ভেজাল ওষুধ এবং অত্যন্ত নিম্নমানের ওষুধে ভারতের বাজার কী ভাবে ছেয়ে গেছে তার সংবাদ সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এর কারণটা কি কেবল ভেজাল নিয়ন্ত্রণে সরকারের সদিচ্ছার অভাব, নাকি সরকার এবং প্রশাসনের মদতেই রমরমিয়ে চলছে এই মারণ-চক্র?
সম্প্রতি মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজে পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির স্যালাইন রিঙ্গারস ল্যাক্টেট এর বিষক্রিয়ায় এক প্রসূতির মৃত্যু ঘটল। সাসপেন্ড করা হয় এক ডজন চিকিৎসককে। অথচ ওই ওষুধ কোম্পানিকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করা হল না, শাস্তি দেওয়া তো দুর অস্ত। এর বিরুদ্ধে তীব্র জনরোষ ফেটে পড়ল। মেডিকেল সার্ভিস সেন্টার, সার্ভিস ডক্টরস ফোরাম, হাসপাতাল ও জনস্বাস্থ্য রক্ষা সংগঠন ইত্যাদি সংগঠনের তীব্র আন্দোলনের ফলে সরকার বাধ্য হয় ওই কোম্পানির ওষুধ নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে। অথচ ২০২৪ এর ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে উক্ত স্যালাইন কর্ণাটক রাজ্য সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। সেখানেও ওই স্যালাইনের বিষক্রিয়ায় প্রসূতি মৃত্যু হয়েছিল। সংবাদে প্রকাশ, কর্ণাটক সরকার এই ঘটনা জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে সতর্ক করেছিল। তা সত্ত্বেও ওইসব ভেজাল ওষুধ রমরমিয়ে এ রাজ্যে চলছে।
এর সঙ্গে দোসর হয়েছে নিম্নমানের ওষুধ। অর্থাৎ যতটা পরিমাণে ওষুধের উপাদান থাকার কথা তার থেকে কম পরিমাণে এবং নিচু মানের হওয়ার ফলে বহু ওষুধে রোগ সারছে না। কম মাত্রার উপাদানযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের ফলে সেগুলি রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যাচ্ছে। নামীদামি ওষুধ কোম্পানিগুলির ক্ষেত্রেও এই ঘটনা ঘটছে। এর ফল মারাত্মক আকারে দেখা দিচ্ছে।
ওষুধ ব্যবসায়ে সরকারি বদান্যতায় উৎপাদনের ওপর ৩০০ শতাংশ থেকে ৩০০০ শতাংশ পর্যন্ত লাভ করে থাকে ওষুধ কোম্পানিগুলো। এরপরেও ওষুধে ভেজাল মিশিয়ে বা ওষুধের মান নামিয়ে মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা আকাশ ছোঁয়া মুনাফা করছে। স্পষ্ট যে, মুনাফার কাছে মানুষের জীবন, বাঁচা-মরা, নীতি-নৈতিকতা মূল্যবোধ এ সব অর্থহীন।
সরকারের অদক্ষ পরিচালনা
দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি ভেজাল ওষুধ ভারতে রমরমিয়ে চলছে। বর্তমানে তা আরও বেড়েছে। প্রথমত ওষুধের গুণমান পরীক্ষা করার জন্য উপযুক্ত সংখ্যক ল্যাবরেটরি দেশের কোনও রাজ্যেই নেই। যেটুকু আছে সেগুলিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক টেকনিশিয়ান নেই এবং যন্ত্রপাতি মান্ধাতার আমলের। ওইসব যন্তে্রর দ্বারা ওষুধের পরিমাণগত দিক কিছুটা অর্থে দেখা সম্ভব হলেও, ওষুধে অন্য কোনও ভেজাল আছে কি না বা কোনও ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু আছে কি না তা নির্ণয় করার মতো ল্যাবরেটরি দেশে খুব কমই আছে। ল্যাবরেটারিতে গুণমান পরীক্ষার জন্য ওষুধ পাঠানোর পরে রিপোর্ট আসতে ছ’মাস থেকে এক বছরেরও বেশি সময় লেগে যায়। নিয়ম অনুযায়ী গুণমান পরীক্ষার রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত ওষুধ ব্যবহার করার কথা নয়। কিন্তু বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে তার আগেই ওইসব ওষুধ ব্যবহৃত হয়ে যাচ্ছে। ফল ভোগ করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
দ্বিতীয়ত, মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ ৯০ দিনের মধ্যে কোম্পানিতে ফেরত দেওয়ার কথা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ওইসব ওষুধ ঘুরপথে চোরা কারবারিদের হাতে পৌঁছায় এবং তা রিসাইক্লিং হয়ে নতুন মোড়কে বাজারে ফেরত আসে।
