অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের E=mc2 সূত্র থেকে আরও উন্নত তত্ত্ব রয়েছে বেদে– বলেছেন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং৷ সত্যি নাকি চমকাবেন না এইরকম তথ্যই ঘুরে বেড়িয়েছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়৷ ছড়িয়েছেন বিজেপির এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী৷ কোথায় রয়েছে এমন তথ্য– জানতে চাইলে তিনি পাশ কাটিয়েছেন৷ বোঝাই যায় বিজেপির নেতাদের লক্ষ্য– জনমানসে যাতে বিচার–যুক্তির জায়গা দখল করে অন্ধবিশ্বাস৷
গুজবে কান দেবেন না– এই প্রবাদবাক্য বহুকালের প্রচলিত৷ অর্থাৎ শোনা কথা নয়, বিচারবুদ্ধির দ্বারা সত্য–মিথ্যা যাচাই করে না নিলে ঠকতে হয়৷ সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে দাবানলের মতো গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ যুক্তি–বুদ্ধি গুলিয়ে দিয়ে ধর্মীয় জাতপাত ইত্যাদি সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিয়ে আপাত নিরীহ কোনও মানুষকেও অপরের বিরুদ্ধে হিংস্র, উন্মত্ত করে তোলা হচ্ছে৷ কোথাও ছেলেধরা গুজবে পিটিয়ে মারার ঘটনা ঘটছে, কোথাও গোহত্যার নামে নৃশংসভাবে খুন চলছে৷ গত দুই–তিন বছরে দেশের সর্বত্র এই ধরনের ঘটনায় ইতিমধ্যেই মারা গিয়েছেন বহু মানুষ৷ ফেক নিউজ বা ফেক ভিডিও–র মাধ্যমে গুজব ছড়িয়েই এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে৷ এগুলিকে হাতিয়ার করে বিদ্বেষ জাগাচ্ছে ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী কিংবা ক্ষমতাসীন দল৷
হিটলারের প্রচার সচিব গোয়েবলসের অস্ত্র ছিল– একটা মিথ্যাকে হাজার বার বল, একদিন লোকে তাকে সত্য বলে মনে করবে৷ বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতায় বসার পর এই গোয়েবলসের কায়দাকেই গ্রহণ করেছে৷ কথা চালু করে দেওয়া হয়েছে– ‘পোস্ট ট্রুথ’৷ অর্থাৎ সত্যেরও পরের কিছু৷ কী সেটা? তা হল এমন কিছু যা শাসকরা আমাদের গেলাতে চায় তা যতবড় মিথ্যাই হোক– মানুষ মনে করবে সেটাই সত্য৷ সত্য–মিথ্যার মিশেলে আদ্যোপান্ত গাঁজাখুরি প্রচারকেও এমনভাবে এরা পরিবেশন করে যাতে মনে হয়– এটাই একমাত্র সত্য৷ ‘পোস্ট ট্রুথ’ চালাবার জন্য একদলকে রীতিমতো দায়িত্ব দিয়ে বসানো হয়েছে৷ এ কাজে বড় দক্ষ বিজেপি–আরএসএস৷ তবে অন্যরাও আছে৷
এভাবে উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে মহম্মদ আখলাককে খুন, রাজস্থানের আলওয়ারে দুধ ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে খুন সমস্ত ক্ষেত্রেই দেখা গেছে– ঘটনা ঘটানোর আগে ফেক ভিডিও এবং ভুয়ো খবর ছড়িয়ে স্থানীয় জনমতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা হয়েছে৷ মহম্মদ আখলাককে খুন করার আগে স্থানীয় মন্দির থেকে গুজব ছড়ানো হয়েছিল যে তাঁর বাড়ির ফ্রিজে গো–মাংস রাখা আছে৷ পরে জানা গেছে, মন্দিরের পুরোহিতকে এমন নির্দেশ দিয়েছিলেন বিজেপি সাংসদ সঙ্গীত সোম স্বয়ং৷ মণিপুরে কয়েকদিন আগে ফেক নিউজ ছড়িয়ে দুই যুবককে হত্যা করেছিল উন্মত্ত ধর্মান্ধরা৷ আসামেও ঘটেছে একই ধরনের ঘটনা৷ সম্প্রতি ত্রিপুরায় গুজব ছড়িয়ে পিটিয়ে হত্যা করে দুষৃক্তীরা৷ উত্তরপ্রদেশের হাপুরে এক ছাগল বিক্রেতা ও এক প্রান্তিক চাষিকে গো–হত্যাকারী বলে গুজব ছড়িয়ে পিটিয়ে খুন করে স্ব–ঘোষিত গোরক্ষকরা৷ তারপর সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁদের হত্যার নৃশংস ভিডিও তুলে ছড়িয়ে দেয়৷ কিছুদিন আগে এই পদ্ধতিতেই বসিরহাটে দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি করেছিল বিজেপি৷ সাধারণ মানুষের বাধায় তা ব্যর্থ হয়েছে৷
