70 Year 33 Issue 6 April, 2018
রামনবমী উদযাপনকে ঘিরে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি এবং রাজ্যের শাসক তৃণমূল মার্চের শেষ সপ্তাহ জুড়ে গোটা বাংলায় যেভাবে ‘রামভক্তি’র কুস্তি লড়াই করল তাতে কি ধর্ম বলে কিছু ছিল? ছিল কি বিন্দু পরিমাণ ভক্তি? রামভক্তির নামে ওরা নিরীহ মানুষের প্রাণ নিল, তাতে বাংলা রক্তাক্ত হল, বহু দোকান–পাট, বাড়ি ভাঙচুর হল, লুটপাট চলল, অগ্নিসংযোগ হল৷ প্রাণ হারালেন তিন জন৷ একজন কাঁকিনাড়ার, একজন পুরুলিয়ার, আরেক জন রানিগঞ্জের৷ তাঁদের মধ্যে হিন্দু এবং মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষই রয়েছেন৷ ওদের হিন্দুত্ব হিন্দুর প্রাণ কাড়ল, প্রাণ কাড়ল সদ্য মাধ্যমিক দেওয়া মুসলিম পরিবারের এক নিরপরাধ সন্তানের৷ শত শত মানুষ জখম হলেন৷ দু’দলের ধর্ম–গুন্ডাদের তাণ্ডবে আসানসোল রানিগঞ্জ এত অশান্ত হয়ে উঠেছিল যে, সেখানকার ২১৮ জন ছাত্রছাত্রী উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসতেই পারল না৷ এই ছাত্রছাত্রীদের অপরাধ কী ছিল? কার অপরাধে এদের শিক্ষাজীবনে বিপর্যয় নেমে এল?
কী করছিল প্রশাসন? কোথায় ছিল তারা? বিজেপির রাজ্য সভাপতি ধর্মের ভক্তিভাব ছেড়ে অস্ত্র নিয়ে গত বছরের মতো উন্মত্ত আস্ফালনী মিছিলের হুঙ্কার তো ক্রমাগত দিয়েই যাচ্ছিলেন, পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি কেন? পুলিস নিষ্ক্রিয় ছিল কি এই কারণেই যে, তৃণমূলের মন্ত্রীরা সাংসদরাও অনুরূপ মিছিলের আয়োজক ছিলেন? ওদের প্রতিযোগিতামূলক হিন্দুত্বের উন্মত্ততা সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পত্তি ধ্বংস করল৷ কোথায় প্রশাসন বা সরকারের রক্ষকের ভূমিকা? আজ তৃণমূল সরকার বলছে ঝাড়খণ্ড থেকে অস্ত্র এবং গুন্ডা আমদানি করেছে বিজেপি৷ যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে সরকারের গোয়েন্দা দপ্তর কী করছিল? তারা কি ঘুমিয়েছিল? আগাম জানায়নি কেন? জানিয়ে থাকলে সরকার এই নৈরাজ্য কঠোর ভাবে মোকাবিলা করেনি কেন? এ প্রশ্ন উঠছে, বিজেপির এই রাম–উন্মাদনার মোকাবিলায় তৃণমূল যে দূর্বলতার পরিচয় দিল তা কি হিন্দুত্বের ব্যাটন নিজ হাতে রাখবে বলেই? হিন্দুত্বের পাল্টা অস্ত্রে কি বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মোকাবিলা করা সম্ভব? এর দ্বারা কি বাস্তবে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার পালে হাওয়া দেওয়া হবে না? তৃণমূল এবং বিজেপির হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার লড়াইতে বাংলার শান্তি সম্প্রীতি কি সাংঘাতিক ভাবে বিপন্ন হচ্ছে না? দুই ভোটবাজ দলের সংঘাতে বাংলার জনগণ কি শুধু উলুখাগড়ার মতো প্রাণ দেবেন? হিন্দুত্ব যেমন বিজেপির কাছে ধর্ম নয়–ভোটের তাস, তেমনি তৃণমূলের কাছেও৷ সাম্প্রতিক কুস্তি ও রক্তপাত সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল৷
তৃণমূলের এই হিন্দুত্বের ভেকধারণ রাজ্যের সম্প্রীতির পরিবেশও বিপন্ন করছে৷ পুরোহিত সম্মেলন, ব্রাহ্মণ সভা, রামনবমীর আড়ম্বর, হনুমান জয়ন্তীর রমরমা ইত্যাদি হিন্দুত্ববাদী অনুষ্ঠানে তৃণমূল বিজেপির সমকক্ষ হওয়ার দৌড়ে যত মেতে উঠছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তত বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন৷ কারণ এতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ছে৷ তৃণমূলের নেতা কর্মী সমর্থক ও প্রভাবিত জনগণের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক ভাবনার প্রভাব পড়ছে৷ বিজেপি তো মুসলিম বিদ্বেষের বিষ ক্রমাগত ছড়াচ্ছেই৷