তৃতীয়ত, বর্তমানে রাজ্যগুলো ওষুধের ওপর জিএসটি চালু করার ফলে আশেপাশের রাজ্য থেকে অনামি কোম্পানি থেকে নিম্নমানের ওষুধ বিভিন্ন রাজ্য কেনে, যা মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরে ওই সব কোম্পানিতে ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। এইসব নিম্নমানের ওষুধ মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও প্যাকেজ পরিবর্তন করে ব্যবহৃত হতে থাকে।
চতুর্থত, কেন্দ্রীয় ড্রাগ কন্ট্র্ল দপ্তর থেকে আচমকা ভিজিটের ফলে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন হোলসেল মার্কেটেও এমন কিছু ওষুধের প্যাকেট পাওয়া গেল, যার মধ্যে নামিদামি কোম্পানির ওষুধের সাথে অনামী এবং ভেজাল ওষুধ মেশানো আছে। এ একটা ভয়ংকর প্রবণতা।
আরজিকর মেডিকেল কলেজে কর্তব্যরত তরুণী চিকিৎসকের নৃশংসতম খুন এবং ধর্ষণের ঘটনার পেছনেও জাল ওষুধের কারবারই উঠে এসেছে। ওই কলেজেরই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি সরকারি সরবরাহের মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধগুলো প্যাকেজ বদলে দিয়ে বাজারে ছাড়ছিলেন। তার মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক, স্যালাইন সহ বিভিন্ন জীবনদায়ী ওষুধও ছিল। এই চক্রে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার পরিণতিতেই ওই তরুণী চিকিৎসককে প্রাণ দিতে হল, এমন অভিযোগ সর্বত্রই উঠেছে।
ভেজাল ওষুধ নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদাসীনতা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণটি অবশ্য স্পষ্ট। গত লোকসভা নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করেছিল– ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে ৩৫টি ওষুধ উৎপাদনকারী সংস্থা বিজেপি, তৃণমূল সহ বিভিন্ন দলকে নির্বাচনী তহবিলে অনুদান হিসেবে ২০ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। এর মধ্যে সাতটি বৃহৎ কোম্পানি রয়েছে যাদের উৎপাদিত ওষুধ গুণমান পরীক্ষায় ফেল করার পরে তারা ওইসব বন্ড কেনে এবং যথারীতি ওইসব ওষুধ এক অদৃশ্য জাদুবলে বাজারে চলতে থাকে।
দায়ী সরকারি নীতি
১৯৬০ পর্যন্ত এ দেশে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে ছিল। কারণ ওই সময় পর্যন্ত এ দেশে গড়ে ওঠা ওষুধের জাতীয় শিল্প যেমন বেঙ্গল কেমিক্যাল, বেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যাল, আইডিপিএল, হিন্দুস্থান অ্যান্টিবায়োটিকস, বেঙ্গল ইমিউনিটি ইত্যাদি কোম্পানিগুলো থেকে উন্নত মানের এবং প্রচুর পরিমাণে ওষুধ তৈরি হত যা সুলভে পাওয়া যেত। ১৯৯১ সালে কংগ্রেস পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের নীতি গ্রহণ করে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯৫ সালে এ দেশে জাতীয় ভেষজ নীতি চালু হয়। জাতীয় ওষুধ শিল্পগুলোকে ক্রমশ রুগ্ন করে দেওয়া হয়। যার পরিণতিতে বর্তমানে বেঙ্গল কেমিক্যাল টিম টিম করে চললেও বাকি ওষুধ কোম্পানিগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেশীয় বেসরকারি ওষুধ কোম্পানিগুলোর মুনাফা সুনিশ্চিত করা এবং ২০০০ সাল থেকে ওষুধের বাজার আরও খুলে দেওয়ায় বিদেশি কোম্পানিগুলো এ দেশে ব্যবসা করতে ঢুকে পড়ে এবং ভারত সরকার এফডিআই তথা ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট চালু করে এবং বিদেশি বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা ১০০ শতাংশ করে দেওয়া হয়। যার প্রভাব প্রত্যক্ষ ভাবে ২০০২ সালের নতুন জাতীয় ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং পলিসির উপরে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আমেরিকা সফরের আগে ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণের সরকারি নীতি ডিপিসিও-২০১৩ অর্থাৎ ড্রাগ প্রাইস কন্টে্রাল অর্ডারের উপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনেন। আগে যেখানে ৩৪৮টি ওষুধ মূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতায় ছিল তার মধ্যে ১০৮টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের উপর থেকে সরকারি মূল্য নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া হয়। এগুলির মধ্যে হার্ট, ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারের এবং গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিবায়োটিক ও জীবন দায়ী ওষুধ রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার বছরে বছরে কোম্পানিগুলোকে ওষুধের দাম বাড়ানোর সুযোগ করে দেয়। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার ড্রাগ প্রাইসিং অথরিটির মাধ্যমে ৭৪৮টি ওষুধের বাজার মূল্য প্রায় দুই শতাংশ হারে বাড়ানোর অনুমতি দিয়ে দিল। ওষুধের বাজার মূল্য ২০২২ এবং ‘২৩ সালে যথাক্রমে ১০ এবং ১২ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছিল। ২০২৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ওষুধের বাজার মূল্য সম্পূর্ণরূপে বিনিয়ন্ত্রিত করে দিল। অর্থাৎ বর্তমানে ওষুধের মূল্য পুরোপুরি ওষুধ কোম্পানিগুলোই নির্ধারণ করতে পারবে। এই ভাবে সরকার হাত গুটিয়ে নিয়ে কোম্পানিগুলিকে ইচ্ছামতো দাম বাড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে। অন্য দিকে প্রয়োজনীয় ওষুধের মাত্র ১৬ শতাংশ ওষুধ সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগীরা পেয়ে থাকেন। বাকিটা বাজার থেকে কিনতে হয়।
ফলে ওষুধের পেছনে খরচ করতে গিয়ে বহু মানুষ আজ সর্বস্ব খোয়াচ্ছেন। তথ্য বলছে, ভারতে চিকিৎসার জন্য যা খরচের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ খরচই ওষুধের জন্য হয়ে থাকে। চিকিৎসার খরচ মেটাতে ৪০ শতাংশ রোগীর পরিবারকে তীব্র আর্থিক ও মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হয়। ২৫ শতাংশ মানুষ এপিএল স্তর থেকে বিপিএল স্তরে নেমে যায়। এর পুরো দায় ‘জনসেবক’ সরকারের।
জরুরি কর্তব্য
এর থেকে পরিত্রাণের কি কোনও উপায় নেই? কিছু উপায় অবশ্যই আছে– ১) হাতি কমিটির সুপারিশ মেনে ব্র্যান্ড নামে ওষুধ উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। জীবন দায়ী এবং অত্যাবশ্যকীয় সমস্ত ওষুধকে মূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে হবে। ২) রাষ্ট্রায়ত্ত ওষুধ শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে এবং জীবন দায়ী ও বেশিরভাগ অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ সরকারি ওষুধ কারখানা থেকেই তৈরি করতে হবে। ৩) ওষুধ কোম্পানিগুলির লাভের সীমা বেঁধে দিতে হবে। ৪) জীবনদায়ী এবং অত্যাবশ্যকীয় ওষুধগুলি সরাসরি হাসপাতাল/স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ করতে হবে। ৫) ওষুধের গুণমান দেখার ব্যবস্থা জোরদার করতে উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি এবং উপযুক্ত সংখ্যক কর্মীনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু সরকার নিজে এমন উদ্যোগ নেবে না। তাকে এ কাজে বাধ্য করতে সর্বত্র জনস্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এ কাজে নাগরিক সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া ড্রাগ মাফিয়াদের অতিমুনাফার থাবা থেকে মানবসমাজকে রক্ষা করার আর কোনও উপায় নেই।