রামমোহন (১৭৭২-১৮৩৩) ছিলেন সে সময়ের এক আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। যাঁর যুক্তিশাণিত লেখা পড়ে ভারতের চিন্তাশীল মানুষ তো বটেই এমনকি ইউরোপের বিদদ্ধজনেরা বিস্মিত হচ্ছেন। শেলি, কোলরিজের মতো কবিরা তাঁর চিন্তার সংস্পর্শে আসছেন। সমাজ প্রগতির ধারা নিয়ে রবার্ট আওনের সঙ্গে তাঁর বিতর্ক হচ্ছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কথা প্রসঙ্গে তিনি ভারতের শ্রমজীবী মানুষের যন্ত্রণার কথা উল্লেখ করছেন। কী ভাবে ভারত অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হচ্ছে, তথ্য প্রমাণ সহ তুলে ধরছেন তাও। ফ্রান্সের জুলাই (১৮৩০) বিপ্লবের গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতিষ্ঠাকে উচ্ছ্বসিত স্বাগত জানাচ্ছেন। এই বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন লুই ফিলিপ তাঁকে দেখার জন্য ডিনারে আমন্ত্রণ করছেন, সংবর্ধনা দিচ্ছেন। কেউ তাঁর নামে সন্তানের নামকরণ করছেন। তাঁর সাথে একটি বার দেখা করার জন্য সারা রাত অপেক্ষা করছেন কেউ কেউ। কিন্তু প্রতিভার ব্যাপ্তি আন্তর্জাতিক হলেও তাঁর পা ছিল সব সময় ভারতের মাটিতেই, কর্মক্ষেত্র ছিল সুনির্দিষ্ট। অর্থাৎ কন্টেন্ট ছিল দেশীয় কিন্তু ফর্মটা ছিল তখনকার অর্থে আন্তর্জাতিক। এজন্যই ১৮৩২ সালে একটা চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘The Struggles are not merely between reformers and anti-reformers, but between liberty and tyranny throughout the world, between justice and injustice and between right and wrong’ এই মন নিয়েই রামমোহন রায় ভারতের সমাজকে অন্ধকারমুক্ত করতে প্রাণ হাতে নিয়ে এগিয়ে আসেন। ভারতীয় নবজাগরণ আন্দোলনের মহান এবং ঐতিহাসিক সূচনা করেন।
ধর্ম সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধতা করায় পরিবার প্রতিবেশীর বিরাগভাজন হয়েছিলেন রামমোহন রায়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে নানা প্রদেশে ঘুরেছেন, অর্জন করেছেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা। দেখেছেন সর্বত্রই মানুষে মানুষে নির্মম ভেদাভেদ, সাধারণ মানুষের উপর ধর্মের নামে নৃশংস অত্যাচার। পদে পদে মনুষ্যত্বের অবমাননা তাঁকে কাঁদিয়েছে। তবে বেদনা বিমর্ষ করতে পারেনি তাঁকে। বরং কার্যকরী জ্ঞানচর্চা থেকে অনিবার্য রূপে প্রস্ফুটিত হয় যে সক্রিয় সামাজিক দায়িত্ববোধ তা তাঁকে বলীয়ান করেছে অফুরান মাত্রায়।
যেসব ধর্মগ্রন্থের দোহাই দিয়ে ধর্মগুরুরা সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের উপর চলা শাসন শোষণের সমর্থন করে সে সমস্ত সহ তৎকালীন আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান দর্শনের বইপত্র রামমোহন পড়েছিলেন। পড়ে আত্মস্থ করার জন্য আরবি, ফার্সি, উর্দু, গ্রিক, ল্যাটিন, সংস্কৃত, ইংরেজি ইত্যাদি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন মাতৃভাষার মতোই। প্রয়োজনের নিরিখে আরবিতে লিখেছেন ‘নানা ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা’ (মানাজারাতুল আদিয়ান)।
