Breaking News

ভোটসর্বস্ব দলগুলির প্রচারে জনস্বাস্থ্যের ঠাঁই নেই

ভোটে বক্তৃতার কমতি নেই, কিন্তু সাত দফা নির্বাচনে প্রায় শোনাই গেল না, দলগুলো জনস্বাস্থ্য নিয়ে কে কী ভাবছে! একমাত্র এস ইউ সি আই (সি) ছাড়া আর কেউ বিষয়টি নিয়ে কোনও কথাই বলছে না। নরওয়ের অসলো ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় এবং সুইডেনের লিনিয়াস ইউনিভার্সিটির ইতিহাস গবেষক এলেনর মারকুসেন ৯ মে ‘এই সময়’ পত্রিকায় এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনে জনস্বাস্থ্যকে কোনও ইস্যুই করে না। তাঁরা লিখেছেন, বিধানসভা বা লোকসভা, কোনও ভোটেই স্বাস্থ্য নিয়ে তেমন আলোচনা শোনা যায় না। লোকনীতি নামে একটি গবেষণা সংস্থার তথ্য উদ্ধৃত করে তাঁরা লিখেছেন, ভোটারদের মাত্র এক শতাংশ স্বাস্থ্য পরিকাঠামো উন্নতির ইস্যুকে ভোটের ইস্যু হিসেবে দেখেন।

কেন এই চিত্র? যে দেশে শহরের ৭০ শতাংশ মানুষ ও গ্রামের ৬৩ শতাংশ মানুষ বেসরকারি চিকিৎসার উপর নির্ভরশীল এবং চিকিৎসা করাতে গিয়ে তাদের বিপুল অর্থসঙ্কটে পড়তে হয়, যে দেশে চিকিৎসা করাতে গিয়ে বিরাট অংশের মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে চলে যায়, সেই দেশে ভোটে স্বাস্থ্য পরিষেবা নির্বাচনে অন্যতম প্রধান ইস্যু হয় না কেন?

যদিও সমীক্ষকরা বা বিশ্লেষকরা যদি এস ইউসিআই(সি) দলের নির্বাচনী বুকলেট, ভোটের প্রচার বা সারা বছরের আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করতেন তা হলে দেখতে পেতেন, এই দলটি জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে আন্দোলন করে এবং নির্বাচনে এগুলিকে ইস্যু করে লড়ে। সমীক্ষকরা এটা দেখতে পেলেন না এটা সমীক্ষার একটি ত্রুটি বটে, কিন্তু সমীক্ষকরা যে সিদ্ধান্ত করেছেন সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এই নিষ্ক্রিয়তার কারণ অনুসন্ধানও জরুরি।

এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয়, বিভিন্ন জাতীয় বা আঞ্চলিক দল তা দক্ষিণপন্থী বা বামপন্থী যাই হোক না কেন, জনস্বাস্থ্যকে নির্বাচনের ইস্যুই করে না। প্রতিটি সরকারের লক্ষ্য থাকে তাদের জনবিরোধী শাসন থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘোরানোর। তাই তারা হাতিয়ার করে একে অপরের দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো, নাগরিকত্ব, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জাতীয়তাবাদ, অনুপ্রবেশ ইত্যাদি বিষয়কে। সংবাদমাধ্যমগুলিও মেরুকরণ ঘটাতে এগুলিরই প্রচার করে। আর সে সব শুনতে শুনতে বিরাট অংশের মানুষ সাময়িকভাবে ভুলে যায় তাদের জীবনের আসল সমস্যাগুলি। কাকে হারিয়ে কাকে জেতাবো– এই হয়ে যায় মূল ভাবনা। এই ভাবে জনমতকে জনস্বার্থ থেকে বিচ্যুত করে দেওয়া হয়। এই অবস্থাতেও বেকারত্বের কথা যতটুকু প্রচারে আসে সেটা বুঝিয়ে দেয় বাস্তবে অর্থনৈতিক সঙ্কট কত গভীরে।

প্রতিবেদকরা উল্লেখ করেছেন কেন্দ্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বরাদ্দ বৃদ্ধি তো দূর, উল্টে কোভিড-পরবর্তী সময়ে বরাদ্দ কমিয়েছে মোদি সরকার। ২০০৩ সালে প্রকাশিত তালিকায় স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বিশ্বের ভারতের স্থান ১১২ তম। এতেই বোঝা যায় কংগ্রেস থেকে বিজেপি– একের পর এক সরকার স্বাস্থ্যকে কত গুরুত্বহীন করে দিয়েছে! কেন এমন করল? আসলে সরকারের নীতি হল স্বাস্থ্যব্যবস্থার সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণ। এতে সরকারের কাঁধে জনগণকে স্বাস্থ্য পরিষেবা জোগানোর দায় থাকবে না। দ্বিতীয়ত, সরকার যার রাজনৈতিক ম্যানেজার হয়ে কাজ করে, দেশের সেই পুঁজিপতি শ্রেণি পুঁজি বিনিয়োগের জায়গা পাবে। জনগণকে শোষণ করে মুনাফার পাহাড় বানাতে পারবে। এসইউসিআই(সি) বাদে বাকি সব দলই এই নীতির অনুসারী। সিপিএম ও তার সহযোগী বাম দলগুলি ক্ষমতার বাইরে থাকলে বেসরকারিকরণের বিরোধিতা করে, স্লোগান দেয়, আর ক্ষমতায় গেলে পৃষ্ঠপোষক বনে যায়। ফলে এরাও জনস্বাস্থ্য নিয়ে উচ্চস্বরে কিছু বলে না। আর সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক চেতনার অভাবে ভাবতে থাকেন, যে দলের সরকারে আসার সম্ভাবনা বেশি, সেদিকে থাকাই ভাল।

ভোট একটা রাজনৈতিক সংগ্রাম। এখানে ঠিক-বেঠিক রাজনীতি চিনতে না পারলে বার বার মানুষকে ঠকতে হয়। জনগণ তার নিজের লাভ-ক্ষতি বুঝে নিতে পারে তখনই যখন সঠিক বিপ্লবী বামপন্থী রাজনীতির শক্তি বড় হয়ে দাঁড়ায়। এই শক্তিকে বড় করাটাই নির্বাচনে জনগণের আসল দায়িত্ব।