
হাতে হাতকড়া, পায়ে শিকল। যন্ত্রণা, অপমান, হতাশা আর আশঙ্কায় নুয়ে পড়েছে মাথা। দেশে ফিরলেন সর্বস্বান্ত ১০৪ জন অভিবাসী ভারতীয়। বিদেশে পশু চালান দিতেও যেটুকু স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করতে হয়, ভারতীয়দের জন্য এটুকু ব্যবস্থা নেওয়ারও তোয়াক্কা করেননি আমাদের প্রধানমন্ত্রীজির পরম বন্ধু নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ৪০ ঘণ্টা ধরে সামরিক বিমানে উড়িয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি হরিয়ানা, গুজরাট, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র ও উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা এই মানুষগুলিকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে ভারতের অমৃতসর বিমানবন্দরে। এঁদের মধ্যে আছেন ১৯ জন মহিলা ও ১৩টি শিশু।
ভারতীয় হিসেবে দেশের মানুষের এমন অপমানে দেশবাসীর মাথা যখন লজ্জায় নিচু হয়ে যাচ্ছে তখন সংসদে দাঁড়িয়ে বিদেশমন্ত্রী আমেরিকার দোষ ঢাকতে সওয়াল চালিয়ে গিয়েছেন। বলেছেন, বেআইনি অভিবাসীদের দেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে ওখানকার নাকি এমনই নিয়ম। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মুখে যথারীতি কথাটি নেই।
এই ১০৪ জনের অপরাধ ছিল একটাই– যে কোনও উপায়ে একটা কাজ জোগাড় করে দু-মুঠো খাবারের সংস্থান করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। চেয়েছিলেন পরিজনদের নিয়ে একটা সুস্থিত জীবন কাটাতে। দেশে কাজ পাওয়া দুষ্কর। তাই চাষের জমি বেচে, বাড়ি কিংবা সোনার গয়না বন্ধক দিয়ে, সারা জীবনের যাবতীয় সঞ্চয় উজাড় করে জোগাড় করা লক্ষ লক্ষ টাকা তাঁরা তুলে দিয়েছিলেন এজেন্টদের হাতে। ভরসা ছিল, এদের হাত ধরে আমেরিকায় ঢুকে যেতে পারবেন তাঁরা। আর তারপর কোনও রকমে একটা কাজ জুটিয়ে নিতে পারলেই মিলবে নিশ্চিন্ত জীবন।কতখানি নিরুপায় হলে মানুষ এতখানি ঝুঁকি নেয়, বুঝতে অসুবিধা হয় না।
এরপর এজেন্টের কথামতো কেউ কাতারে পৌঁছেছেন, কেউ বা দুবাইয়ে। তারপর তাঁদের শামিল হতে হয়েছে এক ভয়ংকর অভিযানে। আমেরিকায় পৌঁছে যে কোনও ভাবে একটা কাজ পাওয়ার স্বপ্ন ধাওয়া করতে করতে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ধরে তাঁরা একটার পর একটা পাহাড় ডিঙিয়েছেন। গভীর জঙ্গলের বিপদসংকুল পথ ধরে হেঁটেছেন মাইলের পর মাইল। পথকষ্টে মৃত সাথীকে রাস্তায় ফেলে রেখেই কান্না গিলে এগিয়ে যেতে হয়েছে তাঁদের। ডিঙি নৌকায় প্রাণ হাতে করে সমুদ্র পাড়ি দিয়েছেন। পার হয়েছেন দক্ষিণ আমেরিকার একের পর এক দেশ। তারপর আমেরিকায় ঢোকার মুখে মেক্সিকো সীমান্তে ধরা পড়েছেন এবং চালান হয়ে গিয়েছেন বেআইনি অভিবাসীদের জন্য নির্দিষ্ট কারাগারগুলিতে। সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে তাঁদের। অবশেষে দেশের মাটিতে পা রেখেছেন নিঃস্ব রিক্ত অপমানিত সর্বস্বহারা ১০৪ জন মানুষ। প্রথম বারে এই ক’জনকে ফেরত পাঠানো হল। এরপর ধাপে ধাপে আরও ১৮ হাজারের বেশি ভারতীয়কে নাকি দেশে ফেরাবে ট্রাম্প প্রশাসন।
যে আমেরিকা বিশ্বের গণতন্ত্র রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে নিজের ঢাক পেটায়, একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিকদের প্রতি তার প্রশাসনের এই বর্বর আচরণকে ধিক্কার জানানোর ভাষা নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল, দেশের প্রতিনিধি হিসেবে এই আচরণের নিন্দায় প্রধানমন্ত্রীর মুখে একটিও কথা শোনা গেল না কেন? যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তৈরি অভিবাসী নীতির কারণে মার্কিন প্রশাসনের এই অভব্য আচরণ, কিছুদিন আগে আমেরিকায় গিয়ে সেই ট্রাম্পকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন না আমাদের প্রধানমন্ত্রী? কোথায় গেল সেই সখ্য? বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্মানের প্রতি সামান্য ভ্রূক্ষেপ থাকলে ট্রাম্প সাহেব ভারতীয়দের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারতেন কি? এ তো তুলনায় কম ধনী একটি রাষ্টে্রর প্রতি একটি ধনগর্বী, শক্তির আস্ফালনে মত্ত রাষ্টে্রর অমর্যাদারই স্পষ্ট প্রকাশ!
