ঘটনা–১ : খিদিরপুরের কয়লা ডিপো বস্তির ছয় বছরের ছোট্ট পরি বাবাকে বলেছিল, ‘‘মদ খাও, আর আমাকে স্কুলে দিতে পার না?’’ নেশাগ্রস্ত বাবা মেয়ের এই প্রশ্ন শুনে মেজাজ হারিয়ে ফেলে৷ ‘ছোট মুখে বড় কথা’– গর্জাতে গর্জাতে মেয়েকে তুলে আছাড় মারে৷ মৃত্যু হয় নিষ্পাপ শিশু পরির৷
মদের নেশা পরিবারটির অর্ধেক ভেঙেছিল আগেই৷ মদ্যপ স্বামীর অত্যাচার সইতে না পেরে শিশুটির মা বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল৷ এবার মাতৃহারা শিশুটির মর্মান্তিক মৃত্যু হল বাবার হাতেই৷
ঘটনা–২ : ঝাড়গ্রাম জেলার জামবনির তেঁতুলিয়া গ্রামে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী মালা সোরেনের স্বপ্ন– পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষিত হবে৷ কিন্তু বাধা মদ্যপ বাবা৷ মেয়ের কথায়– ‘বাবা নেশা করলেই অন্য মানুষ হয়ে যায়, পড়তে দেখলে তেড়ে আসে, বইপত্র ছুঁড়ে ফেলে দেয়৷’ পড়াশোনার জন্য বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে মালা৷
ঘটনা–৩ : উত্তরাখণ্ড এবং উত্তরপ্রদেশ– দুই বিজেপি শাসিত রাজ্য৷ ১০ ফেব্রুয়ারি সংবাদে প্রকাশ, উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বার এবং উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুরে তিন দিনে বিষমদে প্রাণ হারিয়েছে ৭০ জন৷
এমন অসংখ্য ঘটনা প্রতিদিন রাজ্যে–রাজ্যে, জেলায় জেলায় ঘটে চলেছে৷ গত ডিসেম্বরে নদিয়া জেলায় বিষ মদে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে৷ এই জেলার কৃষ্ণনগরে ২০০২ সালে সিপিএম জমানায় বিষ মদে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছিল৷ ২০০৯ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জমানায় তমলুকের রামতারকে বিষমদে মৃত্যু হয়েছিল ৪৮ জনের৷ বিষমদে মৃত্যুর ধারা সিপিএম আমল থেকে তৃণমূল আমল–একইভাবে অব্যাহত৷ ২০১১ সালে তৃণমূল শাসনে দক্ষিণ ২৪ পরগণার মগরাহাটে বিষমদে মৃত্যু হয় ১৭৩ জনের৷ ২০১৩ সালে বীরভূমের তারাপীঠে ৮ জন এবং ২০১৫ সালে পূর্ব মেদিনীপুরের ময়নায় বিষমদে মৃত্যু হয় ২৫ জনের৷
শুধু কি সরাসরি মৃত্যু? মদের পরোক্ষ প্রভাবে মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির বহরও কি কম? এত যে পথদুর্ঘটনা হচ্ছে এবং মানুষ মারা যাচ্ছে তার পিছনেও রয়েছে চালকদের মদের নেশা৷ সরকার ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফে’র কথা বলে৷ অথচ ‘লাইফ সেভ’ করতে সরকারের কোনও উদ্যোগ নেই৷ হোর্ডিং–এ লেখা ‘সেফ লাইফ’ জীবন বাঁচাও, কিন্তু কাজে দাঁড়াচ্ছে ‘ডেসট্রয় লাইফ’ জীবন ধ্বংস করার প্রক্রিয়া৷ রাজ্যে নারী নির্যাতন মারাত্মক আকার নিয়েছে৷ অত্যাচার, ধর্ষণ, খুন অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে৷ এইসব ঘটনার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অপরাধীরা মদ্যপ অবস্থায় থাকে৷ অথচ সরকারি উদ্যোগেই মদের প্রসার ঘটছে হু হু করে৷
