১৯৪২ বললেই মনের মধ্যে ভেসে ওঠে সেই স্লোগান– ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’। ভেসে ওঠে সংগ্রামের পতাকা হাতে স্বাধীনতাকামী হাজার হাজার মানুষের প্রাণবলিদানের ছবি। সংগ্রামের পতাকা হাতে নিয়ে মাতঙ্গিনী হাজরার মৃত্যু আজও দেশের মানুষকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, শোষণ-জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রেরণা দেয়। একজন সাধারণ গ্রাম্য মহিলা থেকে এক স্মরণীয় বিপ্লবী চরিত্র হিসাবে তিনি গড়ে উঠেছিলেন যে সংগ্রামের আগুনের স্পর্শে তা ছিল ঐতিহাসিক ব্রিটিশ বিরোধী ভারত ছাড়ো আন্দোলন বা আগস্ট আন্দোলন। পরাধীন ভারতের সর্ববৃহৎ এবং সর্বব্যাপক গণআন্দোলন হিসাবে ইতিহাসে অনন্য স্থান দখল করে আছে এই আন্দোলন। ঘটনাবহুল স্বাধীনতা আন্দোলনে এত বড় জনজাগরণের নজির আর নেই। কোনও উপযুক্ত নেতৃত্ব ছাড়াই দলে দলে শ্রমিক কৃষক ছাত্র যুবক মহিলা সহ সাধারণ মানুষ এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, ব্র্রিটিশ শাসকের অকথ্য নির্যাতনের শিকার হয়েছে পুলিশের গুলিতে অকাতরে প্রাণ দিয়েছে, জেলে গিয়েছে, তবু পিছু হটেনি।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই ব্র্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে চরম আঘাত হানার কথা বলেছিলেন কংগ্রেস সভাপতি নেতাজি সুভাষচন্দ্র। ডাক দিয়েছিলেন ব্যাপক গণআইন অমান্যের। কিন্তু কংগ্রেসের গান্ধীবাদী নেতৃত্ব সর্বাত্মক সংগ্রামের পথে যেতে রাজি হয়নি। উপরন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন মনোভাবের জন্য নেতাজিকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করা হয়। নেতাজির বহিষ্কার, রামগড়ে তাঁর নেতৃত্বে বাম সংহতি সম্মেলন, আন্তর্জাতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন ত্বরান্বিত করতে তাঁর মহানিষ্ক্রমণের ঘটনা সারা দেশের মুক্তিকামী মানুষ, বিশেষ করে যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে প্রবল আবেগ ও উদ্দীপনার জন্ম দেয়, যা কংগ্রেসের আপসকামী নেতৃত্বের উপর প্রবল চাপ তৈরি করে। বাধ্য হয়ে গান্ধীজি ‘৪২-এর ৯ আগস্ট থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দেন। কিন্তু দেশব্যাপী দীর্ঘস্থায়ী গণআন্দোলনের জন্য যে ব্যাপক প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনা দরকার তার কিছুই তাঁরা করলেন না। উপরন্তু ৯ আগস্ট ভোরেই কংগ্রেসের নেতারা গ্রেফতার হয়ে সবাই জেলে চলে গেলেন। জনতা হয়ে পড়ল সম্পূর্ণ নেতৃত্বহীন। কিন্তু মানুষের মধ্যে পরাধীনতার জ্বালা কী তীব্র ছিল, স্বাধীনতার আকাঙ্খা কতখানি প্রবল হয়ে উঠেছিল পরবর্তী ঘটনাগুলিতে তা স্পষ্ট হয়ে উঠল। জনতার রুদ্ধ রোষ দেশব্যাপী ফেটে পড়ল।
সারা দেশে হরতাল, কলকারখানায়-স্কুল-কলেজে ধর্মঘট, বিক্ষোভ, সমাবেশের জোয়ার বয়ে গেল। শুরু থেকেই ব্রিটিশ প্রশাসন নির্মম ভাবে এই বিক্ষোভ দমন করতে থাকল। দমন নীতির তাণ্ডবলীলার বিরুদ্ধে জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলল। টেলিগ্রাফের তার কেটে, রেল লাইন উপডে, ব্র্রিজ ভেঙে, সরকারি অফিস-কাছারি বন্ধ করে, আগুন লাগিয়ে তারা প্রাণপণ লড়াই করল। আন্দোলন এগিয়ে চলল আপন গতিতে।
বিদ্রোহী জনতা দেশের নানা জায়গায় ব্রিটিশ শাসন উৎখাত করে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দিন স্থায়ী ও সফল হয়েছিল মেদিনীপুরের তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। এ ছাড়া উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ওড়িশা, অন্ধ্র, তামিলনাড়ূ ও মহারাষ্টে্রর নানা জায়গায় ব্রিটিশ শাসন সাময়িক ভাবে উৎখাত হয়েছিল। এই গণবিদ্রোহে ছাত্র-যুব, শ্রমিক কৃষকরাই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। সমাজের উঁচুতলার মানুষেরা এই বিদ্রোহ থেকে দূরেই ছিল।
আন্দোলন দমন করতে ব্রিটিশ প্রশাসন নিষ্ঠুরতম পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল। পুলিশের হাতেই দেশকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। দেশীয় সংবাদপত্রগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বহু ছোট-বড় শহরকে সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। দশ হাজারের বেশি মানুষ পুলিশ ও মিলিটারির অত্যাচারে নিহত হয়েছিল। অসংখ্য মহিলা ধর্ষিতা হয়েছিলেন। লক্ষাধিক মানুষকে গ্রেফতার করে জেলে ভরা হয়েছিল। যেসব জায়গায় আন্দোলন বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছিল সেখানে গ্রামগুলিতে পিটুনি কর চালু করা হয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রে গ্রামবাসীদের ধরে ধরে চাবুক মারা হয়েছিল। ১৮৫৭-র পরে সরকারি দমননীতির এমন তাণ্ডবলীলা আর কখনও দেখা যায়নি। দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য কী পরিমাণ স্বার্থত্যাগ করতে প্রস্তুত এই আন্দোলন তা স্পষ্ট করে দিয়েছিল।
এই আগস্ট আন্দোলনেই গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান অনুশীলন সমিতির তৎকালীন অন্যতম স্বেচ্ছাসেবক শিবদাস ঘোষ। জেলে বসেই তিনি মার্ক্সবাদের গভীর চর্চা করেন এবং উপলব্ধি করেন, এতবড় গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা সংগ্রামের সুফল আত্মসাৎ করতে চলেছে পুঁজিপতি শ্রেণি। তাই তিনি একটি যথার্থ কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার সংগ্রাম শুরু করেন। এই সংগ্রামের ধারাবাহিকতাতেই তিনি এ যুগের একজন মহান মার্ক্সবাদি চিন্তানায়ক হিসাবে গড়ে ওঠেন এবং যথার্থ কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)কে গড়ে তোলেন।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মতো এত বড় গণজাগৃতি হলেও তাতে সামিল হয়নি কেন্দ্রের বর্তমান শাসক দল বিজেপির পূর্বসূরি হিন্দু মহাসভা এবং আরএসএস। তারা এর সর্বাত্মক বিরোধিতা করেছিল, এমনকি আন্দোলন দমনে ব্রিটিশ সরকারকে সাহায্যও করেছিল। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী তখন বাংলার ফজলুল হক মন্ত্রিসভার সদস্য। ব্র্রিটিশের অনুগ্রহ লাভের আশায় ১৯৪২-এর ২৬ জুলাই তিনি বাংলার গভর্নর জন হার্বার্টকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আপনাদের এক জন মন্ত্রী হিসেবে, আমি পূর্ণ সহযোগিতা জানাচ্ছি। … যুদ্ধ চলার সময়ে যদি কেউ জনতার আবেগ উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করে, অভ্যন্তরীণ শান্তি ও নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটায়, সরকার যেন তার প্রতিরোধ করে।’ ভারত ছাড়ো আন্দোলন সম্পর্কে তিনি বললেন, ‘আমি মনে করি না, গত তিন মাসের মধ্যে যেসব অর্থহীন উচ্ছৃঙ্খলতা ও নাশকতামূলক কাজ করা হয়েছে, তার দ্বারা আমাদের দেশের স্বাধীনতা লাভের সহায়তা হবে।’ ভারত ছাড়ো আন্দোলন শ্যামাপ্রসাদের কাছে ‘অর্থহীন উচ্ছৃঙ্খলতা’ ও ‘নাশকতামূলক’ কাজকর্ম। আরএসএসের গুরু গোলওয়ালকরের কাছে ব্রিটিশের অত্যাচারকে মনে হয়েছিল স্বাভাবিক। তার বক্তব্য ছিল, ‘বড় মাছ তো ছোট মাছকে গিলে খাবেই।’ এই সব ‘দেশপ্রেমিক’রা ভারত ছাড়ো আন্দোলন দমন করার নানা পন্থার একটা তালিকাও ব্রিটিশ সরকারকে দিয়েছিলেন। ভারত ছাড় আন্দোলন শুরু হওয়ার দেড় বছর পর, ব্রিটিশ রাজের অধীনস্থ বম্বে সরকার একটি নোটে উল্লেখ করে, ‘সঙ্ঘ (আরএসএস) যথাযথভাবে নিজেদের আইনের সীমানায় সংযত রেখেছে, এবং ১৯৪২ সাল থেকে শুরু হওয়া দেশজোড়া অশান্তির সাথে কোনও ভাবেই নিজেদের জড়ায়নি।’ বস্তুত, স্বাধীনতা আন্দোলনের কোনও কিছুতেই তারা জড়ায়নি। এতে আরএসএসের সাধারণ সদস্যদের মধ্যে প্রতিক্রিয়াও হয়েছিল। কারণ তারা চোখের সামনে দেখছিল দেশের জন্য মানুষের আত্মদান আর নেতারা তাদের বোঝাচ্ছিল ধর্মীয় বিভাজনের পাঠ। কর্মীদের ক্ষোভকে প্রশমিত করতে সঙ্ঘ নেতারা আশ্রয় নিয়েছিলেন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের। তারা ব্রিটিশ বিরোধী ক্ষোভকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে চালিত করে দলের কর্মীদের উত্তেজিত করত। আজকের স্বঘোষিত দেশপ্রেমিকদের এই হল প্রকৃত ইতিহাস। তাদেরই উত্তরসূরিরা আজ ক্ষমতায় বসে দেশের মানুষকে দেশপ্রেমের শিক্ষা দিচ্ছে! শুধু আরএসএস-ই নয়, মুসলিম মৌলবাদী শক্তি মুসলিম লিগও ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল।
এই আন্দোলনে অবিভক্ত সিপিআই-এর ভূমিকা কী ছিল? অবিভক্ত সিপিআই (যার মধ্যে সিপিএম এবং সিপিআইএমএল নেতারা ছিলেন) সেদিন যে ভূমিকা নিয়েছিল তা বামপন্থীদের প্রকৃত কর্তব্যের ঠিক বিপরীত। স্বাধীনতার লক্ষ্যে এত বড় একটা গণআন্দোলন হল অথচ সিপিআই নেতারা গোটা সময়টা হাত গুটিয়ে বসে থাকলেন। তাঁরা বললেন, যেহেতু যুদ্ধে ব্রিটেন সোভিয়েতের সহযোগী তাই ভারতে ব্রিটিশের বিরোধিতা করা ঠিক হবে না। শুধু তাই নয়, তাঁরা ভারত ছাড়ো আন্দোলনেরই বিরুদ্ধতা করতে থাকলেন। সাধারণ শ্রমিকরা যখন কলকারখানায় আন্দোলন করছে, ধর্মঘট করছে তখন কমিউনিস্ট নামধারী এইসব নেতারা তার বিরুদ্ধে প্রচার করছেন। তাঁরা বলেছেন, এখন উৎপাদন ব্যাহত হলে ব্রিটিশ যুদ্ধে হেরে যাবে। এমনকি যুদ্ধ চলাকালীন নেতাজি যখন আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে ভারতের স্বাধীনতার জন্য দুঃসাহসিক সংগ্রামে লিপ্ত তখন এই নেতারা নেতাজিকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজোর কুকুর বলে গালি দিতে থাকলেন। জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে এই অ-কমিউনিস্টসুলভ ভূমিকার জন্য সিপিআই নেতাদের তীব্র ভৎর্সনা করেছিলেন মহান স্ট্যালিন।
অবিভক্ত সিপিআই যদি সত্যিকারের কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে গড়ে উঠত স্বাধীনতা আন্দোলন নিঃসন্দেহে অন্য মাত্রা পেত। স্বাধীনতার সুফল দেশের পুঁজিপতিরা এ ভাবে আত্মসাৎ করতে পারত না। মালিকশ্রেণির স্বার্থে দেশের সাধারণ মানুষের উপর কংগ্রেস-বিজেপির চালানো দাঙ্গা-শোষণ-নিপীড়ন হয়ত আজ দেখতে হত না। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরও মানুষের এমন দুঃসহ অবস্থা– খাদ্য নেই, শিক্ষা নেই, রোগে ওষুধ নেই, মহামারীতে পোকা-মাকড়ের মতো মানুষ মারা যাচ্ছে, বেকারে দেশ ছেয়ে গেছে, ভোটবাজ দলগুলির নেতারা প্রতিনিয়ত পুঁজিপতিদের তোষামোদ আর সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করে চলেছে– হয়ত এর কোনও কিছুই দেখতে হত না। মানুষের সত্যিকারের মুক্তির জন্য সংগ্রামে সঠিক নেতৃত্ব, সত্যিকারের কমিউনিস্ট পার্টি কেন প্রয়োজন ভারত ছাড় আন্দোলনের ইতিহাস স্মরণের এটা একটা বড় শিক্ষা। এই উপলব্ধি থেকেই এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্কবাদী দার্শনিক শিবদাস ঘোষ কঠিন কঠোর সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছেন সত্যিকারের কমিউনিস্ট দল। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের যথার্থ তাৎপর্য উপলব্ধির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেই দলকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলার উপলব্ধি।