ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব কেবল যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব সাধন করিয়া জনসাধারণকে ধর্মের বন্ধন হইতে মুক্ত করিয়া সমাজের গণতন্ত্রীকরণের ব্যাপারে নিশ্চেষ্ট ছিল তাহাই নহে, পক্ষান্তরে ইহা ধর্মকে জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ প্রচারের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করিয়াছিল। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সেইহেতু ধর্মীয় প্রভাবে আচ্ছন্ন ছিল।
এই ধর্মীয় প্রভাবে আচ্ছন্ন জাতীয়তাবাদ (রিলিজিয়ন ওরিয়েন্টেড ন্যাশনালিজম) অভিব্যক্ত হইয়াছিল হিন্দুধর্মের রিভাইভ্যালিজমের রূপে। এই হিন্দুত্ব পুনরুজ্জীবনবাদী (হিন্দু রিভাইভ্যালিস্ট) ভারতীয় জাতীয়তাবাদ অ-হিন্দু জনতার মনে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে প্রধানত ইহাই তাহাদের, বিশেষত মুসলিম জনতাকে এদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন হইতে দূরে সরাইয়া রাখিবার জন্য দায়ী। অধিকন্তু ইহার ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের ও জাতীয়তাবাদবিরোধী সাম্রাজ্যবাদের দালাল মুসলিম নেতাদের পক্ষে মুসলিম জনতাকে এ কথা বোঝানো অনেক সহজ হইয়াছে যে, কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসন হইতে মুক্ত হইলে হিন্দুদের স্বৈরাচারী শাসন অপেক্ষা ভিন্ন কিছু হইবে না, যেখানে মুসলিমদের কোনও নিরাপত্তা বা ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীনতা থাকিবে না।
এমতাবস্থায় প্রাক-বিভাগ ভারতে মুসলিমরা যে পৃথক নিজস্ব দেশের দাবি তুলিয়াছিল তাহার জন্য নিজেদের ত্রুটির দিক লক্ষ না করিয়া সম্পূর্ণ দোষ কেবলমাত্র তাহাদের ঘাড়ে চাপানো কি ভুল হইবে না? আর শুধু মুসলিমদের কথাই বা বলি কেন? তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দুদের বেলাতেই বা কী হইয়াছে? সামাজিক বা সাংস্কৃতিক বিপ্লব সম্পূর্ণ না হওয়ার ফলে হিন্দুসমাজের পশ্চাদ্পদ অংশের জনসাধারণ শুধুমাত্র ধর্মীয় কুসংস্কারেই আবদ্ধ থাকে নাই, উপরন্তু তাহাদিগকে তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভুত্বের অকথ্য অত্যাচার সহ্য করিতে হইয়াছে।
এই দিক হইতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এমনকী হিন্দু রিভাইভ্যালিজম-এর উদারনৈতিক রূপও প্রকাশ করিতে পারে নাই।
সাম্প্রদায়িক সমস্যা প্রসঙ্গেঃ শিবদাস ঘোষ
এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪২ সংখ্যা ৩০ মে – ৫ জুন ২০২৫ এ প্রকাশিত