এ রকম একটা বিরাট ‘সুখবর’ যা দেওয়ার কথা ছিল স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর, অথচ দিলেন নীতি আয়োগের সিইও বি ভি আর সুব্রহ্মণ্যম। নীতি আয়োগের দশম গভর্নিং কাউন্সিলের বৈঠকের পর উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি জানালেন, জাপানকে পিছনে ফেলে ভারত এখন বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। চলতি বছরের এপ্রিলে প্রকাশিত আইএমএফ-এর ওয়ার্ল্ড ইকনমিক আউটলুক অনুযায়ী আমেরিকা, চিন, জার্মানি রয়েছে ভারতের আগে। আর ভারতের ঠিক পরেই রয়েছে ‘উদীয়মান সূর্যের দেশ’ জাপান। লক্ষণীয় বিষয়, এই ঘোষণা আইএমএফ যে দিন করছে সে দিনই তারা জানিয়েছে ২০২৫ এবং ’২৬ সালে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি কমবে। বাস্তবে গত ১০ বছরে ভারতের জিডিপি বাড়েনি, বরং কমেছে। ২০১৬ সালে যা ছিল ৮.৩ শতাংশ, তা এখন ৬.২ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রী এই সুখবর না দিলেও মোদি-অনুগামীরা এমন প্রচারে নেমে পড়েছে যেন মনে হচ্ছে ভারতের সব মানুষ বড়লোক হয়ে গেছে। জীবনের সকল দুঃখ-দুর্দশা সব নিমেষে এ বার গায়েব হয়ে যাবে। আসুন আমরা বরং বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি ভারতের বাস্তব ছবিটা মিলিয়ে দেখে নিই।
কেউ বলতেই পারেন, ভারত বিশ্বের বৃহত্তম চতুর্থ অর্থনীতির দেশ— এটা কি কম বড় ব্যাপার! এই উন্নয়ন কি মিথ্যা? না, অবশ্যই মিথ্যা নয়। কিন্তু এই সত্য, মিথ্যার থেকেও ভয়ঙ্কর। কারণ, জিডিপি, মাথাপিছু আয়— অর্থনীতির এইসব হিসাব দিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রকৃত অবস্থাটা বাস্তবিকই বোঝা যায় না। ভারতে মাথাপিছু আয় বছরে ২ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা, মানে মাসে ১৯,৫৮৩ টাকা। আপনার ঘরের বেকার যুবক, রাস্তার ওই ভিক্ষুক—এই হিসাবে তারও মাসিক আয় নাকি এতখানিই! হাস্যকর নয় কি? এই হিসাব হচ্ছে আসলে মেলার আয়না ঘরের মতো। নানা আকৃতির আয়না, যা আপনার প্রকৃত অবস্থা বুঝতে দেয় না। আয়না যেমন দেখায় আপনি নিজেকে তেমনই দেখেন।
তর্কের খাতিরে মাথাপিছু আয়কে যদি উন্নয়নের মাপকাঠি ধরাও যায়, তা হলেও কিন্তু ধাক্কা খেতে হয়। তথ্য বলছে, জিডিপি-র বিচারে ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হলেও মাথাপিছু আয়ের নিরিখে তার স্থান ১৯৭টি দেশের মধ্যে ১৩৬তম। আফ্রিকার কেনিয়া-মরক্কো-লিবিয়ার মতো দেশেরও পিছনে। সরকার নিজেই বলছে ভারতের ৮০ কোটিরও বেশি মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্য না দিলে তারা নাকি বাঁচবে না! ওয়ার্ল্ড ইন ইকুয়ালিটি ল্যাবে টমাস পিকেটি, লুকাস চ্যান্সেলর ও নীতিন কুমার ভারতী কর্তৃক রচিত গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে দেশের শীর্ষ ১ শতাংশ মানুষের আয় ও সম্পদ ছিল যথাক্রমে দেশের মোট আয়ের ২২.৬ শতাংশ ও মোট সম্পদের ৪০.৫ শতাংশ। কিন্তু এই ১ শতাংশ মানে এক কোটি চল্লিশ লক্ষ ধনীতম মানুষ যে বিপুল সম্পদ ও আয়ের অধিকারী, যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, তা যদি হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হয় তা হলে এক ধাক্কায় ভারতের জিডিপি কমে আফ্রিকার যে কোনও অতি দরিদ্র দেশের সমান হয়ে যাবে।
