আবার প্যারোলে মুক্তি পেলেন হরিয়ানার ধর্মগুরু গুরমিত রাম রহিম। গত পাঁচ বছরে এই নিয়ে তিনবার জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার সুযোগ মিলে গেল দুটি খুন আর আশ্রমবাসী তরুণীদের ধর্ষণে অভিযুক্ত এই ভণ্ড ধর্মগুরুর। গত দু’বারের মতো এবারেও ঠিক ভোটের মুখেই জেল থেকে ছাড়া হল তাঁকে।
হরিয়ানার রোহতকের জেল থেকে ১৫ অক্টোবর ৪০ দিনের জন্য ছাড়া পেয়়েছেন রাম-রহিম। কারণ, অক্টোবরের শেষ আর নভেম্বরের প্রথমে হরিয়ানায় পঞ্চায়েত ও জেলা পরিষদের ভোট। সঙ্গে রয়েছে একটি বিধানসভা উপনির্বাচন। এ জন্য বিজেপি নেতাদের ভীষণ প্রয়োজন তাঁকে। ওই রাজ্য সহ লাগোয়া পাঞ্জাব ও হিমাচল প্রদেশ জুড়ে রাম-রহিমের প্রভাব যথেষ্ট। তাই এই ভণ্ড ধর্মগুরুকে কাজে লাগিয়ে ভোটে ফয়দা তুলতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন হরিয়ানার বিজেপি নেতারা। ‘বাবা’-র আশীর্বাদ পেতে হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। প্রতিদিন ‘বাবা’র ‘সৎসঙ্গ’ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তাঁর ভজনা চলছে। নিজের নিজের এলাকায় নিয়ে গিয়ে যাতে রাম-রহিমের পদধূলি বিলানো যায়, সেই চেষ্টা করছেন ভোটপ্রার্থী বিজেপি নেতারা, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিজেপি সরকারের ডেপুটি স্পিকার থেকে শুরু করে করনালের মেয়র পর্যন্ত। এই মেয়র তো পরিষ্কার বলেছেন– ‘পিতাজি-ই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। তাঁর আশীর্বাদ ছাড়া কিছুই হওয়ার নয়।’
হরিয়ানায় বিজেপির অন্যতম নেত্রী এই মেয়র যাঁকে অবলীলায় ভক্তিভরে ‘পিতাজি’ বলে সম্বোধন করেছেন, তাঁর অপরাধের তালিকা দেখলে অবশ্য আঁতকে উঠতে হয়। আশ্রমে আশ্রয় নেওয়া অসহায় তরুণীদের উপর প্রতি রাতে যৌন-অত্যাচার চালাতেন রাম-রহিম। প্রভাবশালী এই লম্পট ধর্মগুরুর বিরুদ্ধে পুলিশ-প্রশাসনে অভিযোগ করে লাভ হবে না জেনে দীর্ঘদিন মুখে বুজে সেই অত্যাচার সয়েছেন তাঁরা। অবশেষে সহ্যের চরম সীমায় পৌঁছে ২০০২ সালে আশ্রমে ‘বাবা’-র লাগাতার অত্যাচারের শিকার এক তরুণী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি নামহীন চিঠি লেখেন। নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয় পুলিশ-প্রশাসন। মামলা দায়ের হয়। মেয়েটির পাশে দাঁড়ান আরও এক নির্যাতিতা। এগিয়ে আসেন আশ্রমবাসী এক কন্যার ভাই রণজিৎ সিং। চলতে থাকে আদালতে হাজিরা দেওয়ার পালা। পাশাপাশি চলতে থাকে ‘বাবা’র সাঙ্গপাঙ্গদের হুমকি, সন্ত্রাস। ২০০২ সালে খুন হয়ে যান রণজিৎ সিং। হরিয়ানার অসমসাহসী সাংবাদিক রামচন্দ্র ছত্রপতি যিনি স্থানীয় সংবাদপত্রে এই ধর্মগুরুর ভণ্ডামির পর্দা ফাঁস করে দিয়েছিলেন, খুন করা হয় তাঁকেও। তা সত্ত্বেও লড়াই জারি রেখেছিলেন অত্যাচারিতা তরুণীরা। শেষপর্যন্ত ২০১৭ সালে রাম-রহিমকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যখনই ভোটের ঢাকে কাঠি পড়ছে, তখনই হাসিমুখে জেল থেকে বেরিয়ে আসছেন রাম-রহিম। গরিবি, বেকারি, শিক্ষার অভাবে অসচেতন, কুসংস্কারগ্রস্ত জনসাধারণের উপর এই প্রতারক ধর্মগুরুটির যে প্রভাব রয়েছে, তাকে কাজে লাগিয়ে ভোট লুটতে নেমে পড়ছেন বিজেপি নেতারা। এর আগে একই ভাবে রাম-রহিমকে কাজে লাগিয়েছে কংগ্রেস। ২০০৭-এ পাঞ্জাব বিধানসভা ভোটে খোলাখুলি কংগ্রেসকে সমর্থন করেছিল তাঁর সংগঠন ডেরা সাচা সওদা। ২০১৪ সালের পর থেকে এই ভেকধারী সাধু বিজেপির সমর্থক বনে যান। সে বছরের লোকসভা ও হরিয়ানা বিধানসভা ভোটে বিজেপি এঁর আশীর্বাদ পেয়েছিল। সেই থেকে এই লম্পট, প্রতারক ভণ্ড সাধুর নির্লজ্জ পদসেবায় ব্যগ্র হয়ে রয়েছেন বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা। যখনই ভোট আসছে, বিনা বাধায় জেল থেকে বেরিয়ে আসছেন রাম-রহিম।
প্রথমবার ২০২০-র ফেব্রুয়ারিতে পাঞ্জাবে বিধানসভা নির্বাচন শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে প্যারোলে মুক্তি পান রাম-রহিম। এরপর হরিয়ানার ৪৬টি পৌরসভায় নির্বাচনের ঘন্টা বাজলে আবার ছুটি দেওয়া হয় তাঁকে।
এবারও হরিয়ানার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের ঠিক আগে ১৪ অক্টোবর তৃতীয়বার জেল থেকে ছাড়া পেলেন তিনি। দেশের ভোট-রাজনীতির খেলোয়াড়দের এই হল আসল চেহারা। গরিব সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা, অজ্ঞানতা, অন্ধ বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে যেমন চরম প্রতারণা করছেন এই দুশ্চরিত্র সাধু, তেমনই ক্ষমতার লোভে নির্লজ্জের মতো তাঁরই পদসেবা করে চলেছেন এইসব নীতিহীন, ক্ষমতালোভী রাজনীতিকরা।