২০১৮ সালে তৃণমূল সরকার ঘোষণা করেছে, ১২০০–র বেশি মদের দোকানের লাইসেন্স দেবে৷ প্রতিটি পঞ্চায়েত এলাকায় পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে না পারলেও একটি করে মদের দোকান খোলার কথা ঘোষণা করেছে সরকার৷ জাতীয় সড়কের ৫০০ মিটারের মধ্যে মদের দোকান খোলা যাবে না, হাইকোর্ট এই রায় দিলেও সরকার আইনের প্যাঁচ কষে তা এড়িয়ে যাচ্ছে৷ সরকারের এই নীতির ফলে স্কুল–কলেজের ছেলেমেয়েরাও মদে আসক্ত হয়ে পড়ছে৷ সরকারের মদের ঢালাও প্রসারের নীতি সমাজ–মনুষ্যত্বের প্রতি এক গভীর ষড়যন্ত্রে পরিণত হয়েছে৷
‘মানুষের ক্ষতি, সমাজের ক্ষতি’– এ সব কথা সরকারের কাছে মূল্যহীন৷ মানুষগুলি তো সরকারের কাছে এক একটা ভোটের সংখ্যা মাত্র৷ ভোট শেষ হলেই তার প্রয়োজনীয়তাও শেষ৷ তারপর সারা বছর ধরে চলে নাগরিক জীবন ছারখার করে দেওয়ার রকমারি আয়োজন৷ সবই চলে রাজস্বের নামে৷ রাজস্ব বৃদ্ধির কথা বলে মানুষকে বোকা বানাতে চায় সরকার৷ তাই রাজকোষ অপচয় বন্ধ করার কোনও আয়োজন নেই৷ রাজকোষের টাকা দিয়ে দান খয়রাতির মারফৎ ভোট ব্যাঙ্ক তৈরি করার হীন রাজনীতি চলে৷ আর সেই রাজকোষ ঘাটতি মেটানোর অজুহাত দিয়ে জনজীবন বিপন্ন করে সরকার খোলে অসংখ্য মদের দোকান, পানশালা৷ চালু করে নানা লটারি৷ সেই লটারিতে শত শত পরিবার সর্বস্বান্ত হলেও সরকারের কোনও উদ্বেগ নেই৷
রাজস্ব না হলে উন্নয়ন হবে কী করে? সরকারের এ হেন কুযুক্তিতে বিভ্রান্ত হয় কেউ কেউ৷ কিন্তু প্রশ্ন হল, নাগরিক জীবন বিপন্ন করে কার উন্নয়ন করতে চায় সরকার? মদের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়ে মানুষের উন্নয়ন করা যায়? সরকার সত্যিই উন্নয়ন করতে চাইলে, সরকারি চুরি, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, অপচয় বন্ধ করত, এমএলএ–এমপিদের অত্যধিক সুবিধা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করত, পুঁজিপতি–শিল্পপতি ও বৃহৎ ব্যবসাদারদের ট্যাক্স ছাড় দেওয়া বন্ধ করত, বিত্তবানদের উপর উন্নয়ন ট্যাক্স ধার্য করত৷ কিন্তু এ সব কোনও কিছু না করে সরকার মদ, লটারি, জুয়া–সাট্টার বন্যা বইয়ে দিচ্ছে৷ তা হলে সরকারের উদ্দেশ্য কী? উন্নয়নের বাহানায় মানুষের, বিশেষত যুবসমাজের নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়াই এর উদ্দেশ্য– যাতে সুস্থ মানুষ হিসাবে তারা গড়ে উঠতে না পারে, সরকারি দলগুলির ভ্রষ্টাচার, দুর্নীতি, জনবিরোধী কার্যকলাপের বিরোধিতা করতে না পারে, প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারে৷ জনদরদের মুখোশ পরেই সরকার এই কাজ করছে৷ যে দল যেখানে ক্ষমতায় রয়েছে তারা সেখানে একই কাজ করছে৷ এ ব্যাপারে তৃণমূল সিপিএম বিজেপি কংগ্রেসে কোনও ফারাক নেই৷
মদের প্রসার নীতিতে তৃণমূল সরকার পুর্বতন সিপিএম সরকারেরই পথ অনুসরণ করছে৷ ২০০৫ সালে সিপিএম সরকার সারা রাজ্যে ১৪০০ নতুন মদের দোকান খোলার লাইসেন্স দিয়েছিল৷ ২০১৮ সালে তৃণমূল সরকার আরও ১২০০–র বেশি মদের দোকান খোলার কথা ঘোষণা করে৷ রাজ্য সরকারি সংস্থা ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট বেভারেজেস করপোরেশন লিমিটেড (বেভকো)–র হিসাবে সারা রাজ্যে বর্তমানে বিলাতি মদের দোকান ও পানশালা রয়েছে ৫,৩০০টি৷ পার্শ্ববর্তী রাজ্য বিহারে প্রবল গণবিক্ষোভে সরকার মদ নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছে৷ অথচ এ রাজ্যে আরও নতুন মদের দোকান খোলার লাইসেন্স দিচ্ছে৷ সমীক্ষার তথ্য বলছে, বিহারে মদ নিষিদ্ধ হওয়ায় বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যকলাপ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে৷
আশার কথা, রাজ্যের মানুষ সরকারের এই সর্বনাশা নীতি চুপচাপ মেনে নিচ্ছে না৷ নিজেদের সন্তানকে বাঁচাতে, পরিবার বাঁচাতে, সমাজকে বাঁচাতে সর্বত্র সোচ্চার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ৷ প্রতিবাদ আন্দোলনে এগিয়ে আসছেন দলে দলে মহিলা৷ ভুক্তভোগীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন৷ প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়ে ফল না হলে নিজেরাই দোকান উচ্ছেদ করছেন৷ ঘোষণা করছেন, এলাকায় কোনও মদের দোকান খুলতে দেওয়া হবে না– যে কোনও মূল্যে আমরা তা প্রতিরোধ করব৷ মহিলারা এই আন্দোলনের সামনের সারিতে৷ কারণ মদের কুফল তাঁদের উপরই বর্তায় বেশি৷ রাজ্যে মহিলা মুখ্যমন্ত্রী৷ কত বিষয়ে তিনি বক্তব্য রাখেন৷ মদ নিষিদ্ধ করার বিষয়ে তিনি মুখে কুলুপ এঁটেছেন৷
৬ ফেব্রুয়ারি ঝাড়গ্রাম ব্লকের সরডিহা গ্রামে উদ্বোধন হয় ‘জঙ্গলমহল লিকার শপ’ নামে একটি মদের দোকান৷ কয়েক দিনের মধ্যেই এলাকার মহিলাদের প্রবল বিক্ষোভে দোকান বন্ধ করতে বাধ্য হয় মালিক৷ একই ভাবে জয়নগর ২ নং ব্লকের মায়াহাউড়ি অঞ্চলের ঘোষালের চক গ্রামে মদের দোকান খুললে এলাকার মহিলারা ঝাঁটা হাতে বিক্ষোভে নামেন এবং দোকান বন্ধ করে দেন৷ এলাকার প্রাক্তন বিধায়ক অধ্যাপক তরুণকান্তি নস্কর বলেন, স্কুল থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে এই মদের দোকান৷ এই দোকান চালু হলে এলাকায় সমাজবিরোধীদের দৌরাত্ম্য বাড়বে৷ পড়ুয়াদের কোনও নিরাপত্তা থাকবে না৷ এই রকম নানা আশঙ্কা থেকেই জেলায় জেলায় ইতিমধ্যে মহিলারা মদের বিরুদ্ধে সামিল হয়েছেন৷ মগরাহাট থানার গোকর্ণী, তসরালাতে মহিলারা মদের দোকান খোলার বিরুদ্ধে লাঠি হাতে বিক্ষোভ দেখিয়ে তা বন্ধ করে দিয়েছেন৷ দক্ষিণ দিনাজপুর, দুই মেদিনীপুর সহ রাজ্যের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে মদবিরোধী আন্দোলন৷
মদের প্রসারে পরিবার ভাঙছে, মরছে মানুষ৷ সরকার তার পৃষ্ঠপোষকতা করছে৷ এ জিনিস চলতে দেওয়া যায় না৷ মদের প্রসারের বিরুদ্ধে এস ইউ সি আই (সি) ১৫ মার্চ সারা রাজ্যে জেলায় জেলায়, ব্লকে ব্লকে প্রশাসনিক ভবনের সামনে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে৷ দলের পক্ষ থেকে সব স্তরের সাধারণ মানুষকে তাতে যোগ দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে৷