এই অবস্থায় যারা যথার্থ সৎ ধর্মপ্রাণ মানুষ তাঁরা অপর ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষকে আক্রমণ করার কথা ভাবতে পারেন না৷ ধর্ম থাকুক ধর্মবিশ্বাসীর ব্যক্তিগত পরিসরে৷ রাজনীতিতে, সরকার পরিচালনায়, প্রশাসনে, শিক্ষায় ধর্ম আসবে কেন? সরকারকে কঠোরভাবে এই অবস্থানে থাকতে বাধ্য করতে হলে নাগরিক সমাজের ভূমিকা আরও বেশি দরকার৷
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যতটুকু ঐতিহ্য এই পশ্চিমবঙ্গ বহন করত, ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির দৌলতে তা ভাঙতে চলেছে৷ যে কোনও মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়াকে যারাই মূল আদর্শ করে ফেলেছে, তারাই রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে আনছে, ধর্মের ভিত্তিতে ভোটব্যাঙ্ক তৈরির জন্য৷ সাম্প্রদায়িকতা মানুষের জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনলেও এইসব গদিসর্বস্ব দলগুলির কাছে তা পৌষমাস৷ তথ্য বলছে, ২০১১ থেকে ২০১৪ পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবছর গড়ে ২০টি করে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ঘটেছে৷ ৩০ মার্চ ‘দি হিন্দু’ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে দেখা যাচ্ছে ২০১০ সালে রাজ্যে সিপিএম শাসনে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ঘটেছে ২০টি, মারা গেছেন ৬ জন৷ ২০১১ সালে রাজ্যে পালা বদলের বছরে, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ২০–র কিছুটা নিচে নামলেও ২০১২ ও ২০১৩ তে বেড়ে যায়৷ ২০১৪ সালে কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর অন্যান্য রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেও তারা দলীয় প্রভাব বিস্তারে নজর দেয়৷ তারপর থেকেই পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এক লাফে অনেকটাই বেড়ে যায়৷ উক্ত সংবাদে দেখা যাচ্ছে, ২০১৫ সালে নথিভুক্ত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের সংখ্যা ২৭টি, মৃত ৫, জখম ৮৪ জন৷ ২০১৬ সালে নথিভুক্ত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৩২৷ ২০১৭ সালে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৫৮, মৃত ৯, জখম ২৩০ জন৷
২০১৫–২০১৭ এই তিন বছরে মোদি শাসনে সারা দেশে নথিভুক্ত দাঙ্গা ঘটেছে ২,২৭৬টি৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাঙ্গা ঘটেছে বিজেপি শাসিত রাজ্যে৷ কারণ সাম্প্রদায়িকতা তাদের ভোটে জেতার হাতিয়ার৷ তাই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের সামান্য আঁচ পেলেই বিজেপি ঝাঁপিয়ে পড়ে আগুন জ্বালাবার জন্য৷ বাস্তবে ভোটবাজ দলগুলির সাথে সাম্প্রদায়িকতার অবিচ্ছেদ্য মেলবন্ধন ঘটে গিয়েছে৷ এই অবস্থায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করতে হলে যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার প্রভাব দ্রুত বিস্তার করতে হবে৷ যথার্থ বামপন্থীরা, যথার্থ কমিউনিস্টরা যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার শক্তি৷ এর বাইরেও বিপুল সংখ্যক গণতন্ত্রপ্রিয়, উদারনৈতিক চিন্তাশীল ব্যক্তিরা আছেন, রয়েছেন কোটি কোটি সাধারণ মানুষ, এক্ষেত্রে তাঁদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে৷
হিন্দু–মুসলমান–খ্রিস্টান-জৈন নির্বিশেষে সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে, শাসকরা জনগণকে ধর্মীয় সংঘর্ষে মাতিয়ে দিতে চায় নিজেদের গদি রক্ষার মতলবে৷ জীবনের মূল সমস্যা ও সংকটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গরিব, মেহনতি মানুষের যে ঐক্য জরুরি শাসকরা তা ধ্বংস করতে চায়, এই মতলব বুঝে নিজেদের রক্ষায় জনগণকেই সজাগ ও সতর্ক হতে হবে৷