১৪ জানুয়ারি ছ’দিনের সফরে ভারতে এসেছিলেন ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু৷ গত বছর জুলাইতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইজরায়েল গিয়েছিলেন৷ সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় ইজারেয়েলের প্রধানমন্ত্রীর এবারের ফিরতি সফর তাই আকস্মিক নয়, নির্ধারিত৷ সাইবার সন্ত্রাস–জলসম্পদ উন্নয়ন–কৃষিক্ষেত্রে উচ্চপ্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদি ৯টি বিষয়ে দু’দেশের মধ্যে মউ স্বাক্ষরিত হয়েছে এই সফরে৷ সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে দু’দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের পারস্পরিক সৌহার্দ্য প্রদর্শনের রঙচঙে বিজ্ঞাপন৷
প্রোটোকল এড়িয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনায় এক সাথে রোড শো ও ঘুড়ি ওড়ানো থেকে বাদ যায়নি৷ দুই রাষ্ট্রপ্রধানই একে অন্যকে ভাসিয়ে দিয়েছেন প্রশংসা ও স্তুতিতে৷ যেমন নরেন্দ্র মোদিকে নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘সঠিক অর্থে একজন বিপ্লবী দেশ নেতা’ বলেছেন, ভারত–ইজরায়েলের সম্পর্ক ‘স্বর্গে অনুষ্ঠিত বিবাহ, যার ঘোষণা হচ্ছে পৃথিবীতে’৷ ঠিক একই ধরনের প্রশংসা বাক্য শোনা গিয়েছিল মোদির মুখেও গত বছর ইজরায়েলে সফরের সময়৷
বোঝা যাচ্ছে, জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী হিসেবে মার্কিন ঘোষণার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রসংঘে ভারতের ভোটদানের মধ্যে যে আপাত ক্ষত তথা সামরিক চুক্তি নিয়ে যে অনিশ্চয়তার হাল্কা মেঘ তৈরি হয়েছিল– সে সব যে নেহাতই বিচ্ছিন্ন ঘটনা, সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা যে যথেষ্ট মজবুত, এটা দেখানোতেই যেন উন্মুখ ছিলেন দুই রাষ্ট্রপ্রধান৷
১৯৪৮ সালের ১৪ মে, মার্কিন–ব্রিটিশ সাম্রজ্যবাদী শাসকদের প্রত্যক্ষ মদতে আরব জনগোষ্ঠীর আপত্তি অগ্রাহ্য করে প্যালেস্টাইন ভেঙে প্রতিষ্ঠা হয় ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েলের৷ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইজরায়েল তেল সম্পদ সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে দখলদারির জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহূত হয়ে এসেছে৷ মার্কিন অর্থ ও অস্ত্রে বলীয়ান ইজরায়েল ১৯৪৮, ১৯৬৭, ১৯৭৩ – একের পর এক রক্তক্ষয়ী হানাদারিতে বিধ্বস্ত করেছে প্যালেস্টাইন–জর্ডন– সহ পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলিকে৷ জর্ডন নদীর পশ্চিম তীর বরাবর কায়েম করেছে একাধিপত্য৷ ১৯৬৭–তে আরবের ছ’দিনের যুদ্ধে মার্কিন নৌ ও বিমান বাহিনীর সাহায্যে ইজারয়েল কেড়ে নেয় মিশরের থেকে সিনাই উপদ্বীপ, জর্ডনের থেকে ওয়েষ্ট ব্যাঙ্ক এবং সিরিয়ার হাত থেকে গোলান হাইটস৷ ২০০৮ ও ২০১৪–’১৫–তে ইজরায়েলি রকেট ও বোমারু বিমান হামলায় প্যালেস্টাইনের গাজা–ভূখণ্ডের লক্ষাধিক মানুষ আহত–গৃহহীন হয়ে পড়েন৷ নিহত হন বেশ কয়েক হাজার মানুষ৷
এভাবেই বছরের পর বছর পশ্চিম এশিয়ার আরব ভূখণ্ডে বিধ্বংসী হামলা চালিয়ে চালিয়ে গণহত্যা–শিশু–নারী হত্যা–ধর্ষণ–জনপদ ধ্বংস করে যুদ্ধবাজ আগ্রাসী–জিয়নবাদী হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে ইজরায়েল৷ তোয়াক্কা করেনি রাষ্ট্রসংঘের জেনিভা কনভেনশন বা অসলো চুক্তির মতো কোনও আন্তর্জাতিক রীতি–নীতিরই৷
অপরদিকে ‘জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী হিসাবে মার্কিন ঘোষণার আনুষ্ঠানিক বিরোধিতা করেছে ভারত৷ যদিও মার্কিন মদতপুষ্ট ইজরায়েলের প্যালেস্টাইনের উপর ধারাবাহিক হামলা ও মধ্যপ্রাচ্যে দাদাগিরির বিরুদ্ধে ভারতের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ঐতিহ্য সম্পন্ন জনগণের মধ্যে ইজরায়েল বিরোধী মানসিকতা থাকলেও এদেশের শাসকশ্রেণি দীর্ঘকাল ধরে গোপনে সেই শাসক শ্রেণির সাথে বোঝাপড়া করেই চলেছে৷ ১৯৫০ সালে আইনগত স্বীকৃতি দানের পর ’৯২ সালে কংগ্রেস আমলে প্রথম দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হয় দু’দেশের মধ্যে৷ ১৯৯৬ সালে কেন্দ্রে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে বারাক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করে ইজরায়েল৷ বিশ্ববাজারে ইজরায়েল যত অস্ত্র রপ্তানি করে তার ৪১ শতাংশের ক্রেতা ভারত৷ সেই হিসাবে বর্তমানে ইজরায়েল ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহকারী দেশ৷ কয়েকশো কোটি টাকার রাফায়েল বিমান, ড্রোন ক্ষেপণাস্ত্র, স্নাইকের মতো ট্যাঙ্ক ধ্বংসে সক্ষম নিয়ন্ত্রিত অস্ত্র ইত্যাদি বহু কিছুই ভারত কেনে ইজরায়েলের থেকে৷
মার্কিন–ইজরায়েল সামরিক জোটে অর্ন্তভুক্ত হতে অতি উন্মুখ ভারতীয় একচেটিয়া পুঁজিপতিরা৷ তাই একদিকে ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ, কয়েকশো কোটি টাকার যুদ্ধ সরঞ্জাম কেনার বরাত দেওয়ার মধ্য দিয়ে সেই সম্ভাবনার দরজাই খুলে দিতে চাইছে ভারতীয় শাসকরা৷
বিশ্বজুড়ে মানবতার বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং তার দোসর ইজরায়েল যে অপরাধ করে চলেছে তার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভারতে প্রবল জনমত কাজ করত৷ ফলে শাসকদের ইজরায়েলের সঙ্গে অন্তত প্রকাশ্য দূরত্ব বজায় রাখতে হত৷ কিন্তু বাম–গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দুর্বলতা ও আর্থিক উন্নয়নের ধুয়ো তুলে, বিশ্বায়ন ইত্যাদির নামে তুমুল প্রচার ভারতীয় জনগণের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ঐতিহ্য ও চেতনাকেও দুর্বল করে দিয়েছে৷ এর সুযোগ নিয়ে ভারতীয় শাসক শ্রেণি দেশের মানুষকে ধোঁকা দিয়ে তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে এই আঁতাত করে চলেছে৷ এর সাথে জনস্বার্থের কোনও সম্পর্ক নেই৷