সারা দেশ জুড়েই এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে যে, মানুষ যুক্তিবোধটাই হারিয়ে ফেলে উন্মত্ত হয়ে উঠছে৷ যা স্বাভাবিকভাবে কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হওয়ার কথা নয়– সেই সব অসম্ভবকেও বিশ্বাস করে নরহত্যা, পিটিয়ে মারার মতো নৃশংস উন্মত্ততায় লিপ্ত হয়ে যাচ্ছে বহু মানুষ৷ ইন্ডিয়া স্পেন্ড নামে এক ওয়েব পোর্টালের সমীক্ষায় জানা গেছে, ২০১০–২০১৭ সালের মধ্যে গো–রক্ষকদের হাতে হত্যার ঘটনার ৯৭ শতাংশই বিজেপি জমানায় ঘটেছে৷ পিটিয়ে মারার ঘটনার শিকার হয়েছেন ৮৪ শতাংশ মুসলিম, ১৬ শতাংশ দলিত ও পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষ৷ গোরক্ষার নামে হিংসা মোদি জমানায় বেড়েছে ৪১৫০ শতাংশ৷ শাসকগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ অথবা প্রচ্ছন্ন মদতে এই ধরনের ঘৃণিত কাজ করেও অনায়াসেই রেহাই পেয়ে যাচ্ছে দুষ্কৃতীরা৷
সোশ্যাল মিডিয়া, হোয়াটস্যাপ, ফেসবুক আধুনিক জীবনে গোটা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে৷ এর মাধ্যমে আমোদে মেতে ওঠে মানুষ, একে মাধ্যম করে পারস্পরিক যোগাযোগও বেড়েছে৷ কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় অভ্যস্ত অনেকেই যুক্তি দিয়ে বিচার করে গ্রহণ না করার ফলে অহরহ ফেক নিউজের ফাঁদে পড়ে৷ ফেক নিউজ দেশ–কালের কোনও সীমা মানে না৷ এক দেশ থেকে অন্য দেশে, বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ফেক নিউজ কিংবা ফেক ভিডিও ভাইরাল হতে থাকে৷ নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে যুক্তি ও তথ্যকে সরিয়ে রেখে স্রেফ আবেগ দিয়ে তৈরি অসত্য তথ্য প্রচারের থেকেও ক্ষতিকারক এই ফেক নিউজ৷ সত্য, অসত্য আর অর্ধসত্যের মিশেলে তৈরি হয় এগুলি৷ এর মাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিকৃত তথ্য পরিবেশিত হয়৷ এর মাধ্যমে শাসক শ্রেণির পক্ষে জনমত তৈরি করা হয় বা তাদের স্বার্থে ব্যক্তিবিশেষের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা হয়৷
পিটিয়ে হত্যা করার মতো নৃশংস ঘটনা সারা বিশ্বেই হয়৷ কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এ ব্যাপারে ভারত এগিয়ে রয়েছে সবচেয়ে বেশি৷ দুশ্চিন্তা সেখানেই৷ কর্মসংস্থান, শিক্ষা কিংবা স্বাস্থ্যে শ্রীবৃদ্ধি না হলেও এ ধরনের ঘটনার বাড়বাড়ন্ত ঘটছে ভারতে৷ পিটিয়ে মারার কারণে গত দেড় বছরে মারা গিয়েছেন ৩৪ জন৷ সরকার এতগুলি নৃশংস মৃত্যুর পর শুধুমাত্র ভুয়ো খবর ছড়ানো বা ফরওয়ার্ড করলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা করেই দায় সেরেছে৷ হোয়াটস্যাপ কর্তৃপক্ষকেও সাবধানবাণী শুনিয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক৷ সুপ্রিম কোর্ট আবার রাজ্য সরকারগুলিকে এই বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলেছে৷ কিন্তু এতেই কি থেমে যাবে গুজব ছড়ানো? ঘটনাক্রম বলছে, না৷
বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠায় বহুদিনের মৌনব্রত ভেঙে একবার দয়া করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘মোটিভ যাই হোক, গণপিটুনি একটি অপরাধ৷’ অপরাধই যদি হয়, আর তাঁর কথা অনুযায়ী ‘দেশের প্রতিটি নাগরিকের জীবন এবং স্বাধীনতা রক্ষা করতে বিজেপি সরকার যদি দায়বদ্ধই হয়’, তাহলে স্ব–ঘোষিত গোরক্ষক যারা পিটিয়ে খুন করে ফেলছে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে, তাদের একজনেরও শাস্তি হচ্ছে না কেন? উল্টেবিজেপি–আরএসএস নেতাদের আর্শীবাদে লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছে আক্রমণ৷ না কি মোদিজি বলতে চান, গোরক্ষকরা বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত নাগরিক
সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার হরণ করে শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি৷ তার বিরুদ্ধে যাতে বিক্ষোভ–আন্দোলন দানা বাঁধতে না পারে তার জন্য শাসকরা বিভেদ সৃষ্টি করতে চায় খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে৷ ভাঙতে চায় তাদের ঐক্য৷ গুজব এবং ফেক নিউজ তার অন্যতম হাতিয়ার৷ এই অপপ্রয়াসকে রোখার একটাই পথ– মানুষের সচেতনতা৷
(৭১ বর্ষ ৯ সংখ্যা ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)