আমেরিকা থেকে ভারতীয়দের এমন জঘন্য ভাবে দেশে ফেরানোর ঘটনা আরেকটি প্রশ্নও তুলে দিয়ে গেল। এই নাকি নরেন্দ্র মোদিজির বহু প্রচারিত ‘বিশ্বগুরু’ হতে চলা ভারত! এই ভারতকেই নাকি অচিরে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের দেশ বানাতে চলেছে বিজেপি সরকার! একটি বিদেশি প্রশাসন যে দেশের মানুষকে পশুর বেশি মর্যাদা দেয় না, সেই দেশের অর্থনীতির বহর যত বড়ই হোক না কেন তাতে দেশবাসীর কতটুকু যায় আসে!
এর চেয়েও বড় প্রশ্ন হল, এ কেমন পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির পথে চলা দেশ, যেখানে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, খাবার পয়সা বাঁচিয়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢেলে ডিগ্রি আয়ত্ত করেও কাজের খোঁজে মাথা খুঁড়ে মরতে হয় যুবশক্তিকে! কেন প্রতি বছর আমেরিকায় পৌঁছে দেওয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া প্রতারক এজেন্টদের খপ্পরে পড়তে হচ্ছে এতগুলি মানুষকে? ‘বিশ্বগুরু’ হতে চলা ভারতে তাদের জন্য কাজ তৈরির ব্যবস্থা এতদিনেও কেন করতে পারল না নরেন্দ্র মোদি সরকার? কোথায় হারিয়ে গেল বছরে দু কোটি বেকারকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি? গত ৪৫ বছরের রেকর্ড ভাঙা বেকারত্ব তো আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে সরকার এ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান প্রকাশ করাই বন্ধ করে দিয়েছে!
বাস্তবে একে একে সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এবং জল জমি নদী জঙ্গল সহ দেশের সমস্ত সম্পদ বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দেওয়ার কাজেই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তার দক্ষতা দেখাতে পেরেছে। মালিক শ্রেণির পদলেহী তাদের এই ভূমিকায় দিনে দিনে আরও বিপন্ন হয়ে পড়ছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের রুজি-রুটি-ভবিষ্যৎ। সেই কারণেই তো আজ দলে দলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও এ ভাবে বিদেশে পাড়ি দিতে হচ্ছে এত অসংখ্য মানুষকে। সরকারের কি উচিত ছিল না, যে কোনও ভাবে এই বেআইনি অভিবাসন রোখার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া? দেশের নাগরিকদের জীবনের দায়িত্ব তো তাদেরই উপর! কেন্দ্রীয় সরকারকে তো এই প্রশ্নের জবাবও দিতে হবে যে বছরের পর বছর ধরে বেআইনি পথে ভারতীয়দের বিদেশে নিয়ে যাওয়ার চক্রগুলি কাজ চালাতে পারছে কী করে? তাদের আরও উত্তর দিতে হবে যে, সরকার যখনই জানতে পেরেছে আমেরিকা থেকে বেআইনি অভিবাসী ভারতীয়দের দেশে ফেরানো হবে, তৎক্ষণাৎ কেন তাঁদের জন্য সরকারি বিমানের ব্যবস্থা করা হয়নি? কেন পশুর মতো করে দেশে ফেরত পাঠানো মানুষগুলিকে বয়ে নিয়ে আসা বিমানটিকে মাটিতে নামার অনুমতি দিয়েছে ভারত সরকার? কলম্বিয়া থেকে আমেরিকায় যাওয়া বেআইনি অভিবাসীদের ঠিক এভাবেই ফেরত পাঠাতে চেয়েছিল মার্কিন প্রশাসন। সে দেশের প্রেসিডেন্ট মার্কিন বিমানটিকে কলম্বিয়ার মাটিতে নামতেই দেননি। দক্ষিণ আমেরিকার ছোট্ট দেশ কলম্বিয়া, যার ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে আমেরিকার মতো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, সে দেশের প্রেসিডেন্ট যদি এই সাহস দেখাতে পারেন, তা হলে ‘বিশ্বগুরু’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী সামান্য প্রতিবাদ করার সাহসটুকুও দেখাতে পারলেন না কেন? কোন অধিকারে দেশবাসীর় মাথায় এই বিপুল অসম্মানের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার স্পর্ধা দেখাতে পারল তাঁর সরকার? প্রশ্নের উত্তর চাইছে মানুষ।
আসলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন-মৃত্যু-মান-মর্যাদা কোনও কিছুরই তোয়াক্কা করে না এই সরকার। পুঁজিবাদী এই রাষ্ট্রে পুঁজিপতি শ্রেণির রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসাবে আদানি-আম্বানিদের মতো একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের সেবা করাটাই তার একমাত্র লক্ষ্য। এতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মরুক বা বাঁচুক, তাদের রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা হোক বা না-হোক, এই সরকারের কিছুমাত্র যায় আসে না। যত দ্রুত এই সত্য বুঝে শুধু এই জনস্বার্থবিরোধী সরকার নয়, শোষণমূলক এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিকেই উচ্ছেদের পথে এগোতে পারবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ– তত দ্রুত মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন সত্য হবে তার।