কেরালার ভিঝিনজামে মৎস্যজীবীদের উচ্ছেদ করে আদানি বন্দর স্থাপনের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ আন্দোলনে সাময়িক বিরতি ঘোষিত হয়েছে। মৎস্যজীবীদের এই আন্দোলনকে সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়েছে এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) কেরালা রাজ্য কমিটি।
বন্দর নির্মাণের লক্ষে আদানি গ্রুপের পরিকল্পনাকে রূপায়িত করার জন্য কেরালার সিপিএম পরিচালিত সরকার কুৎসা এবং মিথ্যা অপবাদের যে বোঝা মৎস্যজীবীদের উপর চাপিয়ে দেয়, সেটাকে সাহসের সাথে মোকাবিলা করেছেন মৎস্যজীবীরা। ক্রমবর্ধমান সামুদ্রিক ভাঙনের কারণে মৎস্যজীবীদের যে ২৮৪টি দরিদ্র পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়ে সিমেন্টের গোডাউনে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন, সরকার তাঁদের পুনর্বাসনের জন্য নূ্যনতম সৌজন্যও দেখায়নি। মৎস্যজীবীদের বীরত্বপূর্ণ লড়াইকে কোণঠাসা করার লক্ষে, সিপিএম নেতৃত্বাধীন শাসক ফ্রন্ট অত্যন্ত তৎপরতার সাথে সাম্প্রদায়িক বিজেপির সঙ্গে জোট বাঁধার সিদ্ধান্ত নেয়– কেরালার তুলনামূলকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এমন একটি সাম্প্রদায়িক প্রচারের যে মারাত্মক পরিণতি হতে পারে তা বিবেচনা না করেই। মৎস্যজীবীদের সংগ্রামের বিরোধিতায় কুৎসিত ফ্যাসিবাদী পন্থা অবলম্বন করা এবং তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেওয়া থেকেও তারা পিছপা হয়নি।
এমনকি মৎস্যজীবী, যারা তাদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ এবং সাহসী প্রচেষ্টার মাধ্যমে বন্যা বিপর্যস্ত এলাকা থেকে অসংখ্য বিপন্ন মানুষকে উদ্ধার করেছে এবং যারা মানুষের আন্তরিক প্রশংসা পেয়েছে, তাদের এখন সিপিএম সন্ত্রাসবাদী এবং সাম্প্রদায়িক শক্তি হিসাবে চিহ্নিত করছে। কী মর্মান্তিক পরিহাস! যথার্থ বামপন্থী চেতনা ধারণ করলে মৎস্যজীবী গরিব মানুষকে এভাবে দাগিয়ে দেওয়া সম্ভব হত? পুলিশকে ব্যবহার করে এই অসহায় মানুষগুলোর ওপর তারা বিরামহীন ভাবে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। তিন সহস্রাধিক আন্দোলনকারীর উপর মিথ্যা মামলা চাপিয়েছে। সমস্ত দমন-পীড়ন, কুৎসা, কলঙ্ক, অপপ্রচারকে সাহসের সাথে মোকাবিলা করে, বিপুল শক্তিধর কর্পোরেট শক্তির বিরুদ্ধে ১৩৮ দিনের দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন পরিচালনার মধ্যে দিয়ে সংগ্রামী মৎস্যজীবীরা লড়াইয়ের এক ঐতিহাসিক রাস্তা রচনা করেছে, যা আগামী দিনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের সমস্ত প্রতিরোধ আন্দোলনে প্রেরণা জোগাবে।
এই সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্ব এখনও পর্যন্ত এমন দাবি করেনি যে, এই আন্দোলনের সমস্ত দাবি অর্জিত হয়ে গেছে। তারা আরও স্পষ্ট করেছে যে, বর্তমান সময়ে আন্দোলনে সাময়িক বিরতি দিলেও তারা কোনও ভাবে খুশি নন। হয়তো সরকারি হুমকি, শাসানি, উৎপীড়নের সামনে এই আন্দোলন সাময়িক মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে। এই বিরতির প্রয়োজনও আছে। কিন্তু আন্দোলন আবার মাথা তুলবে। নেতৃত্বের এই বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণ আন্দোলনের বাস্তব জটিলতাকে গুরুত্ব সহকারে বুঝতে সাহায্য করেছে। শুধু তাই নয়, এই কঠিন বাস্তব পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে এই আন্দোলনের পক্ষে যে যুক্তিগুলি দেখানো হয়েছে, তার সপক্ষে সাধারণ মানুষকে সামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে তারা।
