সম্প্রতি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ‘ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন যে, তাঁর পূর্বসূরি জো বাইডেনের আমলে ইউ এস এড (ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট) সংস্থা ভারতে গত লোকসভা নির্বাচনে ভোটের হার বাড়াতে ২১ মিলিয়ন ডলার (১৮২ কোটি টাকা) খরচ করেছিল। ‘ট্রাম্প এমনও ইঙ্গিত করেছেন যে, এই টাকা বাইডেন প্রশাসন মোদি নয়, অন্য কাউকে জেতানোর জন্য খরচ করে থাকতে পারে।’ স্বভাবতই এই মন্তব্য ঘিরে শোরগোল উঠেছে, বিজেপি আর কংগ্রেস পরস্পরের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলছে।
বিজেপি বলছে, লোকসভা নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালে রাহুল গান্ধী ব্রিটেনে গিয়ে আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোর কাছে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অনুরোধ করেছিলেন। বাইডেন জমানায় ভারতের মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতার লঙ্ঘন, সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ নিয়ে বারবার আমেরিকার নানা সংস্থা নয়া দিল্লিকে দোষারোপ করেছে। অতএব বিজেপির বক্তব্য হল– দুয়ে দুয়ে চার করলে বোঝা যায়, কংগ্রেসের ঝুলিতে ইউএসএড ঢোকার সম্ভাবনা প্রবল।
কিন্তু বিজেপির ঝুলি কি ফাঁকা? ‘ট্রাম্প সাহেব তো এও বলেছেন যে, মার্কিন সাহায্য এসেছে বন্ধু নরেন্দ্র মোদির কাছেই।’ যদিও মোদি এবং ট্রাম্পের নিবিড় সখ্যতা নতুন কিছু নয়, তাও আর্থিক লেনদেন নিয়ে নতুন করে এই ‘বন্ধুত্বে’র স্বীকৃতিতে বিপাকে পড়েছে বিজেপি। দাবি উঠেছে, ভারতে ইউএসএডের কাজকর্ম নিয়ে মোদি সরকার সংসদে শ্বেতপত্র প্রকাশ করুক।
ইউএসএড কী? আমেরিকা সরকারেরই একটি সংস্থা, যারা বিভিন্ন দেশকে ‘উন্নয়নে’ সাহায্য করে। ১৯৬১ সালে তৈরি এই সংস্থা কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন দেশের সরকারি বেসরকারি সংস্থাকে সাহায্য করে আসছে। বলাই বাহুল্য, বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের শিরোমণি মার্কিন রাষ্ট্র এই ‘সাহায্য’ বিনা প্রতিদানে কোনও মহৎ উদ্দেশ্য থেকে করছে না। তা হলে করছে কেন? ভারতে নানা প্রকল্পে মূলত ইউএসএডের মাধ্যমে গত ছয় দশকে ৫৫৫টি ক্ষেত্রে ১৭০০ কোটি ডলার অর্থসাহায্য করেছে মার্কিন প্রশাসন। স্বাভাবিক ভাবেই এই সময় সরকারে আসীন ছিল কংগ্রেস, বিজেপি প্রভৃতি একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্নেহধন্য দলগুলো। গত বছর ২৬ জুলাই অর্থ মন্ত্রকের দেওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের বার্ষিক রিপোর্টেই (পিটিআই প্রকাশিত) উল্লেখ রয়েছে যে ইউএসএডের ৭৫০ মিলিয়ন ডলার বাজেটের ৭টি প্রকল্প চলছে ভারতে। অথচ, এই রিপোর্টের একটি প্রকল্পও ভোটের হার বাড়ানোর সাথে সম্পর্কিত নয়। তা হলে কোথায় কী উদ্দেশ্যে খরচ হল এই বিপুল পরিমাণ টাকা? নরেন্দ্র মোদি কথায় কথায় ভারতের মিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির গল্প শোনান। তা হলে একটি স্বাধীন এবং বিজেপি কথিত ‘আত্মনির্ভর’ দেশের নির্বাচনে এতখানি বিদেশি পুঁজির প্রয়োজনই বা হল কেন?
বুর্জোয়াদের বিশ্বস্ত দুই দলের মধ্যে চাপান উতোর যাই চলুক, মার্কিন ডলার আসার অভিযোগ কিন্তু বিজেপি বা কংগ্রেস কেউই অস্বীকার করতে পারেনি। কাজেই, ঝুলিতে বিড়াল আছে এ কথা পরিষ্কার। নির্বাচনে টাকার খেলা আজ আর অন্য অনেক দেশের মতোই এ দেশে নতুন কিছু নয়। দেশের ভোটসর্বস্ব দলগুলো যে পুঁজিপতিদের টাকায় ক্ষমতায় এসে তাদেরই স্বার্থরক্ষা করে এ-ও আজ বহু মানুষের জানা। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি বক্তৃতায় যে গণতন্ত্রের গর্ব করেন, বিরোধী দল হিসেবে কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে যে গণতন্ত্র রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেয়, বুর্জোয়া রাজনীতির পরিভাষায় নির্বাচন তো সেই ‘গণতন্ত্রের উৎসব।’ তা হলে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও মেনে চললে, নির্বাচনের খরচ-খরচা সম্পর্কে দেশের সাধারণ মানুষকে জবাবদিহি করতে তারা বাধ্য। তাই মানুষের দাবি, সত্য প্রকাশিত হোক। নাগরিক সমাজ জানতে চায়, বিদেশি টাকা ভারতের নির্বাচনে কোথায় কতখানি কী ভাবে ব্যবহার হয়েছে, কারাই বা এ থেকে লাভবান হয়েছেন তা প্রকাশ্যে আনা হোক।