ভারতে ফুড ডেলিভারি শ্রমিকদের ৮৮ শতাংশই ছাত্র

ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ অ্যাপ্লায়েড ইকনমিক রিসার্চ ভারতের অনলাইন খাদ্য সরবরাহ ব্যবসায় নিযুক্ত শ্রমিকদের মধ্যে সমীক্ষা করে দেখিয়েছে, এই শ্রমিকদের ৮৮ শতাংশই ছাত্র। এক তৃতীয়াংশ কলেজ পড়ুয়া। তার ৯০ শতাংশ ন্যূনতম মাধ্যমিক পাশ।

আগে শ্রমিক বলতে বোঝাত, বেশিরভাগই অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত। এখন এ পরিস্থিতির অনেকটাই পরিবর্তন ঘটেছে। এটাকে যদি একটা অগ্রগতির সূচক ধরা হয়, তা হলে ছাত্রদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গন ছেড়ে কাজের বাজারে শ্রম বিক্রির জন্য যাওয়া, লাইন দেওয়া, অবশ্যই একটা অর্থনৈতিক দুর্দশার পরিচয় এবং গভীর উদ্বেগের। তথ্যটি জেনে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শক্তিধর অর্থনীতির দাবিদার ভারতের শাসক শ্রেণি এবং কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের কর্তারা লজ্জা বোধ করছেন কি না বলা যায় না! এটাই বাস্তব যে, এ দেশে পরিবারের সন্তানরা শিশুবয়স থেকেই কাজে না ঢুকলে বহু পরিবারে উনুন জ্বলে না। শিশুশ্রম পুঁজিবাদী অর্থনীতির অভিশাপ হিসাবে এতদিন ছিল। এখন তার সাথে যুক্ত হতে চলেছে ছাত্র নামটিও। এটা কি অগ্রগতি? উন্নয়ন?

শিক্ষান্তে চাকরি ছিল এক সময় ছাত্র-যুব আন্দোলনের অন্যতম দাবি। এখন আর্থিক পরিস্থিতির এত অবনমন ঘটেছে যে, ছাত্ররা শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্যই শ্রমিকদের দলে নাম লেখাচ্ছে। এর পিছনে রয়েছে পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন-বেসরকারিকরণের ভূমিকা। নব্বইয়ের দশকে আজকের ‘ইন্ডিয়া’ জোটের ইঞ্জিন কংগ্রেসের মনমোহন সিংহের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার বিশ্বায়নের তত্ত্ব আমদানি করে এবং সেই অনুযায়ী সরকারি সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ, শিক্ষা সহ পরিষেবা ক্ষেত্রগুলির বাণিজ্যিকীকরণের যে পথ নেয় তার ফলেই শিক্ষা আজ হয়ে উঠেছে অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সাবজেক্টগুলিও হয়ে গেছে সেল্ফফিনান্সিং। সেমেস্টার নামক যে বিভাজন করা হয়েছে সেটাও কর্তৃপক্ষের টাকা রোজগারের পথ সুগম করেছে। যত বেশি সেমেস্টার হচ্ছে, সেই অনুযায়ী প্রতিটি সেমেস্টারের জন্য টাকা দিতে হচ্ছে। কতজন অভিভাবক পারে এই বিপুল খরচ বহন করতে? স্বাভাবিক ভাবেই ছাত্ররা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গন ছেড়ে শ্রমের বাজারের নতুন বিক্রেতা।

শিক্ষার বেসরকারিকরণের এই যে মনমোহিনী পথ তাতেই রথ ছুটিয়েছেন বিজেপির অটলবিহারী বাজপেয়ী থেকে নরেন্দ্র মোদি। আর ইতিহাসের পাতা ওল্টালে চোখে পড়ে নব্বইয়ের দশকে সিপিএম নেতাদের বাণী– বিশ্বায়নের সুফল নিতে হবে। সিপিএম কথিত বিশ্বায়নের এই সুফল তত্ত্ব শুনতে শুনতে যারা বিভ্রান্ত হয়ে বিশ্বায়নের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, আজ তারা বেদনার সাথে লক্ষ করছেন, এ পথ দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

ফুড ডেলিভারি এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসা। বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি এ ব্যবসায় ঢুকে বিপুল মুনাফা করছে। সমীক্ষাটি তুলে ধরেছে এই শ্রমিকদের বেতন বঞ্চনার ভয়াবহ চিত্র। গড়ে প্রায় ১১ ঘণ্টার মতো এদের ডিউটি করতে হয়। বাধ্যতামূলক ভাবে বাইক, স্মার্টফোন, কোম্পানির ইউনিফর্ম কিনতে হয়। বাইক চালাতে চড়া দামে ডিজেল কিনতে হয়। এই আবশ্যিক খরচগুলি বাদ দিয়ে ১১/১২ হাজার টাকা থাকে মাসিক রোজগার।

ভারতের পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ মিলিয়ে ২৮টি বড় ও মাঝারি শহরে ৯২৪ জন ফুড ওয়ার্কারের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে ছাত্র-শ্রমিকদের এই বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরেছে সংস্থাটি।

এই বঞ্চনা ছাত্র-শ্রমিকরা মেনে নিচ্ছে না। কাজ করতে করতেই দেশের নানা প্রান্তে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন গড়ে তুলছে তারা। একদিকে কোম্পানির অতি মুনাফার লোভ থেকে বেতন বঞ্চনা, বিপরীতে শ্রমিকদের বাঁচার মতো মজুরির দাবি– লড়াইটা তাই একেবারে মুখোমুখি। (সূত্রঃ দ্য হিন্দু, ১৫.০৯.২০২৩)

About suphal