ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজায় যে শিশুটির ছিন্নভিন্ন দেহের ছবি আপনাকে কাঁদিয়েছে, তারই রক্তের ছিটে যদি আবিষ্কার করেন ভারতীয় অস্ত্র কোম্পানির মুনাফার হিসাব লেখার খাতায়! ভারতীয় হিসাবে আপনি, আমি সকলে কোন গৌরবের অধিকারী হব! প্রশ্নটা উঠছে কারণ, গাজায় ইতিমধ্যেই ৫০ হাজার মানুষের সরাসরি যুদ্ধে মৃত্যু হয়েছে। অনাহার, পানীয় জলের অভাব চিকিৎসার অভাবে দুই লক্ষের বেশি মানুষ জীবন হারিয়েছেন। দুঃখের হলেও সত্য যে, এই গণহত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রের একটি বড় অংশ সরবরাহ করা হচ্ছে ভারত থেকে।গণহত্যার অভিযোগ জানা সত্ত্বেও ইজরায়েলকে অস্ত্র বেচছেভারতের কিছু অস্ত্র সরবরাহকারী কোম্পানি। যার মধ্যে আছে রাষ্ট্রায়ত্ত মিউনিশনস ইন্ডিয়া লিমিটেড, বেসরকারি মালিকানাধীন প্রিমিয়ার এক্সপ্লোসিভস, আদানি ডিফেন্স অ্যান্ড অ্যারোস্পেস লিমিটেড প্রভৃতি।
প্রখ্যাত আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ এবং চেরিল ডিসুজার মতো আইনজীবী ও আইনের বিশেষজ্ঞ শিক্ষকরা এই প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, জেনেভা ইন্টারন্যাশনাল জেনোসাইড কনভেনশন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী কোনও রাষ্ট্র গণহত্যা চালাচ্ছে বা চালাতে পারে এ রকম সম্ভাবনা দেখলেই যে কোনও দেশের কর্তব্য তার সাথে সমস্ত অস্ত্র ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া। কোনও দেশ গণহত্যার খবর জেনেও অপরাধী দেশকে অস্ত্র সরবরাহ করলে তাকেও ওই দুষ্কর্মের শরিক হিসাবে গণ্য করা হয়। ভারত সরকারের অজানা নয় যে, আন্তর্জাতিক ন্যায় আদালত (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস বা আইসিজে) গত জানুয়ারি মাসেই ফুল কোর্ট শুনানিতে ইজরায়েলকে প্যালেস্টাইনে গণহত্যা চালানোর দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেছে। এই আদালত প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলের উপস্থিতিকেও বেআইনি বলেছে। আন্তর্জাতিক আদালত স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিল, ইজরায়েলের এই বেআইনি দখলদারিতে সাহায্য হয় এমন কোনও কাজ কোনও রাষ্ট্র করতে পারবে না। আন্তর্জাতিক আদালত ওই রায়েই বলেছিল, জেনোসাইড কনভেনশনের আর্টিকেল-৩ অনুসারে কোনও রাষ্ট্র অস্ত্র রপ্তানির মাধ্যমে গণহত্যার শরিক বনে গেলে তার অপরাধও গণহত্যাকারীদের মতোই শাস্তিযোগ্য। এই কনভেনশনের আর্টিকেল-১ অনুযায়ী সমস্ত রাষ্ট্র এই নিয়ম মেনে চলতে দায়বদ্ধ (১৭.০৯.২৪ দ্য হিন্দু)।
আইনজীবীদের মতে, এই কারণেই ইজরায়েলে অস্ত্র রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা ভারত সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। গত সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে ভারতের বেশ কিছু অবসরপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্তা, শিক্ষাবিদ ও আইনবিদের দায়ের করা একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্টে সরকার বলেছিল, এখন অস্ত্র রপ্তানির লাইসেন্স বাতিল করলে কোম্পানিগুলিকে চুক্তি খেলাপের দায়ে পড়তে হবে। এ ছাড়া, সরকারের বিদেশনীতির বিষয়ে আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এই যুক্তিতেই সিলমোহর দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। বিদেশনীতি এবং চুক্তিভঙ্গের ফলে ভারতীয় পুঁজিপতিদের ক্ষতির প্রশ্ন তুলে সুপ্রিম কোর্ট মামলাটি বাতিল করে দিলেও আইনজীবীদের মতে, বিদেশনীতি সর্বদাই আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও আইন এবং নৈতিকতার ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়ার কথা। যে কোনও দেশের বিদেশ সংক্রান্ত আইন ও আচরণ এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হলে তা পরিবর্তন করাটাই কর্তব্য। এ ছাড়া, চুক্তিভঙ্গ হওয়ার যে আশঙ্কা সরকার তুলেছে আইনজীবীরা তাও নস্যাৎ করে দিয়ে বলেছেন, যে কোনও অস্ত্রচুক্তির অবশ্যপালনীয় শর্ত থাকে– কোনও ভাবে এই অস্ত্র গণহত্যা, শিশুহত্যা বা অন্য কোনওভাবে অন্যায় যুদ্ধে কাজে লাগানোর সম্ভাবনা দেখামাত্রই অস্ত্র রপ্তানি বন্ধ করা ও রপ্তানিকারক কোম্পানির লাইসেন্স সাসপেন্ড করা সে দেশের সরকারের কর্তব্য। এই কাজটি না করেই বরং ভারত সরকার আন্তর্জাতিক আইন ভাঙছে।
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও আইসিজে আদালত জার্মানি বনাম নিকারাগুয়া মামলায় জার্মান সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে ইজরায়েলে অস্ত্র পাঠানো সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। হেগের অ্যাপিল আদালত নেদারল্যান্ড সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে ইজরায়েলে এফ-৩৫ বিমান রপ্তানির চুক্তি বাতিল করতে হবে। আইসিজে আদালতের রায় মেনে এই দুটি দেশ সহ কানাডা, স্পেন, এমনকি ব্রিটেনও ইজরায়েলে অস্ত্র রপ্তানিকারী কোম্পানিগুলির লাইসেন্স সাসপেন্ড কর়েছে। দুঃখের বিষয়, যে দুটি শক্তি এই গণহত্যার প্রতি চোখ বুজে থেকে অস্ত্র দিয়ে ইজরায়েলকে সাহায্য করে চলেছে তার একটি বিশ্বমানবতার অন্যতম শত্রু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, এবং অপরটি এমন এক দেশ, যার জনগণ বহু বছরব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঐতিহ্য বহন করে এসেছেন– সেই ভারত। ভারতীয় শাসক পুুঁজিপতি শ্রেণি একচেটিয়া পুঁজির জন্ম দিয়ে যেভাবে সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকা নিচ্ছে এটা তারই পরিণাম। এ দেশের সত্যিকারের গৌরব রক্ষা করতে হলে জনগণকে তাই শাসক শ্রেণির এই জঘন্য ভূমিকার বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই হবে।
সম্প্রতি জানা গেছে, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধেও ভারতীয় কোম্পানির তৈরি কামানের গোলা ব্যবহৃত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য রাশিয়াকে যুদ্ধ সরঞ্জাম বেচার দায়ে ১৯টি ভারতীয় কোম্পানিকে চিহ্নিত করেছে মার্কিন সরকার। অর্থাৎ যুদ্ধে দুই পক্ষকেই অস্ত্র দিচ্ছে ভারত! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মুখে যতই শান্তির কথা বলুন, ইউক্রেনের যুদ্ধে এবং ইজরায়েলের যুদ্ধ ক্ষেত্রে তার সরকারের মদতে অস্ত্র যে যাচ্ছে তা চাপা দেওয়ার কোনও উপায় নেই। এ ছাড়াও ভারত থেকে ইজরায়েলে শত শত শ্রমিক পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে ভারত সরকার, যাদের অনেককেই যুদ্ধ পরিকাঠামো গড়ে তোলার কাজে লাগানো হচ্ছে। রাশিয়ার হয়েও ভারতীয় বেকার যুবকরা যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে বাধ্য হচ্ছে। একই সাথেদেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একবার ইজরায়েলের সঙ্গে বৈঠক করলে কিছুক্ষণ পরেই তিনি ও তাঁর সরকারের আমলারা প্যালেস্টাইনের সাথেও বৈঠক করেন। তার পরেই তিনি ছোটেন আমেরিকায়, যাতে অস্ত্র বেচায় কোনও সমস্যা না হয়। এদিকে তিনি একবার রাশিয়া ছুটলে তার কিছুদিন বাদেই ছোটেন ইউক্রেনে। সেখানে তিনি ভাসা ভাসা ভাবে ‘শান্তি চাই’, ‘সময়টা যুদ্ধের নয়’, ইত্যাদি নানা অর্থহীন কথা বললেও এখনই যুদ্ধ থামান, এই কথা বলবার ক্ষমতা তাঁর হয় না কেন?
আসলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি যেমন এই সমস্ত যুদ্ধ থেকে ফয়দা তুলছে, একই ভাবে ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজিমালিকরাও আজ যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবসাকেই তাদের মুনাফা অর্জনের পাখির চোখ করেছে। নরেন্দ্র মোদি এই মালিকদের এজেন্সি নিয়ে দেশে দেশে অস্ত্র বেচার দূতের ভূমিকায় লিপ্ত। তাই ‘যুদ্ধ থামাও’এই শব্দ ভারতের কর্তারা উচ্চারণ করছেন না। বরং ভারত সরকার যুদ্ধ থেকে সুযোগ তুলছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সুযোগে সস্তায় রাশিয়া থেকে পেট্রলিয়াম কিনছে তারা এবং তা থেকে দেশের পুঁজিপতিরা বিপুল মুনাফা করছে। সম্প্রতি একটি রিপোর্ট দেখিয়েছে রাশিয়ার এই তেল সস্তায় কিনে ভারতীয় কোম্পানিগুলি তা শোধনের পর ইউরোপেই বেচেছে। ফলে তারা আরব দুনিয়ার থেকেও রপ্তানিতে বেশি লাভ তুলেছে। দেখা গেল এ দেশের সুপ্রিম কোর্টও অস্ত্রব্যবসা সংক্রান্ত মামলায় ভারতীয় মালিকদের এই সুযোগ-সন্ধানের বিষয়টিকে বেশ গর্বের বিষয় হিসাবে বলেছে। ফলে যুদ্ধ থামলে যেমন মার্কিন পুঁজির ক্ষতি, ভারতীয় ধনকুবেরদেরও ক্ষতি।
ভারত একটা পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্রের কাজ পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করা। রাষ্ট্রের আসল মালিক পুঁজিপতি শ্রেণি যে চাইছে না যুদ্ধ বন্ধ হোক– এই রাষ্ট্রের অন্যতম অঙ্গ বিচারব্যবস্থার আচরণই তার বড় প্রমাণ। না হলে মানুষের প্রাণঘাতী যুদ্ধ থেকে সুযোগ নেওয়ার মতো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়ার লজ্জাজনক উদাহরণ ন্যায়ালয়ের মুখে আসত কি? অবশ্য, যুদ্ধের সুযোগে, মানুষের জীবনের বিনিময়ে পাওয়া মুনাফার সুযোগকে সমর্থনের রায় দিতেও ‘ঈশ্বরের নির্দেশ’ সদ্য প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি পেয়েছিলেন কি না, তিনিই বলতে পারবেন।
ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের স্বার্থে অস্ত্র ও অন্যান্য ব্যবসার প্রয়োজনে সামরিক কৌশলগত সুবিধার জন্য ভারত সরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের সাথে হাত মিলিয়ে ভারত থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইজরায়েল ছুঁয়ে ইউরোপ পর্যন্ত বাণিজ্য করিডোর বানাতে আগ্রহী। একই ধরনের সামরিক ও বাণিজ্যিক কৌশলগত স্বার্থে মার্কিন কর্তারা ইজরায়েলকে কাজে লাগিয়ে সিরিয়া, লেবানন সহ মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তীর্ণ স্থানে থাবা বসাতে চাইছে। এই বিষচক্রের নজরে পড়ে ওই অঞ্চলের মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা মদত দিয়ে আইসিসের মতো চরম মানবতাবিরোধী মৌলবাদী-সন্ত্রাসবাদীদের সৃষ্টি করেছিল। আবার তারাই প্যালেস্টাইন, লেবানন, ইয়েমেনে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য লড়াই করা সংগঠনগুলিকে সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে ইজরায়েলের বকলমে মানব ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণ্য আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। সিরিয়ায় আলকায়দা ও অইসিসের বকলামে চলা বিদ্রোহী বাহিনীকে মার্কিন কর্তারাই মদত দিচ্ছেন।
ভারতীয় শীর্ষ আদালত যে অস্ত্র কোম্পানিগুলির মুনাফার স্বার্থে গণহত্যার প্রতি চোখ বুজে থাকাকেই কার্যত সমর্থন করল, তাতে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের তুলে ধরা একটি সত্য আবার প্রমাণিত হল– কোনও রাষ্ট্রের বিচারালয় সেই রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন শাসক শ্রেণিরই প্রতিনিধিত্ব করে, মূলত তাদেরই স্বার্থ রক্ষা করে। তাই চুক্তিভঙ্গে কোম্পানি মালিকের ক্ষতি নিয়ে বিচারবিভাগ চিন্তিত, মালিকের মুনাফার টাকায় গাজার মৃত শিশুটির রক্ত লেগে থাকলে ‘ন্যায় বিচারের তুলাদণ্ড’ হেলে না! ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে ‘জনগণের বিচারপতি’ বলে পরিচিত, ভি আর কৃষiর আইয়ার বলেছিলেন, ‘বিচারব্যবস্থা তার শ্রেণিচরিত্রের জন্যই আইনের যে ব্যাখ্যা উপস্থিত করে তা সার্বিক অর্থে ধনবান শ্রেণিকেই সাহায্য করে, সম্পত্তিহীনদের নয়। সামাজিক স্তরবিন্যাস, প্রশাসকদের শাসনদণ্ড, আইনসভা এবং বিচারব্যবস্থা প্রত্যেকেরই রাজনৈতিক চরিত্র আছে।’ (পভার্টি অ্যান্ড পলিটি অফ জুডিসিয়ারি ঃ কৃষ্ণ আইয়ার, দ্য হিন্দু ২৯.১২.২০১৩, এবং দ্য হিন্দু ৪.১২.২০২১) এই সত্যটাই আজ আবার মনে পড়াচ্ছে সরকার এবং সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা।