প্রাণ দিতে শেখায় না, প্রাণ নিতে শেখায়। এই রাজনীতি আজ সমাজের জন্য ত্যাগ করতে শেখায় না, ব্যক্তিগত স্বার্থে সামাজিক সম্পত্তি লুঠ করতে শেখায়। এই দুষ্ট রাজনীতি যে মানুষ গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে– কমরেড শিবদাস ঘোষের এই বক্তব্য আজ অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হচ্ছে। তাই যতদিন এই ভোট-রাজনীতি টিকে থাকবে ততদিন এ ভাবে একটার পর একটা ভোট আসবে আর এই দলগুলির নেতারা তাদের দুষ্ট রাজনীতির দ্বারা ছাত্র-যুবকদের একটা অংশকে কলুষিত করতে থাকবে, সমাজবিরোধী হিসাবে তৈরি করবে। নতুন করে আরও এক দল ছাত্র-যুবক ক্রিমিনালে পরিণত হবে। আজ এই মারণ-রাজনীতির হাত থেকে যদি ছাত্র-যুব সমাজকে বাঁচাতে হয়, যদি আমাদের নিজেদের সন্তানদের বাঁচাতে হয় তবে এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে, এই দুষ্ট রাজনীতির বিরুদ্ধে যারা লড়াই করছে সেই জনস্বার্থের রাজনীতিকে, গণআন্দোলনের রাজনীতিকেই শক্তিশালী করতে হবে– যে রাস্তা দেখিয়েছেন মার্ক্সবাদী নেতা শিবদাস ঘোষ।