মৎস্যজীবীদের দাবি সরকার মানতে চায়নি। এরকম একটি উদাসীন সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে কী ভাবে দাবি আদায় হয়েছে, এই মাপকাঠির ভিত্তিতেই কেবলমাত্র যেকোনও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সফল পরিণতি সম্পর্কে মূল্যায়ন সম্ভব। ভিঝিনজাম আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই আন্দোলনের সাথে জড়িত জনসাধারণের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা, ভ্রাতৃত্ববোধের একটা উচ্চ ধারণা তৈরি হয়েছে এবং আন্দোলনকারীদের আস্থা বাড়িয়েছে। এই আন্দোলন নিশ্চিতভাবে এবং নিঃসন্দেহে ভবিষ্যতে যেকোনও আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটা মূল্যবান অভিজ্ঞতা হিসেবে কাজ করবে। উপকূলবর্তী এলাকার মানুষের এই লড়াই কেরালার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মধ্যে আদানি বন্দর প্রকল্পের সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং পরিবেশ ধ্বংসকারী প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
বহুজাতিক আদানি বন্দরের বিরুদ্ধে মৎস্যজীবীদের আন্দোলনকে দমন করার জন্য সিপিএম প্রকাশ্যে যেভাবে বিজেপির সাথে হাত মেলালো, তার মধ্যে দিয়ে জনসাধারণ পরিষ্কার বুঝে গেছে এই সমস্ত দলগুলি পুঁজিপতিদের স্বার্থেই কাজ করে। সমস্ত সংসদীয় দলগুলি আগ্রাসী পুঁজিপতিদের স্বার্থকেই রক্ষা করে। এই আন্দোলনের উত্তাপ থেকে মানুষ উপলব্ধি করেছে যে সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষা নয়, সমস্ত সংসদীয় ভোটকেন্দ্রিক দলগুলি পুঁজিবাদের স্বার্থরক্ষায় সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত। এই উন্নত চেতনা আগামী দিনে আরও অনেক আন্দোলনের রাস্তা প্রশস্ত করবে। আন্দোলন সম্পর্কে এই স্বচ্ছ ধারণা ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত আন্দোলনের জন্ম দেবে। কর্পোরেট শক্তিগুলি খনিজ সম্পদ, সমুদ্র ও উপকূলবর্তী অঞ্চলের অর্থনীতি এবং উপকূলীয় এলাকার বৃহদাকার নির্মাণের জন্য উপকূলের বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদে যেভাবে তাদের শোষণের ক্ষেত্র প্রসারিত করছে, তাতে মানুষের সমস্যা প্রতিনিয়ত আরও বাড়বে এবং তাদের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। একমাত্র গণতান্ত্রিক আন্দোলনের রাস্তাতেই এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ সম্ভব–ভিঝিনজাম আন্দোলনের এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
যেহেতু সমস্ত সরকারের নীতি ও তার প্রয়োগ সম্পূর্ণরূপে একচেটিয়া পুঁজির সেবা করার স্বার্থে পরিচালিত হয়, সেই কারণে গণআন্দোলনের সম্পূর্ণ বিজয় অর্জনের জন্য প্রয়োজন লাগাতার আন্দোলন। সরকারি নীতির প্রয়োগে যারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে এবং সরকারের বিপজ্জনক নীতির বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে পারে আন্দোলনই। গণকমিটিই একমাত্র জনগণের সংগ্রামের হাতিয়ার। আন্দোলনের নেতৃত্বকে আন্দোলনের স্বার্থে এগিয়ে আসা সকল জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। কোনও ক্ষতিকারক শক্তি যাতে এই আন্দোলনে ঢুকে একে সাম্প্রদায়িক বা বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে দেগে দিতে না পারে, সেজন্য নেতৃত্বকে সতর্ক থাকতে হবে। দিল্লির ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন যা ফ্যাসিস্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে মাথা নত করতে বাধ্য করেছিল এবং কেরালার সিলভার লাইন বিরোধী আন্দোলন যা রাজ্য সরকারকে পিছু হঠতে বাধ্য করেছিল, তা ভিঝিনজাম আন্দোলনে প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছে। এই আন্দোলনগুলির মূল্যবান অভিজ্ঞতা জনগণকে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। ধনকুবের গোষ্ঠী এবং তাদের রাজনৈতিক দালালদের সর্বনাশা নীতি থেকে কেরালা রাজ্যকে বাঁচাতে মৎস্যজীবী সহ ভিঝিনজামের উপকূলবাসীকে এগিয়ে আসতে হবে। একই সাথে রাজ্যের সমস্ত স্তরের মেহনতি জনগণকে এই আন্দোলনকে রক্ষা করতে হবে, তার পক্ষে এসে দাঁড়াতে হবে।