তার পর ১৮০৪ সালে ফার্সিতে লিখলেন, ‘একেশ্বর-বিশ্বাসীদিগকে উপহার’ (তুহফৎ-উল-মুওয়াহিদ্দিন)। এই বইটির ছত্রে ছত্রে যা আছে সেগুলো বলে দেয় কেন রামমোহন ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ, ‘ভারতপথিক’, ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ বা আধুনিক ভারতের জনক। প্রায় দুশো কুড়ি বছর আগে এ দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে রামমোহন এই বইতে লিখেছেন, ‘মানুষ নিজ নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে বেড়ে উঠে তারই অনুকরণে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের বিধানগুলিকেই চিরন্তন সত্য বলে বিশ্বাস করে। …কার্য ও কারণের ক্রমপরম্পরায় অনুসন্ধানে অভ্যস্ত না থাকাতে তারা কোনও বিশেষ নদীতে স্নান করা কিংবা কোনও গাছ বা পাথর পূজা জপ-তপ এবং পুরুতদের কাছ থেকে অপরাধের জন্য প্রায়িচত্ত মার্জনাদি কাঞ্চনমূল্যে কিনে নেওয়াকে (বিভিন্ন ধর্মের বিশেষত্ব অনুসারে) সারা জীবনের পাপক্ষালনের ও মুক্তির উপায় বলে বিশ্বাস করে। … এই কাল্পনিক বস্তুগুলির যদি সত্যিকার কোনও গুণ থাকত তবে তা ভিন্ন ভিন্ন মতাবলম্বী সকল জাতের লোকের উপরই সমভাবে ফলপ্রসূ হত, কোনও বিশেষ জাতের বিশ্বাস ও অভ্যাসের মধ্যেই আবদ্ধ থাকত না। কারণ, যদিও ফলের মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন লোকের সামর্থে্যর তারতম্যের উপর নির্ভর করে, কিন্তু তা বলে কোনও বিশেষ মতাবলম্বীর উপর নির্ভর করে না। দেখতে পাও না কি, কেউ যদি মিষ্টি মনে করে বিষ খায় তবে বিষেরই ক্রিয়া হয়, আর তাতে প্রাণ যায়।’
এই বইতে রামমোহন লিখেছেন, ‘ভারতের বর্তমান যুগের অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃতিক বস্তুতে বিশ্বাস এত বেড়েছে যে লোকে যখনই কোনও আচর্য বস্তু দেখে তখনই সেটি তাদের পৌরাণিক যুগের বীরগণের কিংবা বর্তমানের সাধু সন্ন্যাসীদের উপর আরোপ করে এবং তার সুস্পষ্ট কারণ বর্তমান থাকলেও সেটা অগ্রাহ্য করে। কিন্তু তার কারণ তো যাদের সুস্থ মন, যারা ন্যায়ানুরাগী তাদের কাছে প্রচ্ছন্ন থাকে না। ইওরোপের লোকদের অনেক অত্যাচর্য আবিষ্কার, বাজিকরের হাতসাফও নৈপুণ্য প্রভৃতি এমন অনেক জিনিস আছে, যার কারণ দৃশ্যত যেন অজ্ঞাত এবং মানববোধ শক্তির বহির্ভূত বলেই মনে হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের শিক্ষাজাত তীক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে যদি দেখা যায় তা হলেই এই আপাত গুহ্য কারণগুলি বেশ সন্তোষজনক ভাবেই জানা যায়। এই সন্ধান পেলে অতিপ্রাকৃতিক ঘটনায় বিশ্বাসী (লোকের) দ্বারা বুদ্ধিমান লোকেরা আর প্রভাবিত হবেন না। তবে এ বিষয়ে আমরা বড় জোর এই বলতে পারি যে কোনও কোনও ব্যাপারে তীক্ষ্ম গভীর অনুসন্ধান সত্তে্বও অনেক আচর্য ঘটনার কারণটা লোকের অজ্ঞাত থেকেই যায়। সেসব ক্ষেত্রে আমাদের সুযুক্তির উপর নির্ভর করা উচিত এবং নিজেকে এই প্রশ্নই করা উচিত যে এর কারণটার জন্য আমাদের বুঝবার বর্তমান অক্ষমতাই দায়ী, না প্রাকৃতিক নিয়মের বহির্ভূত অসম্ভব কোনও মাধ্যমের উপর আরোপ করা যুক্তিসঙ্গত। আমি মনে করি যে আমাদের সুযুক্তি প্রথমোক্ত পন্থা বেছে নেবে। তা ছাড়া শত শত বছর আগে কোন মরা মানুষকে বাঁচিয়ে তোলা হয়েছে, বা কেউ স্বর্গারোহণ করেছে ইত্যাদি অসম্ভব ও অযৌক্তিক ব্যাপারের তথ্যানুসন্ধান করবার এমন কী দরকার পড়েছে?’
এই বইটিতে রামমোহন লিখেছেন, ‘সাধারণ লোক প্রচলিত মতের দ্বারাই অভিভূত হয়। তাদের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক যে যখন তারা এমন কোনও কিছু দেখতে পায় যার রহস্য তাদের বুদ্ধির অগম্য অথবা যার কোনও কারণ দেখতে পায় না তখন তারা ইহা এক অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃতিক শক্তির ক্রিয়া বলে বর্ণনা করে। এর রহস্য আসলে এই যে জগতের যাবতীয় বস্তুর বর্তমানতাই কোনও না কোনও আপাত কারণের এবং বিভিন্ন অবস্থার ও ন্যায় বিধির উপর নির্ভর করে। সুতরাং আমরা যদি কোনও বস্তুর ভালো ও মন্দের মুখ্য ও গৌণ কারণ সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিবেচনা করে দেখি তবেই আমরা বলতে পারি যে ওই বস্তুর সত্ত্বার সঙ্গে সমস্ত বিশ্বই অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। কিন্তু যখন অভিজ্ঞতার অভাবে এবং মতের সংকীর্ণতার জন্য কোনও কিছুর কারণ কারও কাছে অপ্রকাশিত থাকে তখন তার সুযোগ নিয়ে অন্য যে-কোনও মতলবী মানুষ স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই সব ঘটনাকে নিজের অলৌকিক শক্তি বলে বর্ণনা করে তার দলেই লোককে আকর্ষণ করে।’ এই বইতেই রামমোহন লিখেছেন, ‘…একটা উক্তির সত্যতা শুধু উক্তিটির পরিপোষকদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপর নির্ভর করে না।… সত্যানুসন্ধিৎসুদের দ্বারা ইহা স্বীকৃত হয়েছে যে একমাত্র সত্যই সংখ্যাগরিষ্ঠদের বিরুদ্ধে হলেও পালনীয়।’
ভক্তিবাদের বিরুদ্ধে যুক্তিবাদ, বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বিচার বিশ্লেষণের মন গড়ে তোলার সংগ্রামের সাথে সাথে ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি অসম সাহসিকতায় লড়াই শুরু করেছিলেন। সতীদাহ প্রথা, নারী শিক্ষা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, পৈতৃক সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে তিনি আজীবন লড়েছেন।
ভারতের জমিদারি ও রায়তোয়ারি ব্যবস্থায় কৃষকদের দুরবস্থা সম্পর্কে ১৮৩২ সালে রামমোহন লিখেছেন, ‘দুই ব্যবস্থাতেই কৃষকদের পরিস্থিতি অত্যন্ত দুঃখজনক। একটিতে তাঁরা জমিদারের লোভ লালসার শিকার। অন্যটিতে তাঁদের বহন করতে হয় জরিপকারী ও রাজস্ব বিভাগের অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের শোষণ ও চক্রান্তের বোঝা। দুক্ষেত্রেই আমার গভীর সহানুভূতি তাঁদের প্রতি– পার্থক্য শুধু এই যে, বাংলার কৃষকদের ক্ষেত্রে জমিদারেরা তাঁদের রাজস্ব সাব্যস্তের সময় সরকারের তরফ থেকে দাক্ষিণ্য ভোগ করে থাকেন কিন্তু সে দাক্ষিণ্যের এক অংশও প্রসারিত হয় না গরিব কৃষকদের বেলায়। ভালো ফসলের দিনে যখন ফসলের দাম পড়ে যায় তখন তাঁদের পুরো ফসলটাই বেচতে হয় জমিদারের খাই মেটাতে— বীজধান বা মেহনতি মানুষ বা তাদের পরিবারের পোষণের জন্য প্রায় কিছুই থাকে না।’
আধুনিক চিন্তাচর্চা করলেও লড়াইয়ের পথে ধর্মবিশ্বাসকে পুরোপুরি ছাড়তে পারেননি রামমোহন। রামমোহনই প্রথম যিনি লড়েছিলেন সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য। বিকশিত করতে চেয়েছিলেন বাংলা গদ্যকে। মান্ধাতা আমলের সংস্কৃত শিক্ষার পরিবর্তে ভারতের তরুণ প্রজন্মকে তিনি শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন আধুনিক শিক্ষায়, যে শিক্ষা বিনা বিচারে মেনে নিতে শেখাবে না বরং প্রশ্ন করতে শেখাবে, বিচার বিবেচনা করে গ্রহণ বর্জন করতে শেখাবে।
এই সব কারণে ধর্মীয় মৌলবাদীদের কাছে রামমোহন আজও সাক্ষাৎ এক আতঙ্ক। আরএসএস-বিজেপি’র নেতারা আজও তাঁকে গালিগালাজ করে চলেছেন। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার নির্মাণে রামমোহনের অবদান সংগ্রামী মানুষ কোনও ভাবে ভুলবে না। তাঁর ঘটনাবহুল জীবন সংগ্রাম থেকে প্রাসঙ্গিক শিক্ষা গ্রহণ করে বর্তমান যুগের সমাজ সংস্কার বা সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনকে শক্তিশালী করাই উত্তরাধিকারীর কর্তব্য।
ভারতবর্ষের নবজাগরণের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায়ের ২৫০তম জন্মবর্ষপূর্তি উপলক্ষে ২২ মে হুগলি জেলার খানাকুলে এই মহান মনীষীর বসতবাড়ি থেকে তাঁর জন্মস্থান পর্যন্ত সুসজ্জিত পদযাত্রার আয়োজন করে রাজা রামমোহন রায় সার্ধদ্বিশত জন্মবার্ষিকী পালন কমিটি। তাঁর মূর্তিতে গার্ড অফ অনার প্রদর্শন করে ছাত্র-ছাত্রীরা। পদযাত্রায় পাঁচ শতাধিক ছাত্র-যুব মহিলা শিক্ষক স্বাস্থ্যকর্মী রামমোহন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্ধৃতি সহ প্ল্যাকার্ড নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। পদযাত্রার সূচনা করেন বিশিষ্ট চিকিৎসক এবং কমিটির সম্পাদক ডাঃ তুষারকান্তি পাকিরা। মিছিলের শেষে সকল পদযাত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন কমিটির সভাপতি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও লেখক ডঃ পরেশচন্দ্র দাস। এরপর সেখানে একটি বিনামূল্যে চিকিৎসা শিবিরে ৪ শতাধিক রোগীর চিকিৎসা করা হয়। এআইডিএসও-এআইডিওয়াইও-এআইএমএসএস-কমসোমল এবং পথিকৃৎ-এর উদ্যোগে রাজ্যের নানা স্থানে রামমোহন রায়ের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান, পদযাত্রা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতার ভারত সভা হলে পাঁচটি সংগঠন আয়োজিত সভায় আলোচনা করেন এস ইউ সি আই (সি) পলিটবুরো সদস্য কমরেড অমিতাভ চ্যাটার্জী। সভা পরিচালনা করেন এআইএমএসএস-এর রাজ্য সম্পাদক কমরেড কল্পনা দত্ত। সভায় প্রোগ্রেসিভ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। |