ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ ভারতের মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে লোহা, তামা, অ্যালুমিনিয়াম, বক্সাইট খনিজ আকরিক সমৃদ্ধ এলাকা হিসাবে। অথচ এই এলাকার মানুষের সমৃদ্ধির ছবি শত খুঁজেও পাওয়া যায় না। চূড়ান্ত দারিদ্রপীড়িত এই অঞ্চলের মানুষের হাড়জিরজিরে ছবি দেখলে আফ্রিকার কোনও দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশের কথা মনে এসে যায়।
দ্রৌপদী মুর্মু রাষ্ট্রপতি হওয়ায় ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার রাইরঙ্গপুর কিছুটা হলেও প্রচারের আলোতে এসেছে। অথচ এই অঞ্চলটি এক শতাব্দীরও বেশি আগে থেকে লৌহ আকরিক সহ নানা খনিজ দ্রব্যের ভাণ্ডার হিসেবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। আদিবাসী অধ্যুষিত এই এলাকায় খনিজ সম্পদকে কেন্দ্র করে বিশাল শিল্পাঞ্চলও গড়ে ওঠে সে সময়। তা সত্তে্বও অশিক্ষা, দারিদ্রের অন্ধকারেই ডুবে রয়েছে গোটা এলাকা।
বর্তমান রাষ্ট্রপতি এবং পূর্বতন বিজেপি বিধায়ক দ্রৌপদী মুর্মুর বাড়ি রাইরঙ্গপুরে। ২০০০ সালের আগে থেকেই তিনি ছিলেন বিজেপির নেতা। ২০০০-০৯ দীর্ঘ দশ বছর রাইরঙ্গপুরে বিজেপির বিধায়ক থাকা সত্ত্বেও এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা উন্নয়নে কোনও পদক্ষেপ নেননি তিনি।
রাইরঙ্গপুর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গরুমহিষানিতে রয়েছে ভারতের প্রথম লৌহ আকরিক খনি। টাটা স্টিলের অধীনস্থ এই খনিটি ইস্পাত ব্যবসার জগতে ‘মাদার মাইন’ হিসেবে পরিচিত। এখানে প্রতি বছর ৩৪ মিলিয়ন টন লোহা উৎপন্ন হয়। ১৯০৪ সালে এই লৌহ আকরিক থেকে লোহা নিষ্কাশনের কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়, পরে জামসেদপুরে টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি তৈরি হয়। গরুমহিষানি পাহাড়ে লোহার খনি থাকা সত্তে্বও সাধারণ মানুষের দারিদ্র ঘোচেনি। ওড়িশায় দীর্ঘদিন শাসন ক্ষমতায় থাকা বিজেপি সমর্থিত বিজেডি সরকার এলাকাবাসীর অর্থনৈতিক মান উন্নয়নে কোনও চেষ্টাই করেনি। বাইরে থেকে কারখানায় কিছু শ্রমিক নিয়োগ করেছে। দরিদ্র, আর্থিক দিক থেকে দুর্বল স্থানীয় মানুষ কতটুকু সুযোগ পেয়েছে?
১০০ বছরের পুরনো এই খনি শহরে টাটা গোষ্ঠী ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য তৈরি করেছে রেললাইন, রোপওয়ে, জলাধার, স্কুল-কলেজ। এই শহরের সাথে খনি এমন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে যে এখানকার প্রথম কলেজের নাম আয়রন কলেজ। অথচ শিল্পাঞ্চল এলাকার জল সরবরাহ ব্যবস্থা থেকে খাদ্যের জোগান দেওয়া, তাকে ঘিরে থাকা যে গ্রামগুলি তাদের উপর দিয়ে বিদ্যুতের তার, রেলের লাইন গেলেও সেগুলিতে উন্নয়নের আলো পৌঁছয়নি। প্রবীণদের অভিজ্ঞতা, সেই সময় ওড়িশায়, এমনকি সারা ভারতে খুব কম জায়গাতেই প্যাসেঞ্জার ট্রেন চলত। গরুমহিষানিতে ১৯১১ সাল থেকে প্যাসেঞ্জার ট্রেন চালু হয়। খনি অঞ্চলে বিদ্যুৎ পরিষেবা চালু করে টিসকো। বলা বাহুল্য, রেল, স্কুল, কলেজ, বিদ্যুৎ– এ সব পরিষেবা পুঁজিপতি টাটা ওড়িশার গরিব জনসাধারণের প্রয়োজনে করেনি। নিজেদের ব্যবসাকে সম্প্রসারিত করতেই তারা এ সমস্ত করেছিল, যাতে শ্রমিকরা তাদের পরিবার় নিয়ে এখানে বাস করে কারখানায় তাদের শ্রম নিংড়ে দিতে পারে।
শ্রমিক-জোগানদার এবং খনির কন্ট্রাকটর হিসেবে এখানে কাজ করতেন রুদ্র নারায়ণ মহান্তি। বললেন, পাঁচ হাজারের বেশি শ্রমিক গরুমহিষানিতে কাজ করতেন। আগে তাঁদের রেশন– চাল, গম, কয়লা, কাঠ এবং জল দেওয়া হত নিয়মিত। তখন তাঁরা কিছুটা স্বচ্ছন্দেই জীবন যাপন করতেন। খনিতে একসময় কাজ করতেন ৯০ বছরের আশা মহাকুদ। তিনি বলেন, ‘আমার ঠাকুমা টিসকোর খনিতে কাজ করতেন এবং যন্ত্রপাতি ছাড়াই লৌহ আকরিকের টুকরো বাছাই করতেন। আমার বাবাও কাজ করতেন। কারখানায় আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারে আমার কাজ চলে যায়।’ বংশপরম্পরায় খনিতে কাজ করেই মহাকুদ পরিবার স্বচ্ছন্দে জীবন যাপনের জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করে চলেছে। ১৯৪০-৫০ সালে খনি শ্রমিক আশা মহাকুদ দিনে ১-২ টাকার বিনিময়ে কাজ করতেন, এখন বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর দিন গুনছেন। এরকম অবস্থা অসংখ্য শ্রমিকের। অথচ প্রায় প্রতিটি রাজ্যে টাটা স্টিল, টাটা মোটরসের কারখানা রমরমিয়ে চলছে। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশের বাজারেও টাটা মোটরসের ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠেছে।
স্থানীয় মানুষ টাটা গোষ্ঠীর কাছে এলাকা উন্নয়নের দাবি জানিয়েছেন বারবার। টাটা গোষ্ঠীর তৎকালীন কর্ণধার কিংবা বর্তমান কর্তারা শ্রমিকদের দিয়ে আকরিক লোহা তোলার কাজ করিয়ে বিপুল মুনাফা করছেন। কারখানার দিনে দিনে শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে শ্রমিকের ঘাম-রক্ত ঝরা শ্রমের বিনিময়েই। কিন্তু শতাব্দী প্রাচীন এই লৌহ আকরিক কারখানার শ্রমিক এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলের জনসাধারণের জীবন মানের উন্নয়ন হয়নি এতটুকুও। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে এটাই প্রাপ্তি (!) তাদের।
(সূত্রঃ দ্য হিন্দু, ২২ জুলাই, ২০২২)