দেশে যে সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে তা তৈরি করেছে দেশের শ্রমজীবী মেহনতিরা। অথচ তা কেড়ে নিয়েছে এই এক শতাংশ। বাকি নিরানববই শতাংশ বঞ্চিত, নিপীড়িত। এই চিত্র বিশ্বজোড়া। যত দিন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা ছিল ততদিন বিশ্বের অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশের মতো ভারতের শাসকরাও এই শোষণ-বঞ্চনার ওপর কিছুটা লাগাম দিতে বাধ্য হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার সাময়িক বিপর্যয়ের পর যখন নয়া উদারবাদী অর্থনীতি এল, বিশ্ব একমেরু হয়ে উঠল, তখন থেকেই এই শোষণ ও বঞ্চনা হয়ে উঠল লাগামহীন। ২০০০ সাল থেকে ভারতে আর্থিক বৈষম্য আকাশছোঁয়া হয়ে উঠল এবং সেই বৈষম্য ক্রমাগত বাড়ছে। তথ্য অনুসারে ভারতে ধনকুবেরের সংখ্যা ১৯৯১ সালে ১ জন থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে ১৬৬ জন (ফ্রন্টলাইন ২৩“০৩“২৪)। অন্য দিকে আর্থিক বৈষম্য ব্রিটিশ আমলকেও ছাপিয়ে গেছে।
জনসংখ্যা গড় আয় (মাসে)
সমগ্র দেশবাসী ১৯,৫৮৩ টাকা
শীর্ষ ০.১ শতাংশ ১৮,৭৫,০০০ টাকা
১ শতাংশ ৪,৪১,৬৬৭ টাকা
মধ্যম ৪০ শতাংশ ১৩,৭৫০ টাকা
সর্বনিম্ন ৫০ শতাংশ ৫৯৩০ টাকা
(দ্য ওয়্যার ২৬-০৫-২৫)
অ’ফাম ইন্ডিয়া ২০২৩ সালের প্রতিবেদন, ‘সারভাইভাল অফ দ্য রিচেস্টঃ দ্য ইন্ডিয়া স্টোরি’-তে বলেছে– দেশের এক শতাংশ মানুষ মোট সম্পদের ৪০.৫ শতাংশের মালিক, ১০ শতাংশ মানুষ ৭৭ শতাংশ সম্পদের মালিক, আর নিচের ৫০ শতাংশ মানুষ দেশের মোট সম্পদের মাত্র ৩ শতাংশের মালিক (দ্য ওয়্যার ২৬-০৫-২৫)।
নয়া উদারবাদী ভারতে পুঁজিপতিদের নেতৃত্বে চলছে ধনকুবেরদের লুণ্ঠন-রাজ। বৃহৎ একচেটিয়া কোম্পানিগুলির কাছ থেকে কর্পোরেট ট্যাক্স নয়, মানুষের পকেট কেটে পরোক্ষ করের মাধ্যমে সরকার তার আয় বাড়াচ্ছে। মুষ্টিমেয়র স্বার্থে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসীকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে দারিদ্রের অতল গহ্বরে। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, কম মজুরি, কাজের অভাব, প্রবল বেকারত্ব, বিশাল অসমতা ইত্যাদি সমস্যায় চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিপর্যস্ত। দেশের বেশিরভাগ মানুষের ঘরে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসার খরচ সামাল দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ছে। শিক্ষার খরচ ক্রমাগত বাড়ছে। জনস্বাস্থ্য বিপন্ন। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি হচ্ছে না। বিপুল পয়সা খরচ করে আজ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কিনতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতে ক্রমাগত ব্যয়বৃদ্ধি প্রতি বছর দেশের দশ কোটি মানুষকে দারিদ্রের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে (দ্য ওয়্যার জুলাই ২০২৪)। অর্থাৎ সরকারের মানসিকতা হল– দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ খাবারের পরিমাণ ও মান কমাক, জীবন যাপনের মান কমাক আর চিকিৎসা কোনও রকমে ঠেকনা দিয়ে চলুক। আর অন্য দিকে আম্বানি, আদানিদের মতো ধনকুবেরদের সম্পদের পাহাড় আরও উঁচু হতে থাকুক। সরকারের যাবতীয় পরিকল্পনা সম্পদের শীর্ষে থাকা ওই দশ শতাংশ মানুষকে নিয়েই। এই দশ শতাংশকে আরও বেশি মুনাফা লুটে আরও বেশি ধনী হওয়ার সুযোগ কী ভাবে তৈরি করে দেওয়া যায়, সরকারের একমাত্র লক্ষ্য সেটাই। এর জন্যই তাদের যাবতীয় পরিকল্পনা। ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে অবশ্য এই সংখ্যাটাও যা তা অনেক দেশের জনসংখ্যার চেয়েও বেশি।
ফলে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ যারা একেবারে নিচের দিকে পড়ে রইল, তাদের কী যায় আসে ভারত চতুর্থ হল না প্রথম হল, তাতে! আমেরিকা প্রথম অর্থনীতির দেশ। সেই আমেরিকাকে সবার সেরা করার স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় বসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হাজার হাজার সরকারি কর্মচারীকে চাকরি থেকে ছেঁটে ফেলে পথে বসিয়েছেন। কেউ কি ভুলতে পারে কোভিড অতিমারির সময়ে কী ভাবে লাখে লাখে দরিদ্র মানুষ আমেরিকায় বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন! ভোলা কি যায় শোষিত-বঞ্চিত সেইসব মানুষের কথা, যাঁরা ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, স্লোগান তুলেছিলেন– আমরা ৯৯ শতাংশ? তেমনই ভারত যখন অর্থনীতিতে চতুর্থ, তখনও ভারতের বেকার সংখ্যা গত ৪৫ বছরের শীর্ষে। বিরাট সংখ্যক শিশু বয়সের তুলনায় কম ওজন এবং কম উচ্চতা নিয়ে বড় হচ্ছে। প্রসূতি মায়েদের অর্ধেকই অপুষ্টির শিকার। ঋণগ্রস্ত চাষিরা ফসলের দাম না পেয়ে লাখে লাখে আত্মহত্যা করছেন। তাই অর্থনীতির এই বহরবৃদ্ধি নিয়ে ‘দিন আনা দিন খাওয়া’ রাম-রহিমদের কিছুই যায় আসে না।
আসলে এক ভারতের মধ্যে আছে দুটো দেশ। একটা ইন্ডিয়া যা দশ শতাংশ মানুষের। যাদের খাবার-সুশিক্ষা-সুস্বাস্থ্য-আমোদ-প্রমোদ সব আছে। আর একটা নব্বই শতাংশের ভারত, যাদের উপর শোষণ লুণ্ঠন চালিয়েই উপরের দশ শতাংশের সমস্ত ভোগ-সুখ। এই নব্বই শতাংশের সব থেকেও কোনও কিছুতেই অধিকার নেই। তাদের জীবনে শুধু নেই আর নেই। এদের জন্য আছে শুধু হিন্দু-মুসলমান, ব্রাহ্মণ-দলিত, রাম মন্দির-মথুরা-কাশী, সন্দেহের বশে পিটিয়ে মারা, যুদ্ধ উন্মাদনায় মাতিয়ে রাখা আর তারই ফাঁকে তাদের সবকিছু লুটে নেওয়া। এই বৈষম্য দূর না করা গেলে অর্থনীতির বহরে ভারত চতুর্থ না প্রথম– দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দিকে তাকিয়ে তার কোনও হদিশই পাওয়া যাবে না।
এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা ৬ – ১২ জুন ২০২৫ এ প্রকাশিত